ফিলিস্তিন রাষ্ট্র চাইলে মুসলিম দেশগুলো তাদের জমি ছেড়ে দিতে পারে: ইসরায়েলে মার্কিন দূত হাকাবি

ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি বলেছেন, ভবিষ্যতের ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য 'মুসলিম দেশগুলো' তাদের কিছু জমি ছেড়ে দিতে পারে।
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হাকাবি বলেন, 'মুসলিম দেশগুলোর কাছে ইসরায়েলের তুলনায় ৬৪৪ গুণ বেশি জমি আছে। যদি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের এতই আগ্রহ থাকে, তাহলে কেউ হয়তো বলবে—আমরা এটা [রাষ্ট্র] আমাদের এখানে গড়ে তুলতে পারি।'
দুই-রাষ্ট্র সমাধানকে তিনি 'একটা কল্পিত লক্ষ্য' হিসেবে বর্ণনা করেন। এই সমাধান অনুযায়ী, পশ্চিম তীর ও গাজায় একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে, যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার এই প্রস্তাবিত সমাধানটি দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক প্রশাসনও তা সমর্থন করেছে।
তবে ব্লুমবার্গকে দেয়া পৃথক এক সাক্ষাৎকারে হাকাবি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আর স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য অনুসরণ করছে না।
পরে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস জানান, রাষ্ট্রদূত হাকাবি নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন এবং মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে চূড়ান্ত নীতির দায়িত্ব প্রেসিডেন্টের।
চলতি মাসেই নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ফ্রান্স ও সৌদি কূটনীতিকেরা একটি সম্মেলনের আয়োজন করছেন, যেখানে একটি ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা হবে। তবে হাকাবি এই সম্মেলনকে 'অসময়োপযোগী ও অনুচিত' বলে অভিহিত করেছেন।
'ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো কীভাবে যুদ্ধ চলার সময় এরকম একটি প্রক্রিয়া চাপিয়ে দিতে চায়, সেটা পুরোপুরি ভুল চিন্তা', বলেন হাকাবি। তার মতে, এর ফলে ইসরায়েল আরও অনিরাপদ হয়ে পড়বে।
বিবিসির নিউজআওয়ারে হাকাবি বলেন, 'একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কি ঠিক সেখানেই হতে হবে, যেখানে এখন ইসরায়েল আছে? যারা দুই-রাষ্ট্র সমাধানের কথা বলেন, তাদের এ প্রশ্নটি ভাবা উচিত।'
পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হতে পারে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'আমি বলব না যে সেটা কখনোই সম্ভব নয়। তবে আমি বলব, সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসা জরুরি। কারণ, এখনকার সংস্কৃতিতে দেখা যায়, ইহুদিদের হত্যা করাকে বৈধ ভাবা হয় এবং এজন্য পুরস্কৃত করা হয়। এই মনোভাব বদলাতে হবে।'
ইসরায়েল সরকার স্পষ্টভাবেই দুই-রাষ্ট্র সমাধান প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলছে, যেকোনো চূড়ান্ত সমাধান ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই আসা উচিত, আগে থেকেই রাষ্ট্র গঠনের শর্ত জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।
হাকাবি অতীতে 'গ্রেটার ইসরায়েল' ধারণার প্রবল সমর্থক ছিলেন। তিনি অধিকৃত পশ্চিম তীরকে 'জুডিয়া ও সামারিয়া' নামে ডাকেন—যা মূলত বাইবেলীয় পরিভাষা। এই ভাষা প্রায়ই ইসরায়েলের অতিরক্ষণশীল ও কট্টর ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায়। এদের অনেকেই, এমনকি বর্তমান ইসরায়েলি সরকারে থাকা কট্টর ডানপন্থী মন্ত্রীরাও, ফিলিস্তিনিদের পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দেন এবং বলেন, ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র আরব বা মুসলিম দেশগুলোতেই গড়ে উঠতে পারে।
তবে এমন কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে সেটা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন হবে বলে মনে করে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও ইউরোপীয় সরকারগুলো।
রাষ্ট্রদূত হাকাবি আরও কড়াভাবে সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের, যারা সম্প্রতি ইসরায়েলের দুই কট্টর ডানপন্থী মন্ত্রীকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনেছে। ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগে এই নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ড।
নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে এবং তাদের ব্রিটেনে থাকা সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছেন, এই মন্ত্রীরা 'চরমপন্থী সহিংসতায় উসকানি এবং ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনে' জড়িত।
এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ইসরায়েল, আর হাকাবি একে বলেছেন 'চমকপ্রদ'।
তিনি বলেন, 'আমি এখন পর্যন্ত কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা শুনিনি যে কেন এই দুই নির্বাচিত মন্ত্রীকে এমনভাবে শাস্তি দেওয়া হলো। এসব দেশের উচিত ছিল ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো।'
উল্লেখ্য, হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৫৪,৯২৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের হিসাবে, নিহতদের মধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশই শিশু।