পার্লামেন্টে ‘ভীতিকর’ হাকা নাচ করায় নিউজিল্যান্ডের ৩ মাওরি এমপি সাময়িক বরখাস্ত

নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্টে গত বছর এক অধিবেশনের সময় প্রতিবাদস্বরূপ হাকা নাচ করায় তিনজন মাওরি পার্লামেন্ট সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খবর বিবিসির।
বিরোধীদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য হানা-রাউইটি মাইপি-ক্লার্ক সেই ঐতিহ্যবাহী নাচ শুরু করেছিলেন। তাকে সাত দিনের জন্য বরখাস্ত করা হয়েছে। তার দলের দুই সহ-নেতা রাওইরি ওয়াইটিটি ও ডেবি ন্যাগারেওয়া-প্যাকারকে একুশ দিনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নিউজিল্যান্ডের মাওরি জনগণের সঙ্গে করা প্রতিষ্ঠাতা চুক্তিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার বিলে মাওরি পার্টির সমর্থন আছে কিনা জিজ্ঞেস করা হয়। তখন মাওরি পার্লামেন্ট সদস্যরা এর প্রতিবাদে হাকা নাচ করেন।
এই ট্রিটি প্রিন্সিপলস বিল পরে পার্লামেন্টে খারিজ হয়ে যায়, তবে এটি সারা দেশে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। গত বছরের নভেম্বরে বিলটির প্রথমবার পাঠের সময় ৪০ হাজারের বেশি মানুষ পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে প্রতিবাদে অংশ নেয়।
ডেবি ন্যাগারেওয়া-প্যাকার বিবিসিকে বলেন, 'আমরা মাওরি হওয়ার কারণে শাস্তি পেয়েছি। আমরা নিঃসংকোচে মাওরি পরিচয়কে অগ্রাধিকার দিবো এবং আমাদের জনগণ আমাদের কাছে যা প্রত্যাশা করে তাকেই আমরা অগ্রাধিকার দিই।'
বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টে এই শাস্তির বিষয়ে বিতর্ক চলাকালে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিতর্কের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্সকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়, কারণ তিনি মাওরি পার্টি দলকে 'চরমপন্থীদের একটি দল' বলে মন্তব্য করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে দেশ 'তাদেরকে আর সহ্য করতে পারছে না।'
নিউজিল্যান্ডের সংসদের সবচেয়ে তরুণ সদস্য ২২ বছর বয়সী হানা-রাউইটি মাইপি-ক্লার্ক, আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, 'আমাদের কখনোই চুপ করানো যাবে না, আমাদের কখনো হারিয়ে ফেলা যাবে না।'
তিনি প্রশ্ন তোলেন, 'এই সংসদের জন্য আমাদের কণ্ঠ কি অতিরিক্ত উচ্চ? সে জন্যই কি আমাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে?'
গত মাসে একটি সংসদীয় কমিটি ওই মাওরি সংসদ সদস্যদের বরখাস্ত করার প্রস্তাব দেয়। কমিটির ভাষ্য অনুযায়ী, হাকা নাচ সংসদের কার্যক্রম সাময়িকভাবে ব্যাহত করেছে এবং এটি অন্যান্য সংসদ সদস্যদের 'ভীত' করতে পারে বলে মনে করা হয়।
তখন কমিটির এই সিদ্ধান্তকে 'বর্ণবৈষম্যমূলক' বলে যেসব অভিযোগ উঠেছিল, তা অস্বীকার করেন প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টোফার লাক্সন। তিনি বলেন, বিষয়টি হাকা নিয়ে না, বরং সংসদের নিয়ম না মানা রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ নিয়ে।
বৃহস্পতিবারের উত্তপ্ত বিতর্কের পর যে শাস্তিগুলো দেওয়া হয়েছে, তা নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে কোনো সংসদ সদস্যকে দেওয়া দীর্ঘতম শাস্তি। এর আগে সবচেয়ে দীর্ঘ বরখাস্তের মেয়াদ ছিল মাত্র তিন দিন।
নিউজিল্যান্ড দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসী মাওরি জনগণের অধিকার রক্ষায় প্রশংসিত হয়ে আসছিল, তবে বর্তমান রক্ষণশীল সরকার—প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টোফার লাক্সনের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের আমলে মাওরি সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে।
তার সরকার মাওরি জনগণের উপকারে আসা বিভিন্ন কর্মসূচির তহবিল ছাঁটাই করেছে, যার জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মাওরি সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে নিয়োজিত একটি সংস্থা বিলুপ্ত করার পরিকল্পনাও।
তবে প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টোফার লাক্সন দাবি করেছেন, তার সরকার মাওরিদের বিষয়গুলো নিয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। তিনি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন, মাওরি জনগণের মধ্যে সাক্ষরতার হার বাড়াতে পরিকল্পনা এবং জরুরি আবাসনে থাকা শিশুদের স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে।
সম্প্রতি যে বিতর্ক চলছে, তার মূল কেন্দ্রে রয়েছে ট্রিটি প্রিন্সিপলস বিল। এই বিলটি ওয়াইতাঙ্গি চুক্তির নীতিগুলোকে আইনগতভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছিল। ১৮৪০ সালে নিউজিল্যান্ড উপনিবেশকরণের সময়, ব্রিটিশ ক্রাউন এবং মাওরি নেতারা এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।
বিলটির বিপক্ষে থাকা দলগুলো, বিশেষ করে ডানপন্থি অ্যাক্ট পার্টি যারা এটি সংসদে উত্থাপন করেছিল। তারা বলছে, ওই ১৮৪০ সালের চুক্তিকে পুনঃব্যাখ্যা করা প্রয়োজন, কারণ এটি জাতিগতভাবে দেশকে বিভক্ত করেছে এবং এটি বর্তমানে বহুসাংস্কৃতিক সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করে না।
তবে সমালোচকরা বলেন, এই প্রস্তাবিত বিলটিই আসলে বিভাজন তৈরি করবে এবং মাওরি জনগণের জন্য গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করবে।
এই বিলের প্রতিবাদে শুরু হয় একটি হিকোই—অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী পদযাত্রা, যা ৯ দিন ধরে চলে। এটি শুরু হয়েছিল উত্তরাঞ্চল থেকে এবং শেষ হয় রাজধানী ওয়েলিংটনে। শেষপর্যন্ত এতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যায়, যা নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে অন্যতম বড় প্রতিবাদ মিছিলে পরিণত হয়।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে, একটি সরকারি কমিটি বিলটি না এগোনোর সুপারিশ করার কয়েক দিনের মধ্যেই, এটি ১১২ বনাম ১১ ভোটে সংসদে খারিজ হয়ে যায়। যে অ্যাক্ট পার্টি বিলটি উত্থাপন করেছিল, তাদের ১২৩ সদস্যবিশিষ্ট সংসদে মাত্র ছয়টি আসন রয়েছে।