আকাশেও কি যাত্রীবাহী বিমানের গতিসীমা নির্ধারিত?

সড়কে চলার গতিসীমার ইতিহাস ১৬৫২ সালের। তখন নিউ নেদারল্যান্ড কলোনিতে―বর্তমানে মধ্য আটলান্টিক (যুক্তরাষ্ট্রের অংশ) হিসেবে পরিচিত―দ্রুত গতিতে ঘোড়ার গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ ছিল। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গতিসীমা রয়েছে। তাছাড়া ফেডারেল সরকার বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামগুলোর সড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা প্রতি ঘণ্টায় ৭০ মাইল নির্ধারণ করে দিয়েছে।
এদিকে, আকাশে যখন হাজার হাজার বাণিজ্যিক বিমান চলাচল করছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে—বিমানেরও কি কোনো গতিসীমা আছে?
বিমানের পাইলটদেরকে বিভিন্ন জটিল গতিসীমা মেনে চলতে হয়। এর কিছু স্থায়ী, যা প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে শেখানো হয়, আর কিছু তাৎক্ষণিকভাবে নির্ধারিত হয় নির্দিষ্ট পরিস্থিতি বা বিমানের সীমাবদ্ধতার উপর ভিত্তি করে। একটি প্রায় সর্বজনীন নিয়ম হল—সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০,০০০ ফুট উচ্চতার নিচে বিমানের গতি সর্বোচ্চ ২৫০ নট (প্রায় ২৮৮ মাইল প্রতি ঘণ্টা) হওয়া উচিত।
এছাড়া বিমানবন্দর থেকে ১০ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ১১.৫ মাইল) দূরত্বের মধ্যে এবং ৩,০০০ ফুটের নিচে থাকলে বিমানকে গতি কমিয়ে ২০০ নট (প্রায় ২৩০ মাইল প্রতি ঘণ্টা)-এর নিচে রাখতে হয়। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে বৈশ্বিক বিমান চলাচল প্রসার লাভ করলে মাঝ আকাশে সংঘর্ষের হার বেড়ে গেলে এ নিয়ম চালু করা হয়।
এর একটি বড় উদাহরণ ১৯৬০ সালে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনের আকাশে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ডগলাস ডিসি-৮ ও টিডব্লিউএর লকহিড এল-১০৪৯ সুপার কনস্টেলেশন-এর সংঘর্ষ। এ ঘটনায় দুই বিমানের সব যাত্রী মোট ১৩৪ জন নিহত হন। দুর্ঘটনার সময় উভয় বিমানই প্রায় ৩০০ নট গতিতে চলছিল। এ গতি প্রাণহানির সংখ্যা এবং ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়ে পড়ার পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল।
আকাশপথে যানজট নিয়ন্ত্রণ, ফ্লাইটের রুট পরিবর্তন বা যান্ত্রিক ত্রুটি মোকাবেলায় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররাও প্রয়োজনে বিমানের গতি সীমিত করতে পারেন।
বর্ণমালা ব্যবহার করে আকাশসীমাকে ভাগ করা হয়
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০,০০০ ফুটের নিচের আকাশপথ সাধারণত অনেক বেশি ব্যস্ত থাকে, কারণ এই উচ্চতায় থাকা বিমানগুলো সাধারণত উড়াল দিচ্ছে বা অবতরণ করছে। এই উচ্চতায় বিমানগুলো ধীরে চললে সম্ভাব্য সংঘর্ষ এড়ানো সহজ হয়।
১০,০০০ ফুটের নিচে অবস্থান করা বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী বিমান, ছোট প্রাইভেট জেট এবং হালকা ওজনের বিমানের সর্বোচ্চ গতি থাকে ২৫০ নট। এ কম গতির মাধ্যমে আকাশে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
তাছাড়া লস অ্যাঞ্জেলেস ইন্টারন্যাশনাল বা বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল বিমানবন্দর লন্ডনের হিথ্রোর মতো ব্যস্ত বিমানবন্দরগুলোর আশপাশের আকাশপথকে ক্লাস বি শ্রেণিভুক্ত করা হয়।
এই শ্রেণিভুক্ত আকাশপথগুলোর আকৃতি প্রধানত নির্ভর করে প্রতিটি বিমানবন্দরের বিন্যাস ও বিমানের উড়াল ও অবতরণের পথের ওপর। তবে সাধারণত বি ক্লাসের বিমানবন্দরে উপরের দিকে আকাশ পথ যতোটা প্রশস্ত থাকে নিচে তার উল্টোটিই থাকে ঠিক উল্টানো বিয়ের কেকের মতো।
যদিও বি ক্লাসের আকাশপথের নিজস্ব কোনো স্থায়ী গতিসীমা নেই, তবুও উপরে উল্লিখিত সর্বোচ্চ ২৫০ নট গতিসীমা এখানে প্রযোজ্য থাকে, কারণ বেশিরভাগ ক্লাস বি আকাশপথই ১০,০০০ ফুট উচ্চতার নিচে নির্ধারিত থাকে।
তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে। যেমন—ডেনভার ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরের ক্লাস বি আকাশপথ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২,০০০ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত। কারণ বিমানবন্দরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক মাইল উচ্চতায় অবস্থিত। অন্যদিকে, নিউ ইয়র্কের উপর দিয়ে থাকা ক্লাস বি আকাশপথ ৭,০০০ ফুটেই শেষ হয়, যাতে এর উপর দিয়ে অন্য বিমানগুলো আন্তর্জাতিক গন্তব্য বা দেশের অভ্যন্তরের দূরবর্তী স্থানে সহজেই যেতে পারে।
ক্লাস বি আকাশপথের নীচ দিয়ে অথবা ভিজ্যুয়াল ফ্লাইট রেফারেন্স (ভিএফআর) করিডরের মধ্য দিয়ে যেসব বিমান উড়ে, সেগুলোর জন্য সর্বোচ্চ গতিসীমা ২০০ নট নির্ধারিত। ভিএফআর করিডোর হলো ক্লাস বি আকাশপথের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা, যেখানে পাইলটরা যন্ত্র বা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের সহায়তা ছাড়াই চোখে দেখে অনুমান করে বিমান ওড়াতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭টি বৃহত্তম বিমানবন্দরকে ক্লাস বি আকাশপথের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
ছোট বিমানবন্দরগুলোর আশপাশে নির্দেশিকা ভিন্ন হয়ে থাকে
ছোট আকারের বিমানবন্দরগুলোর উপরের ও আশপাশের আকাশপথকে ক্লাস সি বা ক্লাস ডি আকাশপথ হিসেবে ভাগ করা হয়ে থাকে।
ক্লাস সি আকাশপথ সাধারণত মাঝামাঝি ব্যস্ততম ছোট বিমানবন্দরকে ঘিরে থাকে। এটি বিমানবন্দর থেকে ৫ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ৫.৭৫ মাইল) ব্যাসার্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪,০০০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত। এর একটি দ্বিতীয় স্তরও থাকে, যা ১,২০০ থেকে ৪,০০০ ফুট উচ্চতার মধ্যে ১০ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ১১.৫ মাইল) ব্যাসার্ধে বিস্তৃত।
ক্লাস ডি আকাশপথ আরও ছোট বিমানবন্দরগুলোর জন্য প্রযোজ্য। এটি সাধারণত ৪ থেকে ৫ নটিক্যাল মাইল চওড়া একটি সিলিন্ডার আকৃতির এলাকা, যা মাটি থেকে শুরু করে ২,৫০০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত বা নিকটবর্তী উঁচু আকাশপথের নিচের প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।
ক্লাস ডি আকাশপথ ব্যবহার করা হয় ছোট আকারের এমন বিমানবন্দরের আশপাশে, যেগুলোতে কন্ট্রোল টাওয়ার রয়েছে, কিন্তু ক্লাস সি বিমানবন্দরের মতো অতটা ব্যস্ত নয়।
ক্লাস সি ও ডি আকাশপথে পাইলটদের অবশ্যই কমপক্ষে ৩ স্ট্যাচুট মাইলে (প্রায় ২.৬ নটিক্যাল মাইল) স্পষ্ট দৃষ্টিসীমা বজায় রাখতে হয় এবং মেঘের ভেতর দিয়ে না উড়ে তা এড়িয়ে চলতে হয়।
যদিও আকাশ অনেকটা খোলা মাঠের মতো মনে হতে পারে, যেখানে পাইলটরা ইচ্ছেমতো গতি কমাতে বা বাড়াতে এবং পথ বেছে নিতে পারেন—আসলে বিষয়টি তেমন নয়। আকাশে চলাচলরত প্রতিটি বিমানই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের মাধ্যমে সবসময় নজরদারির মধ্যে থাকে এবং নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত হয়, যাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
ল্যান্ডিং গিয়ার বা উইং ফ্ল্যাপ ব্যবহারেরও নির্দিষ্ট গতিসীমা আছে
পাইলটরা নিরবিচ্ছিন্নভাবে রেডিওর মাধ্যমে স্থলে থাকা কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কন্ট্রোল টাওয়ারের কাছ থেকে গতি, গমনপথ, উচ্চতা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সর্বশেষ নির্দেশনা পান পাইলটরা। এভাবেই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল পাইলটদের জন্য অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়ের মতো কাজ করে, যাতে তারা বিশাল কিন্তু এ যানজটপূর্ণ আকাশপথেও তাদের বিমান নিরাপদে চালাতে পারেন।
বিমান চলাচলের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল, যা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা নিয়ন্ত্রণ করেন। এর মাধ্যমে তারা বিমানগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু চলাচল এবং নিরাপদ দূরত্ব রাখেন, বিশেষ করে আকাশে বিমানের সংখ্যা যখন বেশি থাকে।
উপরের ক্লাস ভিত্তিক আকাশপথের গতিসীমা স্থায়ী নির্দেশিকা হলেও, পাইলটদের মাঝে কন্ট্রোলাররা যেসব গতি অনুমোদন দেন তা অস্থায়ী এবং নিয়মিত পরিবর্তিত হয়। সাধারণত ট্রাফিক, আবহাওয়া ও অন্যান্য পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে গতিসীমা পরিবর্তিত হয়।
এই প্রক্রিয়াটিকে একধরনের সাদৃশ্য হিসেবে বলা যায়—যেমন একটি হাইওয়েতে গাড়িচালক অন্যান্য যানবাহনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গতি কমাতে বা বাড়াতে পারে। তারা এর মাধ্যমে যানজটে অন্যের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে ও যানজট থেকে বের হয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে নিতে পারে। ঠিক তেমনি কেন্দ্রীয় রাডার ট্র্যাকিং সিস্টেম থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনায় পাইলটরাও তাদের গতি সমন্বয় করেন। এটাই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের কার্যপদ্ধতির বাস্তবচিত্র।
কিছু বিমানের গতিসীমা নির্দিষ্ট যন্ত্রপাতি বা ফিচারের ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, বিমানের উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারগুলো সাধারণত প্রায় ২০০ নট পর্যন্ত গতি বজায় রেখে ব্যবহার করা হয়। ল্যান্ডিং গিয়ার বা উইং ফ্ল্যাপ ব্যবহার করলেও বিমানের গতি সীমিত হয়ে যায়।
তবে এসব গতিসীমা ভ্রমণকে খুব একটা ধীর করে না, কারণ যাত্রাকালে বিমানগুলো ক্রুজিং উচ্চতায় প্রায় মাচ ০.৮৫ (প্রায় ৫৭০ মাইল প্রতি ঘণ্টা) পর্যন্ত গতি পেতে পারে। সৌভাগ্যবশত, অধিকাংশ বাণিজ্যিক বিমানই তাদের যাত্রার অধিকাংশ সময় এমন উচ্চতায় থাকে। কারণ সেখানে ট্রাফিক কম থাকে, দৃষ্টিসীমানায় সব কিছু স্পষ্ট থাকে এবং গতিসীমার তেমন প্রয়োজন হয় না।