যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতারিতদের নিজ দেশে ফেরত না পাঠিয়ে কেন অন্য দেশে পাঠানো হচ্ছে?

৪০ বছর বয়সী নগ ফান তার স্বামীর ভিয়েতনামে ফেরত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের দক্ষিণের বাড়িতে বসে তিনি কাপড় আর একটি মোবাইল ফোনসহ লাগেজ গুছিয়ে রেখেছিলেন গত বসন্তেই। ফানের ভাষ্য অনুযায়ী, তার স্বামী তখন ভ্রমণের কাগজপত্র ও অন্যান্য নথিপত্র পূরণ করছিলেন। ভিয়েতনামে থাকা স্বজনরাও তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কয়েক বছরের মধ্যে তিনিও সেখানে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করবেন—এমনটাই ছিল পরিকল্পনা।
ফান এনপিআরকে বলেন, 'এই পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে—ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট অফিসারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ, তার ঘরভর্তি ঘোষণাপত্র পূরণ, বিমানবন্দরে তাকে নিতে আসবেন এমন লোকজনের নাম পাঠানো—এসব কিছুতে কোথাও উল্লেখ ছিল না যে, তাকে ভিয়েতনাম ছাড়া অন্য কোথাও পাঠানো হবে।'
প্রত্যাবাসনের ঘটনাটি তাদের জন্য অপ্রত্যাশিত ছিল না। তার স্বামী তুয়ান থান ফান ২০০০ সালে একটি গ্যাং-সংক্রান্ত বিবাদের সময় গুলি ছুড়ে এক পথচারীকে আহত করার ঘটনায় প্রথম ডিগ্রির হত্যা ও দ্বিতীয় ডিগ্রির হামলার অভিযোগে প্রায় ২৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
তার স্ত্রী জানান, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিন কার্ডধারী তুয়ান থান ফান তার সাজাভোগের সময় ২০০৯ সালে স্থায়ী বসবাসের অধিকার হারান।
৩ মার্চ, তার মুক্তির দিন ওয়াশিংটনের কনেল শহরের কায়োট রিজ সংশোধনাগার কেন্দ্র থেকে তাকে তুলে নেয় ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) কর্মকর্তারা এবং সরাসরি তাকে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ায় পাঠিয়ে দেন।
'আমরা এটা মেনে নিয়েছিলাম। আমরা প্রস্তুত ছিলাম, এমনকি অপেক্ষায় ছিলাম,' বলেন তার স্ত্রী নগ ফান। 'কিন্তু হঠাৎ গভীর রাতে তাকে তুলে নিয়ে দক্ষিণ সুদানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।'
ভিয়েতনামের নাগরিক নগ ফানের স্বামীসহ আরও কয়েকজন পুরুষকে শুরুতে জানানো হয়েছিল, তাদের নিজ নিজ দেশে না পাঠিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানো হবে। ওই পুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ মেক্সিকো, বার্মা, কিউবা ও লাওসের নাগরিক ছিলেন।
কিন্তু পরে জানানো হয়, তাদের গন্তব্য হবে আফ্রিকার রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল ও বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ দক্ষিণ সুদান।
এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের যুক্তি— যেহেতু এসব ব্যক্তির নিজ দেশের সরকার তাদের ফেরত নিতে রাজি নয় এবং যেহেতু তাদের অপরাধের রেকর্ড রয়েছে, তাই তাদের যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে দেওয়া যায় না।
ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট–এর (আইসিই) ভারপ্রাপ্ত পরিচালক টড লায়ন্স এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'একজন পেশাদার আইসিই কর্মকর্তা হিসেবে আমি বহু বছর ধরে এসব অবাধ্য দেশের সঙ্গে কাজ করছি। হত্যা, যৌন নির্যাতন ও সহিংস অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্তদের বারবার মুক্তি পেয়ে আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসতে দেখেছি, কারণ তাদের নিজ দেশ তাদের নিতে চায়নি।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন আমরা এমন ব্যক্তিদের ফেরত পাঠাতে পারছি, যারা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি। এতে করে তারা আর মার্কিন জনগণের ক্ষতি করতে পারবে না।'
নগ ফান জানান, 'রাতের অন্ধকারে তাকে (স্বামীকে) তুলে নিয়ে গিয়ে পাঠিয়ে দিল দক্ষিণ সুদানে।'
দক্ষিণ সুদানে পাঠানো একটি ফ্লাইটের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসনবিষয়ক আইনজীবীরা। তাদের অভিযোগ, তাদের মক্কেলদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়নি—যাতে তারা নিজ দেশ নয়, অন্য কোনো দেশে প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপত্তি জানাতে পারে।
এই একই দল এর আগেও চলতি মাসে লিবিয়ায় পাঠানোর জন্য নির্ধারিত আরেকটি ফ্লাইট বন্ধ করতে আদালতের শরণাপন্ন হয়। লিবিয়াও একটি অস্থিতিশীল দেশ, যেখানে অভিবাসীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ফেডারেল বিচারক ব্রায়ান মারফি, যিনি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মনোনয়নে দায়িত্বে এসেছেন, অভিবাসন আইনজীবীদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। তিনি বলেন, যেসব অভিবাসীকে তাদের নিজ দেশ ছাড়া অন্য কোথাও পাঠানো হচ্ছে, তাদের অবশ্যই নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যার পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে।
বিচারক স্পষ্ট করে বলেন, এসব অভিবাসীকে 'ক্রেডিবল ফিয়ার ইন্টারভিউ' [একটি প্রাথমিক সাক্ষাৎকার, যেখানে অভিবাসন কর্তৃপক্ষ যাচাই করে—আবেদনকারী যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত হলে তার নিজ দেশ বা অন্য কোথাও গিয়ে নির্যাতন, সহিংসতা বা প্রাণনাশের আশঙ্কা রয়েছে কি-না] দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। যার মাধ্যমে তারা বোঝাতে পারবে, নির্দিষ্ট কোনো দেশে পাঠানো হলে তাদের সহিংসতা বা নিপীড়নের শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উত্তর-পশ্চিম অভিবাসী অধিকার প্রকল্পের আইনবিষয়ক পরিচালক ম্যাট অ্যাডামস, যাদের সংস্থা দক্ষিণ সুদানসহ তৃতীয় দেশে বিতাড়নের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, বলেন, 'কেউ যদি কোনো অপরাধে দণ্ডিত হয়ে শাস্তি ভোগ করে থাকেন, তবে সরকারের কি অধিকার আছে তার এবং তার পরিবারের জীবন এভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার?'
তিনি আরও বলেন, 'এটা যেন আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে পুরোপুরি অস্বীকার করার মতো ব্যাপার।'
তৃতীয় দেশের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িতদের ফেরত পাঠানোর হার বাড়ছে
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িতদের নিজ দেশে পাঠানোর পরিবর্তে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর কৌশল নতুন নয়।
উদাহরণস্বরূপ, মেক্সিকোতে অতীতে এমন অনেক মানুষকে পাঠানো হয়েছে, যাদের নিজ নিজ দেশ ফিরিয়ে নিতে রাজি ছিল না। যেমন, কিউবা ও ভেনেজুয়েলা অনেক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িতদের গ্রহণ করত না। আবার কিছু দেশ বিমান ফ্লাইটের সংখ্যা সীমিত করে রাখে।
ভিয়েতনামও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িতদের গ্রহণে সীমাবদ্ধতা আরোপকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে ভিয়েতনাম, যাতে ১৯৯৫ সালের আগেই যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোদের গ্রহণ করার প্রক্রিয়া কিছুটা সহজ হয়। ফান ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী অ্যাডামস, যিনি নর্থওয়েস্ট ইমিগ্র্যান্ট রাইটস প্রজেক্টে কাজ করেন।
ট্রাম্প প্রশাসন চেয়েছিল, চীন, ভেনেজুয়েলা ও কিউবার মতো দেশগুলো যেন তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে আরও সক্রিয় হয়।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের কর্মকর্তারা দক্ষিণ সুদানে পাঠানোর বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ওই ব্যক্তিদের নিজ নিজ দেশ তাদের গ্রহণ করবে না। কারণ তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হত্যাকাণ্ড ও যৌন হেনস্থাসহ নানা অপরাধ করেছে।
আইসিই-র লায়নস বলেন, 'এরা এমন লোক যাদের আপনার কমিউনিটিতে দেখতে চান না। এদের আমরা প্রতিদিন অগ্রাধিকার দিয়ে যাচাই করি।'
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এপ্রিল মাসে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে বলেন, 'যত দূরে পাঠানো হবে ততই ভালো, যাতে তারা সীমান্ত পার হয়ে ফিরে আসতে না পারে।'
'ক্রেডিবল ফিয়ার' দাবি নিয়ে আলোচনা
আমেরিকান ইমিগ্রেশন লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ডিরেক্টর গ্রেগ চেন বলেন, এই প্রশাসনের আলাপ-আলোচনায় যেসব দেশের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে, সেগুলো আগের প্রশাসনের থেকে ভিন্ন।
তিনি বলেন, 'আইনের মূলনীতি হল, প্রত্যাবাসন যে দেশে হবে সেটি সেই ব্যক্তির জন্য নিরাপদ হতে হবে।'
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ দক্ষিণ সুদানের পরিস্থিতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের যাত্রা নির্দেশিকায় দক্ষিণ সুদানে 'অপরাধ, অপহরণ ও সশস্ত্র সংঘর্ষের' কারণে নাগরিকদের যাত্রা এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রত্যেক প্রত্যাবাসিত ব্যক্তিকে অবশ্যই জানানো হয় কোন দেশে পাঠানো হবে এবং যদি তারা নির্যাতনের আশঙ্কা প্রকাশ করে, তাহলে তা দ্রুত পরীক্ষা করার সুযোগ দেওয়া হয়।
আইনের লড়াই প্রধানত এই নিয়ে যে, প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য কত সময় দেওয়া উচিত। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বলে, এই প্রক্রিয়া 'কয়েক মিনিটের' কাজ, সপ্তাহ নয়।
দক্ষিণ সুদানে পাঠানোর ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিদের ২৪ ঘণ্টার কম সময় দেওয়া হয়েছিল।
ইমিগ্রেশন আইনজীবীরা বলেন, এত কম সময় দেওয়ার কারণে প্রত্যাবাসিতরা সহজে তাদের অভিযোগ উপস্থাপন করতে পারে না, বিশেষ করে যারা ইংরেজি জানে না তাদের জন্য এটা আরও কঠিন।
গ্রেগ চেন মন্তব্য করেন, 'এভাবে তাড়াহুড়া করে প্রত্যাবাসন করলে প্রশাসন আইনি প্রক্রিয়া লঙ্ঘনের ঝুঁকিতে পড়ছে।'
আদালতে লড়াই চলছে
ম্যাসাচুসেটসের বিচারক মারফি তৃতীয় কোনো দেশে প্রত্যাবাসন নিষিদ্ধ করেননি। তবে তিনি বলছেন, সরকারের অবশ্যই প্রত্যাবাসিত ব্যক্তির ভাষায় নোটিশ দিতে হবে এবং ১৫ দিন সময় দিতে হবে আপত্তি জানানোর জন্য — যা দক্ষিণ সুদানের ফ্লাইটের ক্ষেত্রে হয়নি।
ফ্লাইট যাওয়ার পর বিচারক মারফি ওই ব্যক্তিদের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের হেফাজতে থাকার নির্দেশ দেন, যতক্ষণ তারা 'ক্রেডিবল ফিয়ার' (বিশ্বাসযোগ্য ভয়) মূল্যায়ন করবে।
ফ্লাইটটি অবশেষে জিবুতিতে একটি সামরিক ঘাঁটিতে ল্যান্ড করে। মে মাসের ২২ তারিখ থেকে ওই ব্যক্তিরা ও ফেডারেল কর্মকর্তারা সেখানে রয়েছেন। প্রশাসন আদালতে এই আদেশের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
ট্রাম্প প্রশাসন মারফির আদেশ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে। তাদের যুক্তি, বিচারক প্রশাসনের অভিবাসন নীতি ও আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনে হস্তক্ষেপ করছেন।
যুক্তি দিয়ে মার্কিন সলিসিটার জেনারেল জন সাওয়ার বলেন, 'এই বিদেশিরা ফ্লাইটের মাঝখানে আটকে পড়ায় সরকারকে জিবুতির সামরিক ঘাঁটিতে আটক রাখতে হয়েছে, যা এমন অপরাধীদের রাখা উপযুক্ত নয়। পরে আদালত অতিরিক্ত কঠোর নিয়ম আরোপ করেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'কিছু বিদেশির জন্য এই বিলম্ব লাভজনক হলেও দেশের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে আমেরিকার বৈদেশিক নীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।'
সুপ্রিম কোর্ট ওই ব্যক্তিদের পক্ষে আইনজীবীদের ৪ জুন পর্যন্ত আপিলের জবাব দিতে সময় দিয়েছে। এরপর সরকার পাল্টা জবাব দেবে। এরপর কোর্ট সিদ্ধান্ত নেবে।
ততক্ষণ পর্যন্ত ওই ব্যক্তিরা ও অভিবাসন কর্মকর্তারা জিবুতিতে থাকবেন।
ফানকে তার স্বামী প্রতিদিন কারাগার থেকে ফোন করতেন। যখন থেকে স্বামীকে বিমানে উঠানো হয়েছে, তখন থেকে তিনি আর কোনো খোঁজ পাননি তিনি হতাশ কারণ প্রশাসন তার স্বামীকে অন্যদের সাথে এক করে দিচ্ছে যারা হয়তো অবৈধভাবে দেশে ঢুকেছে ও বিভিন্ন অপরাধ করেছে।
ফান বলেন, 'আমার খুব রাগ লাগছে। তারা তাকে বর্বর দানব বলছে, অথচ তার মামলার বিবরণ তারা ঠিক বুঝতে চায় না... তিনি ইতোমধ্যেই ২৫ বছর সাজা ভোগ করেছেন।'