ঘুমালেই মুখের ওপর হেঁটে বেড়ায় যেসব খুদে পোকা

রাতের বেলা আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি তখন আমাদের মুখের ত্বকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে ছোট ছোট অসংখ্য পোকা, যেগুলো খালি চোখে দেখা যায় না। শুধু তাই নয়, ত্বকের ওপর জমজমাট উৎসবেও মেতে ওঠে এরা। আর দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আবাও লুকিয়ে পড়ে আমাদের ত্বকের গভীরে। আট পা বিশিষ্ট অদ্ভুত এই পোকার নাম ডেমোডেক্স মাইট।
প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় প্রত্যেক মানুষের শরীরেই আছে এই মাইট। একেকটি এতটাই ছোট, মাত্র ০.১৫ থেকে ০.৪ মিলিমিটার লম্বা যে খালি চোখে দেখাও যায় না। এদের বাস লোমকূপের চারপাশে। ত্বকের প্রাকৃতিক তেল খেয়ে এরা বেঁচে থাকে।
'মানুষ যখন ঘুমায়, তখনই তারা বাইরে আসে। তখন তারা মুখের উপর ঘুরে বেড়ায়, প্রজনন করে। আর ঘুম ভাঙলেই ওরা আবার ফিরে যায় লোমকূপের গভীরে,' বলেন ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব রিডিংয়ের ইনভার্টিব্রেট বায়োলজির সহযোগী অধ্যাপক আলেহান্দ্রা পেরোত্তি।
মাইটকে অনেকের কাছে অস্বস্তির মনে হতে পারে। কিন্তু পেরোত্তি আশ্বস্ত করে বলেন, ' এই মাইটগুলো কোনো শত্রু নয়। বরং এরা আমাদের শরীরের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে, যে এখন তারা আমাদের জন্য উপকারীই বলা যায়। '
ডেমোডেক্স মাইটরা ত্বকের লোমকূপকে পরিষ্কার রাখে। আর এর বিনিময়ে তারা পায় তাদের প্রিয় উপহার 'মেলাটোনিন'। এই হরমোন আমাদের ত্বক থেকেই তৈরি হয়, ঘুম আসায় সাহায্য করে। কিন্তু এটি মাইটদের জন্য প্রাণশক্তির জ্বালানি, জানালেন পেরোত্তি।
সূর্যের আলো এদের সহ্য হয় না। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি সহজেই নষ্ট করে দেয় ওদের ডিএনএ। তাই দিনের আলোতে লুকিয়ে থাকে, আর রাতে বেরিয়ে আসে যেন কিনা ভ্যাম্পায়ারদের দল!
মুখের ত্বকের প্রতি বর্গসেন্টিমিটারে গড়ে পাঁচটি করে মাইট থাকতে পারে। কিন্তু খালি চোখে দেখা অসম্ভব। মাইক্রোস্কোপে দেখলেই কেবল এদের ধরা যায়।
যখন মাইট হয়ে ওঠে বিপদ
মাইটরা সাধারণত মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, তবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেলে ওদের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। তখন দেখা দিতে পারে একধরনের রোগ- ডেমোডিকোসিস, জানালেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ড. রিচার্ড লক্সলি।
বয়স্ক মানুষ, কেমোথেরাপি নেওয়া রোগী বা যারা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতিতে ভোগেন, তাদের জন্য এই মাইটগুলো ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। ড. লক্সলি বলছেন, 'সব বন্য প্রাণী কিন্তু এই মাইট থেকে কোনো রোগে আক্রান্ত হয় না। কিন্তু পোষা কুকুর বা বিড়াল হয়। হয়তো আমাদের বাসস্থান আর পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু জেনেটিক মিউটেশন আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলেছে।'
এই সংক্রমণের ফলে ত্বকে দেখা দিতে পারে লালচে ফুসকুড়ি, ব্রণ, শুষ্কতা, চুলকানি কিংবা খোস-পাঁচড়া। সবচেয়ে বেশি হয় গাল, চোখের পাতা, কপাল বা নাকের পাশে যেখানে তেল বেশি জমে।
চোখের নানা সমস্যায়ও এরা জড়িত। ওহাইওর চক্ষু বিশেষজ্ঞ ড. কোরি ল্যাপিন জানান, চোখের পাতার গোড়ায় যদি মাইটদের ডিম বা বর্জ্যের মোমের মতো স্তর জমে, তাহলে তা ড্রাইনেস, চুলকানি, চোখের পাতার লোম পড়ে যাওয়া কিংবা বারবার চোখে স্টাই হওয়ার কারণ হতে পারে।
মাইটের ক্ষতি থেকে বাঁচতে যা করা দরকার
অন্তত সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মাইট নিয়ে ভয়ের কিছু নেই । 'অধিকাংশ মানুষ জানেই না যে তাদের শরীরে এই মাইট আছে এবং সেটা ভালো বিষয়,' বলেন ড. রিচার্ড লক্সলি। 'নিজে থেকে খোঁজাখুঁজি করে সমস্যাকে জটিল করে তোলার দরকার নেই। বরং যদি কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই সবচেয়ে ভালো।'
ত্বকের অতিরিক্ত তেল ও ধুলাবালি দূর করতে রাতে ঘুমানোর আগে হালকা ক্লেনজার ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। নিয়মিত ঘুমের আগে পরিচ্ছন্নতার রুটিন বজায় রাখলে মুখে জমে থাকা ময়লা কমে, মাইটদের প্রজননের সুযোগও হ্রাস পায়।
চোখে মেকআপ বা নকল চোখের পাতা থাকলে তা তুলে ফেলতে হবে। কারণ চোখের চারপাশের টিস্যু খুবই সংবেদনশীল, সহজেই সংক্রমণ হতে পারে।
যাদের ব্রণ হওয়ার প্রবণতা আছে, তারা সপ্তাহে এক-দুই দিন হালকা রেটিনয়েড ব্যবহার করতে পারেন বলে জানান ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডার্মাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রবার্তো রিকার্ডো-গনজালেজ।'তবে অতিরিক্ত কিছুই ভালো নয়। অতিরিক্ত স্ক্রাব বা ক্লিনজিং করলে ত্বকের ময়েশ্চার ব্যারিয়ার নষ্ট হয়। তখন ত্বক হয়তো বেশি তেল তৈরি করে বা একেবারেই শুকিয়ে যায়। আর এটাই মাইটদের প্রজননের আদর্শ পরিবেশ,' বলেন তিনি।
পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীর বেশি করে সিবাম বা তেল উৎপন্ন করে, যেটি মাইটদের খাদ্য। নিয়মিত ঘুম তাই শুধু মানসিক শান্তির জন্য নয়, ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষাতেও জরুরি।
যদি মাইটদের অতিরিক্ত সংখ্যা ত্বকে সমস্যা তৈরি করে, তবে চিকিৎসকরা আইভারমেকটিন নামের ওষুধ দিয়ে থাকেন। তবে একেবারে মাইট-শূন্য হওয়া সম্ভব নয় কেননা এরা এক ধরনের 'সহাবস্থানকারী' প্রাণী।ডেমোডেক্স-জনিত চোখের পাতার সংক্রমণের জন্য ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদিত হয়েছে নতুন ধরনের মেডিকেটেড আইড্রপস, জানালেন ড. ল্যাপিন। এটি চোখে মাইটের ডিম ও বর্জ্যের পরিমাণ হ্রাস করে।
আজ আছে, কাল নেই?
শত শত বছর ধরেই মানুষের শরীরে দেখা যাচ্ছে ডেমোডেক্স মাইটদের। ধারণা করা হয়, জন্মের কিছু সময় পর মায়ের সংস্পর্শ থেকেই শিশুর দেহে চলে আসে এই ক্ষুদ্র জীব। কিন্তু ২০২২ সালে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য জানান আলেহান্দ্রা পেরোত্তি। তার গবেষণা বলছে এই সহাবস্থানকারী প্রাণীগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে।
'মানুষের শরীরে এতটাই নির্ভরশীল হয়ে গেছে এই মাইটরা, যে ধীরে ধীরে তাদের জিন বা জেনেটিক বৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে,' বললেন পেরোত্তি। 'এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে এক সময় হয়তো তারা একেবারেই হারিয়ে যাবে।'
ডেমোডেক্স মাইটদের নেই কোনো শত্রু, প্রতিদ্বন্দ্বী বা পরিবেশগত চাপ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই মানবশরীরে বংশবিস্তারে তাদের মধ্যে হয়েছে 'ইনব্রিডিং'। এর ফলেই কমেছে জেনেটিক বৈচিত্র্য।
তবে কবে তারা পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে তা এখনো অজানা। পেরোত্তি মনে করেন, এটা নিয়ে না তো আনন্দ করার কিছু আছে, না দুঃখ করার। কারণ মানুষ ধীরে ধীরে হয়তো এমনভাবেই অভিযোজিত হবে যে এই মাইটদের প্রয়োজনই থাকবে না।
'অনেক দিন ধরেই এই মাইটদের নিয়ে নেতিবাচক কথা বলা হয়। নানা সমস্যা তাদের ঘাড়ে চাপানো হয়,' বলেন পেরোত্তি। 'কিন্তু সমস্যার আসল উৎস হলো দুর্বল ইমিউন সিস্টেম , মাইট নয়। তাদের বরং অনেকটা আমাদের সহচর হিসেবেই ভাবা যেতে পারে'।
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা