ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু আলোচনা, তেহরানে গভীর হচ্ছে সন্দেহ-আশঙ্কা

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইতালির রোমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের কর্মকর্তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। তবে শুক্রবারের এ আলোচনার সন্দেহ প্রকাশ করেছে তেহরান। বিশেষত ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সম্পূর্ণ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ— এ সন্দেহকে গভীর করছে।
এবিষয়ে এক শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তাও জানিয়েছেন, আলোচনা 'গঠনমূলক' হলেও আরও সময় প্রয়োজন। দুই পক্ষ শিগগিরই আবার বসতে রাজি হয়েছে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি জানিয়েছেন, আলোচনা 'খুব জটিল' এবং তা কয়েকটি বৈঠকে নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। তবে তিনি এটিকে 'সবচেয়ে পেশাদার' আলোচনার একটি হিসেবে উল্লেখ করেন।
তেহরানের দুজন সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে বলছে, যা মেনে নিলে আলোচনা ভেঙে পড়বে। সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইরান শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থান বুঝতেই রোম আলোচনায় অংশ নিচ্ছে।
মার্কিন প্রশাসনের দাবি, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ 'অস্ত্রায়নের পথ খুলে দেয়'। ইরান অবশ্য বলছে, তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং তারা অস্ত্র-স্তরে বা পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য দরকারি মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ না করার প্রতিশ্রুতি দিতে প্রস্তুত।
রোমে শুক্রবারের আলোচনার সময় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি ও ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আল-বুসাইদির মধ্যে বৈঠক হয়। তারা আলোচনা-পরবর্তী করণীয় নিয়ে মতবিনিময় করেন। ইরান জানায়, পরবর্তী বৈঠকের সময় ও স্থান পরে জানানো হবে।
মধ্যস্থতাকারী আল-বুসাইদি সামাকিক মাধ্যম 'এক্স' (সাবেক টুইটার) -এ বলেন, 'আমরা আশা করি সামনের দিনগুলোতে বাকি বিষয়গুলো স্পষ্ট করে একটি সম্মানজনক ও স্থায়ী সমঝোতার পথে এগোতে পারব।'
আরাঘচি ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তায়ানিকে ফোনে আলোচনার আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং আশা প্রকাশ করেন, 'আমাদের মূল অবস্থানগুলো স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাস্তব অগ্রগতি সম্ভব হবে।'
বৃহস্পতিবার আরাঘচি জানান, ইরান নিজেদের পরমাণু কর্মসূচির ওপর আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের আওতা বাড়াতে প্রস্তুত, তবে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের অধিকার, বিশেষত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ থেকে সরে আসবে না। সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াশিংটন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের বিপক্ষে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে, যা নিয়ে তেহরানে নতুন করে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
সিএনএনকে দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে ইরানের দুটি সূত্র জানায়, 'যুক্তরাষ্ট্র যখন জানে যে ইরানের কাছে তার পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করা গ্রহণযোগ্য নয়, তবুও যখন তা চাপিয়ে দিতে চাইছে, তখন এটি একটি স্পষ্ট বার্তা দেয় যে , তারা প্রকৃত সমঝোতা চায় না, বরং আলোচনাকে চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।'
আলোচনার শুরুতে কিছু ইরানি কর্মকর্তা মনে করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র পারস্পরিক স্বার্থে 'উইন-উইন' সমঝোতায় আগ্রহী। তবে এখন তেহরানে মতৈক্য তৈরি হয়েছে যে, ট্রাম্প প্রশাসন আলোচনাকে অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান দুই পক্ষই আলোচনার টেবিল ছাড়তে চাইছে না, কিন্তু ওয়াশিংটনের কঠোর অবস্থানের কারণে বৈঠকগুলো ফলপ্রসূ হচ্ছে না এবং আনুষ্ঠানিক আলোচনা খুব বেশি দিন চলবে না বলেই ধারণা।
তারা আরও জানায়, তেহরান এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের 'ইসরায়েল থেকে দূরত্ব রাখার' প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। ইরানের দৃষ্টিতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবগুলো ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কঠোর অবস্থানকে অনুসরণ করছে, যিনি ইরানে যেকোনো ধরনের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পুরোপুরি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন।
একটি সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে, আলোচনার ফাঁকে শুক্রবার রোমে মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ— ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ রন ডারমারের সঙ্গে বৈঠক-ও করেছেন।
আলোচনার পূর্বেই যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞা
কূটনৈতিক আলোচনা চললেও ইরানের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। পঞ্চম দফার আলোচনা শুরুর ঠিক আগে বুধবার ওয়াশিংটন নতুন নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দাবি, ইরানের নির্মাণ খাত ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)-র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং দেশটি পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১০টি কৌশলগত উপাদান ব্যবহার করছে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্র ওই খাতে আরও বিস্তৃত নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুযোগ পেল।
পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস বলেন, 'এই পদক্ষেপের ফলে আমরা আইআরজিসি-নিয়ন্ত্রিত নির্মাণ খাতে ব্যবহৃত উপকরণগুলোর পথ বন্ধ করতে পারব।'
এদিকে, ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর এই পদক্ষেপকে 'অবৈধ, অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য' বলে মন্তব্য করেছেন। এক্স-এ দেওয়া বার্তায় তিনি বলেন, 'প্রতিবারের মতো নতুন নিষেধাজ্ঞা আবারও প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে ইরানের অগ্রগতি ঠেকাতে মরিয়া। আলোচনার আগমুহূর্তে এই পদক্ষেপই প্রশ্ন তোলে, যুক্তরাষ্ট্র আদৌ কূটনৈতিক সমাধানে আগ্রহী কি না।'
ইরানের প্রকৃত মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ যুক্তরাষ্ট্র
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)-এর ইরান প্রকল্প পরিচালক আলি ভায়েজ বলেন, ওয়াশিংটনে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত যে দুর্বল ইরান সহজেই সমঝোতায় যাবে। কিন্তু বাস্তবতা তার উল্টো। 'ইরান যত দুর্বল হবে, ততই বড় ধরনের ছাড় দিতে অনীহা দেখাবে,' বলেন ভায়েজ। তার মতে, শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের শর্তে চুক্তিতে রাজি হওয়া ইরানের কাছে আত্মসমর্পণের সমান, যা তারা ইসরায়েলি হামলার চেয়েও ভয়ঙ্কর মনে করে।
এদিকে, সিএনএন জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি নতুন গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছে, যাতে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে—যদিও ট্রাম্প প্রশাসন এখনো কূটনৈতিক পথে সমঝোতা চাচ্ছে।
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক পরিচালক সানাম ভাকিল বলেন, যুদ্ধের হুমকি বরং ইরানকে আরও কঠোর করে তুলবে। 'আলোচনায় গতি ফেরাতে হলে পর্দার আড়ালে নীরব কূটনীতি চালানোই কার্যকর হবে।'
যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি সিএনএনকে বলেন, 'সার্বভৌম কোনো রাষ্ট্র যদি নিজেদের অস্তিত্বের হুমকি মনে করে আত্মরক্ষায় পদক্ষেপ নেয়, যুক্তরাষ্ট্র তার বিরোধিতা করবে না।'
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েল হামলা চালালে তা কেবল আলোচনার সমাপ্তিই ডেকে আনবে না, বরং ইরান পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি থেকেও সরে দাঁড়াতে পারে।
কুইন্সি ইনস্টিটিউটের নির্বাহী সহসভাপতি ত্রিতা পারসি বলেন, 'পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ জোর করে চাপিয়ে দিয়ে— ট্রাম্প প্রশাসন নিজেই নিজেদের কূটনৈতিক চক্রে বন্দি করেছে।' তিনি মনে করেন, ইরান এসব হামলার হুমকি খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। তবে এসব হুমকি বাস্তবে পরিণত হলে ইরানের পক্ষ থেকে 'ব্যাপক প্রতিশোধ' আসবে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
'ইসরায়েল কিছু করলেও তা ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংসের জন্য নয়, বরং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ভেস্তে দিতেই করবে,' বলেন পারসি।
সিএনএন থেকে অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা