গনোরিয়া প্রতিরোধে বিশ্বের প্রথম টিকা কর্মসূচি চালু হচ্ছে ইংল্যান্ডে

বিশ্বে প্রথমবারের মতো গনোরিয়া প্রতিরোধে টিকা কার্যক্রম চালু হতে যাচ্ছে ইংল্যান্ডে—এ উদ্যোগকে যৌনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি 'মাইলফলক মুহূর্ত' হিসেবে বর্ণনা করেছে সেখানকার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
এই পদক্ষেপের লক্ষ্য হচ্ছে যৌনবাহিত সংক্রমণ (এসটিআই) গনোরিয়ার ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ রোধ করা। ২০২৩ সালে ইংল্যান্ডে গনোরিয়ার সংক্রমণ ৮৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, যা ১৯১৮ সালে এ রোগের রেকর্ড সংরক্ষণ শুরুর পর সর্বোচ্চ। আরও উদ্বেগজনকভাবে, এই রোগের কিছু ধরন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী-ও হয়ে উঠছে।
এই অবস্থায়, টিকা কর্মসূচির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই টিকা আসলে নতুন নয়—এর নাম 4CMenB, যা মেনিনজোকক্কাল 'বি' রোগ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি গুরুতর ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, যা মেনিনজাইটিস এবং সেপসিস ঘটাতে পারে। এই টিকাটি বর্তমানে ইংল্যান্ডে শিশুদের নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচিতে রয়েছে। ৮ সপ্তাহ, ১৬ সপ্তাহ ও এক বছর বয়সি শিশুদের এটি দেওয়া হয়।
তবে এবার পাবেন প্রাপ্তবয়স্করাও। এনএইচএস ইংল্যান্ডের প্রাইমারি কেয়ার ও কমিউনিটি সার্ভিসেসের জাতীয় পরিচালক ড. আমান্ডা ডয়েল বলেন, "গনোরিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বের প্রথম নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি যৌনস্বাস্থ্য উন্নয়নে একটি বিশাল অগ্রগতি। এটি সংক্রমণ ছড়ানো রোধে, ব্যক্তিকে সুরক্ষা দিতে এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী গনোরিয়া কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।"
আগামী ১ আগস্ট থেকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে পরিচালিত যৌনস্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোতে এই টিকা দেওয়া শুরু হবে। টিকাপ্রদানের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে— শিগগিরই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টে 'এমপক্স', 'এইচপিভি' এবং হেপাটাইটিস এ ও বি' এর টিকা নেওয়ারও প্রস্তাব করা হবে।
ড. ডয়েল আরও বলেন, "এখন সারা দেশের এনএইচএস দলগুলো কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর উদ্দেশ্যে– রুটিন এমপক্স টিকাদান কর্মসূচির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা যেন কার্যক্রম শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপক সাড়া দিতে পারি।"
গনোরিয়া যুক্তরাজ্যে দ্বিতীয় সর্বাধিক সাধারণ ব্যাকটেরিয়াজনিত এসটিআই সংক্রমণ।
এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে সবুজ বা হলুদ স্রাব, প্রস্রাবের সময় জ্বালা, এবং মলদ্বারে ব্যথা বা অস্বস্তি। নারীদের ক্ষেত্রে পেটের নিচের অংশে ব্যথা বা মাসিকের মাঝখানে রক্তপাতও দেখা দিতে পারে। তবে অনেকে কোনও লক্ষণ ছাড়াই আক্রান্ত হন।
এই টিকাটিতে রয়েছে 'নেইসেরিয়া মেনিনজাইটিডিস' নামক ব্যাকটেরিয়ার প্রোটিন, যা 'নেইসেরিয়া গনোরিয়া' সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার ঘনিষ্ঠ জেনেটিক আত্মীয়।
যুক্তরাজ্যের যৌথ টিকাদান ও রোগ প্রতিরোধ কমিটির (জেসিভিআই) গবেষণা অনুযায়ী, 4CMenB টিকার গনোরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকারিতা ৩২.৭% থেকে ৪২%। এটি সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটা কমালেও সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করতে পারবে না।
তবে জেসিভিআই জানায়, আগে গনোরিয়া সংক্রমণের শিকার হয়ে কেউ সুস্থতা লাভ করলেও, এতে রোগটির বিরুদ্ধে তার দেহে স্থায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে না। অর্থাৎ তা ভবিষ্যতের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয় না বলেই টিকা দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে।
এই কর্মসূচি এমন এক সময়ে চালু হচ্ছে, যখন ইংল্যান্ডে অ্যান্টিবায়োটিক 'সেফট্রিয়াক্সোন'-এর প্রতিরোধী গনোরিয়ার সংখ্যা বাড়ছে। অর্থাৎ এই ব্যাকটেরিয়া এখন এমনকি অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতেও টিকে থাকতে ও বাড়তে পারছে।
কিছু সংক্রমণকে 'অতিমাত্রায় ওষুধ প্রতিরোধী' বা এক্সডিআর হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে—যেখানে সেফট্রিয়াক্সোন ও বিকল্প দ্বিতীয় সারির চিকিৎসাও ব্যর্থ হয়েছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংস্থা- ইউকেএইচএসএ জানিয়েছে, সেফট্রিয়াক্সোন-প্রতিরোধী গনোরিয়ার ১৭টি এবং এক্সডিআর গনোরিয়ার ৯টি ঘটনা ধরা পড়েছে—যেখানে এক বছর আগে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৫টি।
ইউকেএইচএসএ- এর ডেপুটি ডিরেক্টর এবং পরামর্শক মহামারিবিদ ড. সিমা ম্যান্ডাল বলেন, "এই টিকা কার্যক্রম শুধুমাত্র সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের সুরক্ষাই দেবে না, বরং যুক্তরাজ্যকে গনোরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধে বিশ্বের প্রথম দেশ ও অগ্রণী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।"
দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী অ্যাশলি ডাল্টন জনগণকে এই টিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, "এটি শুধুমাত্র একে অপরকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয় নয়, বরং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ঝুঁকি মোকাবিলায়ও সহায়তা করবে।"
তিনি আরও বলেন, "যাদের ঝুঁকি বেশি, তাদের লক্ষ্য করে টিকাদান কার্যক্রম চালানো হলে সংক্রমণের হার কমবে এবং আগামী কয়েক বছরে হাজার হাজার সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।"