বিলাসবহুল বিমান, হাতি, জিরাফ, পান্ডা...কূটনৈতিক উপহারের ইতিহাস

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য কাতার রাজপরিবারের 'আকাশের প্রাসাদ' খ্যাত ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বিলাসবহুল বিমান উপহার দেওয়ার প্রস্তাবটা যতটা আকর্ষণীয়, ততটাই রাজনৈতিক। কূটনৈতিক উপহার দেওয়া-নেওয়ার প্রথা কিন্তু নতুন নয়, ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকেই এমন প্রথা দেখা গেছে।
প্রাচীন মিশরে এমন রেওয়াজের নজির মেলে। মিশর, মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া ও সাইপ্রাসের রাজারা একে অপরকে দামি উপহার পাঠাতেন। রাজপরিবারের বিয়ে, যুদ্ধজয় বা বন্ধুত্বের বার্তায় পাঠানো হতো এসব উপহার। উপহারে থাকতে হতো রাজকীয় চাকচিক্য। লক্ষ্য ছিল একটাই—প্রতিপত্তি দেখানো। উপহার হতো যতটা জমকালো, ততটাই কূটনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
তবে উপহারের বিনিময়ে পাল্টা উপহারও আশা করা হতো। রাজা উপহার পাঠালে ফিরতি উপহার হতে হতো আরও বড়, আরও ব্যতিক্রম। এটাও ছিল একধরনের প্রতিযোগিতা। এই ঐতিহ্য এখনও টিকে আছে। রূপটা বদলেছে, নীতিটা নয়। যেমন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেওয়া সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের আতিথেয়তা। ট্রাম্প যদি হঠাৎ বিগ ম্যাক বার্গার চান? চিন্তার কিছু নেই। প্রস্তুত রাখা হয়েছিল ভ্রাম্যমান ম্যাকডোনাল্ডস, একটি ট্রাকেই সাজানো হয় এই রেস্তোরাঁ।
খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ থেকে ১০৭০—এই দীর্ঘ পাঁচ শতক ছিল মিশরের ইতিহাসে নিউ কিংডম যুগ। সে সময় মিশর শুধু সমৃদ্ধই হয়নি, পরিণত হয়েছিল এক অন্যতম রাজকীয় শক্তিতে। খাদ্যের উদ্বৃত্ত ছিল, বাণিজ্য চলত দারুণ, আর পাশের অনেক এলাকা মিশরের করদাতা হয়ে গিয়েছিল। এই সময় ফারাওরা কেবল যুদ্ধ জিততেন না, পুরস্কার দিতেও ছিলেন ওস্তাদ। যারা তাদের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন বা যুদ্ধে জয় এনে দিতেন, তাদের সোনাদানায় দিয়ে ভরিয়ে দিতেন রাজকীয় ভঙ্গিতে।
একজন ছিলেন ইওয়াই, পদবিতে তিনি ছিলেন 'রাজা-ডান-পাশের-পাখা-ধারক'। তাকে ও তার স্ত্রীকে ডাকা হয়েছিল এক বিশেষ অনুষ্ঠান 'গোল্ড-বেস্টোয়াল' বা সোনা-বিতরণ উৎসবে। ইওয়াই আর তার স্ত্রী এত সোনার গয়না আর উপহার পেয়েছিলেন যে তা বহন করে হাঁটতেই পারছিলেন না। ফারাও আখেনাতেন ও রানি নেফারতিতি রাজপ্রাসাদের বারান্দা থেকে নিজ হাতে ছুড়ে দিচ্ছিলেন সোনার অলঙ্কার। প্রিয় ব্যক্তিবর্গ ও বিশ্বস্ত রাজ সহযোগীদের মাঝে এভাবে সোনা বিতরণ মূলত রাজপরিবারের ধনসম্পদ আর প্রতিপত্তির প্রদর্শনী ছিল।
তবে এই সোনাবৃষ্টি একমুখী ছিল না। উপহারের বদলে পাল্টা উপহারও চাইতেন ফারাওরা; আর তা হতে হতো চোখধাঁধানো। রাজা দ্বিতীয় আমেনহোতেপের আমলে এক উচ্চপদস্থ কর্মচারীর কবরের স্তম্ভ থেকে পাওয়া তালিকা তার প্রমাণ। তিনি ফারাওকে ফিরতি উপহার দিয়েছিলেন—রুপা-সোনার তৈরি রথ, আবলুস কাঠ ও হাতির দাঁতের মূর্তি, অজস্র গহনা, এমনকি শিল্পকর্ম। আরও ছিল দুটি বিশাল হাতির দাঁতের তৈরি হরিণ, যাদের মুখে ছিল ফুল। এছাড়া ছিল বিশাল অস্ত্রভান্ডার—৩০টি রুপা-সোনায় মোড়ানো আবলুস কাঠের লাঠি, ৩৬০টি বাঁকা ব্রোঞ্জের তলোয়ার, ২২০টি হাতির দাঁতের হাতল, আর ৬৮০টি বিরল প্রাণীর চামড়ায় তৈরি ঢাল।

রাজনৈতিক উপহারের ইতিহাসে আরেক চমকপ্রদ উপহার ছিল জীবন্ত প্রাণী। মিশরের বিখ্যাত যোদ্ধা রাজা তৃয় তুতমোস (খ্রিস্টপূর্ব ১৪৭৯-১৪২৫) বিদেশ অভিযানে গেলেই সংগ্রহ করতেন অজানা উদ্ভিদ আর প্রাণী। তাকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল বিশাল এক হাতি, লম্বা গলার একটি জিরাফ এবং এমন কিছু পাখি, যাদের সম্পর্কে বলা হতো 'প্রতিদিন ডিম দেয়'। গবেষকরা মনে করেন, এগুলো সম্ভবত মুরগি যা তখন মিশরে দুর্লভ ছিল।
তখন রাজকীয় উপহারের মূলমন্ত্র ছিল অদ্ভুত বা বিরল হতে হবে। প্রাকৃতিক হোক কিংবা মানুষের বানানো, উপহারে চমক থাকতে হবে। ১০ম শতকে বাগদাদের সামারার রাজপ্রাসাদে আব্বাসীয় খলিফা আল-মুতাসিমের আমন্ত্রণে এসে বিস্মিত হয়েছিলেন বাইজ্যান্টিন সম্রাটের দূতেরা। তারা দেখেন, ধাতু দিয়ে বানানো যান্ত্রিক পাখি। এতটাই উন্নত ছিল তখন আরবদের তখনকার প্রযুক্তি ।
১১ শতকে ইসলামি শাসনের প্রভাব ও সম্পদের দ্রুত বিস্তার খেয়াল করেছিলেন বাইজ্যান্টিয়ামের খ্রিস্টান শাসকরা। তাই মিশরের ফাতেমি খলিফাদের প্রতি ছিল তাদের উদার মনোভাব। 'দ্য বুক অভ ট্রেজারস অ্যান্ড গিফটস'-এ (১০৬২) লিপিবদ্ধ আছে প্রায় ৪১৪টি উপহারের বিবরণ—যেগুলো থেকে বোঝা যায়, উপহার পাঠাতে তারা যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। যেমন দুর্লভ রত্নপাথরখচিত পাত্র। এই পাত্রগুলো আবার উপহার দেওয়া হতো হাতির দাঁত বা দামি কাঠে খোদাই করা বাক্সে, যা নিজেই ছিল একেকটি শিল্পকর্ম। এ ধরনের উপহার শুধু উপহার ছিল না, ছিল রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রতীক। লোকদেখানো প্রদর্শনীর মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করত।
চীনের রাজদরবারেও উপহার ছিল মর্যাদার চিহ্ন। ১৪০০-এর দশকে প্রথম জিরাফ যখন চীনা সম্রাটের কাছে আসে, তিনি একে বলেন 'সৌভাগ্যের প্রতীক'। তার চোখে এই প্রাণীর অদ্ভুত রূপ ছিল তার প্রতিপত্তির সংকেত।

১৮ শতকের শেষ দিকে, বিপ্লব চলাকালীন ফ্রান্সে এর ঠিক উল্টো এক দৃশ্য ছিল। ফরাসি জনগণ মজা পেত রাজাদের সংগ্রহ থেকে বাজেয়াপ্ত করা পশু প্রদর্শনীতে। আফ্রিকার সিংহ, সুইজারল্যান্ডের বাদামি ভালুক—সবকিছুকে খাঁচায় ভরে প্যারিসের রাস্তায় ঘোরানো হতো, যেন একধরনের বিজয় উৎসব।
১৯৫৭ সালে মাও সে তুং পিংপিং ও ঝিঝি নামে দুটি পান্ডা পাঠান মস্কোতে। উদ্দেশ্য ছিল অক্টোবর বিপ্লবের ৪০ বছর পূর্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অভিনন্দন জানানো এবং প্রথম বিশ্বশক্তি হিসেবে পিপলস রিপাবলিক অভ চায়নাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। বর্তমানে চীন কৌশল পাল্টেছে। এখন যারা ভালো বাণিজ্য অংশীদার, তাদের পান্ডা ইজারা দেওয়া হয়। তবে শর্তসহ। চুক্তির টাকাগুলো যায় সংরক্ষণ তহবিলে। বাণিজ্যিক সম্পর্ক খারাপ হলে পান্ডা ফিরে আসে। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা 'ইয়া ইয়া' নামে এক পান্ডাকে ফেরত নেওয়া হয় ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে। কারণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে অবনতি।
কূটনৈতিক উপহার কখনোই নিছক সৌজন্য ছিল না। উড়ন্ত প্রাসাদ, মুকুটধারী পোপ আর সামরিক কুচকাওয়াজে মাতোয়ারা প্রেসিডেন্ট—সবকিছু মিলিয়ে আজকের কূটনীতি যেন ব্রোঞ্জ যুগেরই আধুনিক সংস্করণ।
- অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা