ইউরোপীয় মিত্রদের উপেক্ষা করেই ইউক্রেনের সঙ্গে পুতিনের আলোচনার প্রস্তাবে সমর্থন ট্রাম্পের

ইউক্রেনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আহ্বানকে সমর্থন জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ করার ২৪ ঘণ্টা শেষ হওয়ার আগেই গতকাল রোববার এ ঘোষণা দেন।
এর আগে গত শনিবার যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি এবং পোল্যান্ডের নেতারা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করেন এবং পুতিনকে সোমবার থেকে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি দিতে রাজি হতে বলেন। অন্যথায়, রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তারা।
ইউরোপীয় নেতারা জানান, ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাদের এ দাবির সঙ্গে একমত। ট্রাম্পের রাশিয়া ও ইউক্রেন বিষয়ক প্রতিনিধি একটি ছবি পোস্ট করেন, সেখানে ইউরোপীয় নেতাদের ট্রাম্পকে আলোচনা করতে দেখা যায়। তিনি বলেন, এটি ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করার প্রথম ধাপ হতে যাচ্ছে।
পুতিন এর জবাবে বৃহস্পতিবার থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সরাসরি আলোচনা শুরু করার প্রস্তাব দেন। এ বিষয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, তিনি সরাসরি আলোচনায় রাজি আছেন—তবে সেটা যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ার পরই তিনি আলোচনায় বসবেন।
রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'ট্রুথ সোশ্যাল'-এ দেওয়া এক বার্তায় ট্রাম্প রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। তিনি লেখেন, 'ইউক্রেনকে পুতিনের প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে মেনে নেওয়া উচিত।' ট্রাম্প আরও লেখেন, 'কমপক্ষে এতে করে জানা যাবে, কোনও সমঝোতা আদৌ সম্ভব কি না। আর যদি না-ও হয়, তাহলে ইউরোপীয় নেতারা ও যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারবে পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়িয়ে আছে এবং সেই অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারবে।'
ট্রাম্পের বক্তব্যের কিছুক্ষণ পরই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, কিয়েভ এখনো যুদ্ধবিরতির প্রত্যাশা করছে, তবে বৃহস্পতিবার পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তিনি প্রস্তুত।
তবে ট্রাম্পের এই মন্তব্য ইউরোপীয় দেশগুলো ও ইউক্রেনের রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ এবং জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎর্স এরপর রবিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একই ধরনের বার্তা দিয়ে আবারও স্পষ্ট করে বলেন—যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আগে রাশিয়ার সঙ্গে কোনও আলোচনা হবে না।
ম্যাখোঁ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লিখেছেন, 'কিয়েভে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আমরা একটি পরিষ্কার প্রস্তাব দিয়েছিলাম—সোমবার থেকে শর্তহীন ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি। অস্ত্র চলতে থাকলে কোনও আলোচনা হতে পারে না। যখন সাধারণ মানুষ বোমায় নিহত হচ্ছেন, তখন কোনো সংলাপ সম্ভব নয়। এখনই যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন, যেন শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথ খোলা যায়।'
জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎর্স এক্স-এ বলেন, 'রাশিয়া এখন আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করছে—এটি একটি ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু এটা মোটেও যথেষ্ট নয়।'
ইউরোপীয় নেতারা আরও বলেন, 'আমরা এখন মস্কোর কাছ থেকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি আশা করছি। সত্যিকারের সংলাপ শুরু করার আগে এটি অত্যন্ত জরুরি। অস্ত্র না থামা পর্যন্ত কোনও আলোচনা শুরু হতে পারে না।'
তবে ট্রাম্পের পোস্টে মনে হয়েছে, এমনকি তার নিজস্ব প্রতিনিধি পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে হতবাক হয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল কিথ কেলোগ রোববার সকালেও শনিবারের যুদ্ধবিরতির ঘোষণাকে সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি ম্যাখোঁ ও নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টোফার লুকসনের একই ধরনের পোস্ট রিটুইট করেন।
এতে কেলোগ মন্তব্য করেন, 'নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টি বুঝতে পারছেন।' তিনি আরও লেখেন, 'প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বহুবার বলেছেন—হত্যা বন্ধ করুন!! প্রথমে শর্তহীন ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি এবং এই সময়ের মধ্যেই একটি পূর্ণাঙ্গ শান্তি আলোচনায় প্রবেশ করতে হবে। এর বিপরীতে কিছুই হবে না।'
জেলেনস্কি ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা যুদ্ধবিরতির দাবিকে পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করার কৌশল হিসেবে তুলে ধরেছেন। কারণ, ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে কয়েক মাস ধরে চলা আলোচনায় কোনো ফল আসেনি।
রোববার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান জানান, তিনি পুতিনের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং আলোচনার জন্য স্বাগতিক হতে প্রস্তুত আছেন। এরদোয়ান একে 'যুদ্ধ শেষের পথে একটি ঐতিহাসিক মোড়' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তবে এরদোয়ান ইউরোপীয় নেতাদের অবস্থানকেই সমর্থন করেছেন বলে মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন, একটি যুদ্ধবিরতি গঠনমূলক আলোচনার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
জেলেনস্কি ও পুতিনের মধ্যে যদি বৈঠক হয়, সেটি হবে ২০২২ সালে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার হামলার নির্দেশ দেওয়ার পর প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ। তবে পুতিন নিজে এই বৈঠকে অংশ নেবেন কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই জেলেনস্কিকে একটি নাৎসি-ভাবাপন্ন অবৈধ সরকারের প্রেসিডেন্ট বলে অভিহিত করে আসছেন।
তবে পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় রাজি হয়ে জেলেনস্কি মূলত তার (পুতিনের) কথার সত্যতা যাচাইয়ের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন।