কমিউনিটি কিচেনে ‘দুই সপ্তাহের রসদও নেই’, ইসরায়েলি অবরোধে গাজায় খাদ্য সংকট চরমে

গাজা উপত্যকায় এখন এক বেলার গরম খাবারও যেন বিলাসিতা। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলে ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য রান্না করা এক হাঁড়ি 'কোশারি'—ডাল, চাল আর টক টমেটোর সস দিয়ে তৈরি মিশ্র খাবার—শিগগিরই এক গাধার পিঠে চড়ে পৌঁছাবে ক্ষুধার্ত মানুষদের কাছে।
এই খাবার রান্না হচ্ছে আমেরিকান নিয়ার ইস্ট রিফিউজি এইড (আনেরা) নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবিক সংগঠনের পরিচালিত দুটি কমিউনিটি কিচেনের একটিতে।
সংস্থাটির গাজাভিত্তিক প্রধান সামি মাতার বলেন, 'মানুষ এখন একমাত্র আমাদের রান্নাঘরের ওপর নির্ভর করে। বাজারে যা সামান্য আছে, তা কেনার মত টাকাও নেই তাদের। আগে আমরা চাল-গোশতের খাবার রান্না করতাম, কিন্তু এখন কোনো ধরনের মাংস তো দূরের কথা, টাটকা শাকসবজিও নেই।'
দুই মাস আগে ইসরায়েল গাজার সব সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধসহ সব ধরনের পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপরই ফের শুরু হয় সামরিক অভিযান। ইসরায়েলের দাবি, হামাসের হাতে জিম্মি থাকা ব্যক্তিদের মুক্ত করতে চাপ তৈরি করতেই তারা এই পদক্ষেপ নেয়।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থা সম্প্রতি জানায়, তাদের খাদ্য মজুত পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে।

অবস্থার ভয়াবহতা বাড়তে থাকায় আন্তর্জাতিক মহলের চাপও বাড়ছে। জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার বলেন, 'মানবিক সহায়তা কখনোই দর-কষাকষির হাতিয়ার হতে পারে না। খাদ্য রোধ করে মানুষকে উপোস রাখা, চিকিৎসা বঞ্চিত করা, তাদের মর্যাদা কেড়ে নেওয়া—এসব নির্মম সামষ্টিক শাস্তি, যা মানুষের জীবন কেড়ে নেয়।'
গাজার কয়েকটি অবশিষ্ট কমিউনিটি কিচেন এখন লাখো মানুষের একমাত্র ভরসা। খান ইউনুসে আনেরার রান্নাঘরে প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার মানুষের জন্য রান্না হয়। কিন্তু যদি গাজায় অবরোধ না উঠে, তবে এই আশ্রয়স্থলও অচিরেই শুকিয়ে যাবে।
মাতার বলেন, 'আমাদের মজুতে যা আছে, তাতে হয়তো আর দুই সপ্তাহ চলবে, তার বেশি নয়।' বিশাল অথচ প্রায় খালি হয়ে পড়া গুদাম ঘর দেখাতে দেখাতে তিনি বলেন, 'একসময় প্রতি সপ্তাহে শতাধিক ট্রাক আসত। এখন কিছুই নেই।'
'চাল, ডাল, পাস্তা, রান্নার তেল, লবণ—এসব জোগাড় করাই কষ্টসাধ্য। জ্বালানি হিসেবে কাঠ কিনতে হয়—প্রতিদিন ৭০০ কেজি কাঠ দরকার আমাদের রান্নার জন্য।'
ইসরায়েলের অভিযোগ, হামাস এই সহায়তা চুরি করে নিজেদের যোদ্ধাদের দেয় বা বিক্রি করে অর্থ জোগাড় করে। তবে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থাগুলো তা অস্বীকার করেছে। আনেরাও তাদের বিতরণ পদ্ধতি 'নির্ভরযোগ্য ও স্বচ্ছ' বলে দাবি করছে।
মাতার বলেন, 'আমাদের কাছে লক্ষাধিক মানুষের ডেটাবেইজ আছে, যেখানে নাম, পরিচয়পত্র নম্বর ও ঠিকানাসহ সব তথ্য সংরক্ষিত আছে। এই প্রক্রিয়া অন্য সংস্থার সঙ্গে কাজের পুনরাবৃত্তি রোধ করে এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে।'
আবার রান্নাঘরে ফিরে দেখা যায়, এক হাঁড়ি কোশারি পরীক্ষা করছেন মাতার। খাবার ঠান্ডা হওয়ার আগেই প্যাকেট বানিয়ে পাঠানো হচ্ছে বিতরণের জন্য—প্রত্যেকটি প্যাকেটে চারজনের খাবার থাকে।
যারা এখানে কাজ করেন, তারাও এই খাবার নিজের পরিবারে নিয়ে যান। বাকি খাবার ওঠানো হয় গাধার পিঠে। গন্তব্য: উপকূলের অস্থায়ী ক্যাম্প 'আল-মাওয়াসি'। সেখানে অসংখ্য মানুষ দীর্ঘসময় ধরে অপেক্ষা করছেন এক প্যাকেট খাবারের আশায়।
এক বৃদ্ধ, যিনি ক্রাচে ভর করে হাঁটেন, কাঁপা হাতে কোশারির দুটি প্যাকেট জড়িয়ে ধরে বলেন, 'আল্লাহর শুকরিয়া, এতেই হবে। সকাল থেকে একটা রুটির খোঁজে ঘুরেছি—কিছুই পাইনি।'
আরেক নারী বলেন, 'এই সময়ের জন্য এটা দারুণ খাবার। কারণ, আমাদের রান্না করার গ্যাস নেই, খাবার নেই। এক কাপ চা খেতেও গাছের শুকনো পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালাতে হয়।'
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হয়েছে দেড় বছরেরও বেশি সময় আগে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের হামলায় প্রায় ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২৫০ জনের বেশি জিম্মি হন। এখনও অন্তত ৫৯ জন জিম্মি রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।

হামাস-চালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এ পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় গাজায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫২ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। ৯০ শতাংশ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন—অনেকে বারবার ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
জাতিসংঘ বলছে, অবরোধ, সামরিক অভিযান এবং মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে নতুন করে জারি হওয়া উচ্ছেদ আদেশের কারণে গাজায় পরিস্থিতি 'সবচেয়ে ভয়াবহ পর্যায়ে' পৌঁছেছে।
এর মধ্যেই জাতিসংঘ মনে করিয়ে দিয়েছে, একটি দখলদার শক্তি হিসেবে গাজায় মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করার আন্তর্জাতিক দায়িত্ব রয়েছে ইসরায়েলের।
গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে বলেছেন, 'গাজার প্রতি আমাদের সদয় হতে হবে' এবং তিনি গাজায় আরও বেশি পরিমাণে খাবার ও ওষুধ প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন।
তবে তার এই বক্তব্যের কোনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ইসরায়েল থেকে আসেনি। যদিও তার আগেই যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির যৌথ বিবৃতিতে গাজা অবরোধকে 'অসহনীয়' বলা হয় এবং তা অবসানের আহ্বান জানানো হয়। এর জবাবে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, যুদ্ধবিরতির সময় গাজায় ২৫ হাজারের বেশি ট্রাকের মাধ্যমে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টন পণ্য প্রবেশ করেছে। তারা আরও দাবি করে, 'মাঠপর্যায়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে ইসরায়েল, এবং কোনও ত্রাণ সংকট নেই।'

তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সীমান্তে সহায়তা বোঝাই ট্রাকগুলো আটকে আছে আর গাজার অভ্যন্তরে মানবিক কর্মীরা বাকি মজুদের হিসাব করে দিন কাটাচ্ছেন।
আল-মাওয়াসি ক্যাম্পে খাবার বিতরণ চলার সময় শিশুরা ঘিরে ধরে সামি মাতার ও তার সহকর্মীদের। তাদের অনেকেই কঙ্কালসার, মুখে অপুষ্টির ছাপ স্পষ্ট।
মাতার বলেন, 'যদি আমাদের খাবার শেষ হয়ে যায়, আমরা কী করব জানি না। এই সহায়তা বন্ধ করতে হলে আমাদের জন্য মানসিকভাবে ভয়াবহ চাপ হবে।'
তিনি আবার আবেদন জানিয়ে বলেন, 'আমাদের দিকে তাকান, আমাদের মরিয়া চাহনি দেখুন। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। অনুগ্রহ করে সীমান্ত খুলে দিন।'