ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের আশঙ্কায় উত্তেজনা কমাতে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র

ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য সংঘাত ঠেকাতে দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) ওয়াশিংটনে এক ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও শিগগিরই ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলবেন। একই সাথে তিনি বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোকেও আলোচনায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
ট্যামি ব্রুস বলেন, 'আমরা সব পক্ষকে দায়িত্বশীল সমাধানের জন্য একসঙ্গে কাজ করতে উৎসাহিত করছি। বিশ্ব পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে।'
পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশের সম্পর্ক কাশ্মীর হামলার পর দ্রুত অবনতি ঘটেছে। ভারত একে সন্ত্রাসী হামলা বলে অভিহিত করে পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলেছে এবং হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান এ অভিযোগ অস্বীকার করে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ভারত সামরিক পদক্ষেপ নিলে তারা সেটির জবাব দেবে।
মঙ্গলবার ইকোনমিক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক বৈঠকে সেনাবাহিনীকে হামলার জবাবে সময়, লক্ষ্য এবং পদ্ধতি নির্ধারণে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। ওই বৈঠকে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল উপস্থিত ছিলেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি।
বুধবার রাত ১২টার পর টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার দাবি করেন, তাদের কাছে 'বিশ্বস্ত গোয়েন্দা তথ্য' রয়েছে যে, আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ভারত সামরিক অভিযান চালাতে পারে। তিনি বলেন, পাকিস্তান 'নিশ্চিত ও কঠোর' জবাব দেবে।
আতাউল্লাহ বলেন, 'আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সচেতন থাকতে হবে যে, যেকোনো উত্তেজনার দায়ভার সম্পূর্ণভাবে ভারতের ওপরই বর্তাবে। পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় জাতি সর্বোচ্চ মূল্য দিতে প্রস্তুত।'
এদিকে, মঙ্গলবার পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন দাবি করেছে, কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে আসা একটি ভারতীয় গুপ্তচর ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। তবে সীমান্ত এলাকায় নজরদারির জন্য উভয় দেশই অতীতে একাধিকবার একে অপরের ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
কাশ্মীরে উত্তেজনা বাড়ছে
মঙ্গলবার সকালে ভারতীয় সেনাবাহিনী অভিযোগ করে, পাকিস্তান লাগাতার পঞ্চম দিনের মতো নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে গুলি চালিয়েছে। সেনাবাহিনীর দাবি, তারা 'বিনা উসকানিতে হালকা অস্ত্র দিয়ে চালানো গুলির' গুলির জবাবে 'পরিমিত' কিন্তু 'কার্যকর' প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
২২ এপ্রিলের হামলার পর ভারত প্রতিবেশী পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক কমানো ও সিন্দু পানি চুক্তি স্থগিত করার মতো ব্যবস্থা নেয়। জবাবে পাকিস্তান ইসলামাবাদে ভারতীয় কূটনীতিকদের বহিষ্কার করে, নিজেদের আকাশসীমা ভারতীয় মালিকানাধীন ও পরিচালিত উড়োজাহাজের জন্য বন্ধ করে দেয় এবং দুই দেশের মধ্যে সীমিত বাণিজ্যও স্থগিত করে।
তবে এই উত্তেজনার তেমন প্রভাব এখনো বাজারে পড়েনি। মঙ্গলবার ভারতের শেয়ারবাজার স্থিতিশীল ছিল এবং রুপির মান সামান্য দুর্বল হয়। পাকিস্তানি রুপির মানও প্রায় অপরিবর্তিত ছিল (প্রতি ডলার ২৮১ রুপি)।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ এ সপ্তাহে যুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দেননি। তবে বলেন, তা এড়ানো সম্ভব। তিনি জানান, চীন, সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলো সংঘর্ষ ঠেকাতে কাজ করছে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী বলেন, কাশ্মীর হামলায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার বিষয়ে ভারত এখনো পর্যন্ত কোনো 'প্রমাণ' দেখাতে পারেনি। দুই প্রতিবেশী বহু বছর ধরেই একে অপরের বিরুদ্ধে সীমান্তপারের সন্ত্রাসে সহায়তার অভিযোগ করে আসছে। এটাই তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা ও কাশ্মীর সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে বড় বাধা।
২০০৩ সালে দুই দেশ যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছালেও পরে তা বহুবার লঙ্ঘিত হয়। ২০২১ সালে নতুন করে চুক্তি মানার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর থেকে গত তিন বছর ধরে সীমান্তে গোলাগুলি অনেকটাই বন্ধ ছিল।
১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীর অঞ্চল নিয়ে কয়েকবার যুদ্ধ করেছে। সর্বশেষ দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত হয়েছিল ১৯৯৯ সালে কারগিলে। তখন পাকিস্তানি সেনারা ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করে। কয়েক মাস সংঘাত চলার পর পাকিস্তানি বাহিনী নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে সরে যায়।
সর্বশেষ বড় উত্তেজনা দেখা দেয় ২০১৯ সালে, যখন এক আত্মঘাতী হামলায় ভারতের ৪০ জন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হন। পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ ওই হামলার দায় স্বীকার করে। এর জবাবে ভারত প্রায় দুই সপ্তাহ পর পাকিস্তানের ভেতরে বিমান হামলা চালায়, যা ১৯৭১ সালের পর প্রথম।
ভারতের দাবি, ওই হামলায় এক জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করা হয় এবং প্রায় ৩০০ জঙ্গি নিহত হয়। তবে পাকিস্তান তা অস্বীকার করে এবং পরদিন এক ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করে, যা দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৫০ বছরে প্রথম সরাসরি আকাশযুদ্ধ।