যে কারণে ফোনের পরিবর্তে ই-বুক ডিভাইসে বই পড়বেন

আপনি যদি দীর্ঘ সময় ধরে ফোন বা ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তাহলে সম্ভবত মাথাব্যথা শুরু হবে। যদিও দীর্ঘক্ষণ কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে থাকলেই চোখে ক্লান্তি আসতে পারে। তবে সরাসরি উজ্জ্বল আলো চোখের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর।
এটি আপনার সার্কাডিয়ান রিদম (প্রাকৃতিক ঘুম-জাগরণ চক্র) নষ্ট করতে পারে। ফলে অনিয়মিত ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। অধিকাংশ মানুষ অন্ধকার বা ছায়াযুক্ত স্থানে পড়তে চান। আর স্মার্টফোন, ট্যাবলেট বা ল্যাপটপে ব্যবহৃত ওলেড ও এলসিডি ডিসপ্লের ব্যাকলাইট কম আলোর পরিবেশে আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
এই কারণেই বই পড়ার জন্য ই-ইঙ্ক ডিসপ্লেযুক্ত ডিভাইস ব্যবহার করা উচিত। আমাদের অন্যান্য ডিভাইসে ব্যবহৃত উজ্জ্বল ব্যাকলাইটের বিপরীতে, ই-রিডারে ব্যবহৃত ফ্রন্ট লাইট স্ক্রিনের দিকে তাকানোর সময় সরাসরি চোখে আঘাত করে না। বরং, এই স্ক্রিনগুলোতে আলোর একটি গুচ্ছ ব্যবহার করে ডিসপ্লেকে আলোকিত করা হয়। দেখে মনে হবে যেন একটি বইয়ের উপর টর্চলাইট ফেলা হয়েছে এবং লেখাগুলো আসলে আসল কালি দিয়ে তৈরি। নানা কারনেই এটি অনেক বেশি উন্নত।
প্রায় সব আলোক উৎসেই থাকা এই ব্লু লাইটের অত্যধিক এক্সপোজার ঘুমানোর সময়ে আপনার সার্কাডিয়ান রিদমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। ইমিসিভ ডিসপ্লেগুলোর মতো যেসব স্ক্রিন কোনো ফিল্টার ছাড়াই নিজের আলো উৎপন্ন করে (যেমন স্মার্টফোন ডিসপ্লে) এটি সেসব ডিসপ্লের জন্য আরও বেশি সত্য। কারণ এগুলো ডিভাইসের স্ক্রিনের নিজস্ব আলোর পাশাপাশি পরিবেশের আলোকেও প্রতিফলিত করে।
তাছাড়া, আমরা ফোন ব্যবহার করার সময় এটিকে মুখের খুব কাছেই রাখি, তাই একই সময় টিভি দেখার তুলনায় এই ব্লু লাইটের প্রভাব অনেক বেশি তীব্র। চোখের ক্লান্তির পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ব্যাকলাইটযুক্ত ডিসপ্লের ব্লু লাইটের সংস্পর্শে থাকলে চোখে দ্রুত গুরুতর চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যা ব্যাকলাইটবিহীন ডিসপ্লেগুলোর ক্ষেত্রে হয় না।
অন্যদিকে, ই-ইঙ্ক ডিসপ্লেগুলোতে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলো থাকায় পড়ার জন্য অন্য কোনো আলোর প্রয়োজন হয় না। প্রাকৃতিক আলো কম থাকলেই কেবল ফ্রন্ট লাইট প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ ই-ইঙ্ক ডিভাইসে আপনি ব্লু লাইটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ডিসপ্লের 'ওয়ার্মনেস' পরিবর্তন করতে পারেন।
যদিও এটি সরাসরি চোখের ক্লান্তি কমায় বলে প্রমাণিত নয়, তবুও কম আলোর পরিবেশে গাঢ় নীল আলোর চেয়ে এটি স্ক্রিন দেখতে আরামদায়ক করে তোলে। এছাড়া বিছানায় বই পড়ার সময় সামান্য আলো প্রয়োজন হলে ব্রাইটনেস সেটিং করে পড়া যায়।
ই-ইঙ্ক ডিসপ্লেতে ব্যবহৃত প্রতিটি 'পিক্সেল' একটি আসল কালির দানায় তৈরি। কোনো একটি পিক্সেল প্রদর্শিত হবে কি না তা নির্ধারণ করে এর নেগেটিভ বা পজিটিভ চার্জ। তাই লেখাগুলো আরও স্পষ্ট দেখায়। এমনকি ফ্রন্ট লাইটবিহীন ই-রিডারেও প্রাকৃতিক আলোক পরিবেশে স্ক্রিনের লেখা সহজেই দেখা ও পড়া যায়। অন্যদিকে ফোনের ডিসপ্লে সবসময় ব্যাকলাইটের উপর নির্ভরশীল।
তবে রঙিন ই-ইঙ্ক প্রযুক্তিতে উন্নতি হলেও ফটো বা রঙিন ইলাস্ট্রেশন যেমন, টেক্সটবুক, কমিক বই বা গ্রাফিক নভেলে থাকা ছবি ট্যাবলেট বা ল্যাপটপে পড়াই বেশি সুবিধাজনক।
স্মার্টফোনের স্ক্রিন ই-ইঙ্কের চেয়ে চোখের জন্য বেশি ক্লান্তিকর না হলেও ই-রিডারকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। স্মার্টফোনের মতো এতে অত্যাধিক নোটিফিকেশন বা টিকটক-ইউটিউবের মতো মনোযোগ বিচ্ছিন্নকারী অ্যাপ্স নেই।
অবশ্য, বুক্স পালমারের মতো অ্যান্ড্রয়েড-চালিত ই-রিডারে এসব অ্যাপ ইনস্টল করা সম্ভব। কিন্তু ই-ইঙ্ক ডিসপ্লে মোশন বা অ্যানিমেশন সহ কোনো কন্টেন্ট দেখানোর জন্য উপযুক্ত নয়। এই সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, ই-রিডার দিয়ে শুধু বই পড়ার বাইরেও অনেক কিছু করা যায়।
কিন্ডলেতে আপনি শুধু ই-বুক বা ডিভাইসে পাঠানো ডকুমেন্ট পড়তে পারবেন, কিন্তু কোবোতে পকেটের মতো 'রিড-ইট-লেটার' অপশন থেকে সেভ করা নিউজ আর্টিকেলও পড়া সম্ভব। অন্যদিকে, বুক্স পালমা বা অন্যান্য অ্যান্ড্রয়েড ই-রিডারে গুগল প্লে স্টোরের যেকোনো অ্যাপ চালানো যায়।
তাই নিউজলেটার, লংফর্ম আর্টিকেল বা চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট পড়ার জন্যও এটি দুর্দান্ত। এসব আপনি ফোনেও পড়তে পারবেন, কিন্তু ই-ইঙ্কের ঝরঝরে টেক্সটে পড়ার অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে অতুলনীয়।
এছাড়া, পাওয়ার সেটিং মুডে রেখেও এক চার্জে কোনো স্মার্টফোন সপ্তাহজুড়ে চলতে না পারলেও বেশিরভাগ ই-রিডার ডিভাইস সেটি পারে। কারন ই-ইঙ্ক ডিসপ্লে ওলেড বা এলসিডি-এর তুলনায় খুবই কম শক্তি ব্যবহার করে।
সাধারণ স্ক্রিনগুলো সবসময় ব্যাটারি ব্যবহার করে ডিসপ্লেতে আলো সরবরাহ করে, কিন্তু ই-ইঙ্ক ডিভাইস শুধু স্ক্রিনের কন্টেন্ট বদলানোর সময়ই শক্তি ব্যবহার করে। (স্ক্রিনে প্রদর্শিত কালি ব্যবহারকারী পরিবর্তন না করা পর্যন্ত স্থির থাকে)।
তবে ই-ইঙ্ক স্ক্রিনে আসল কালি ব্যবহৃত হওয়ায় এতে 'গোস্টিং' (পূর্ববর্তী পৃষ্ঠার ছায়া থাকা) হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা পড়ার সময় বিরক্তিকর হতে পারে। এদিকে কিন্ডল বা কোবোর মতো ডিভাইসে অটো রিফ্রেশ ইন্টারভাল সেট করা যায়, যেখানে প্রতিবার নতুন পৃষ্ঠা লোড করার আগে স্ক্রিন সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করা হয়। ঘন ঘন রিফ্রেশে ব্যাটারি দ্রুত শেষ হলেও এটি স্মার্টফোন ডিসপ্লের ব্যাটারির শক্তি খরচের তুলনায় বেশ নগন্য ই বলা চলে!