রোহিঙ্গা সংকটে সহানুভূতির বার্তা নিয়ে ঢাকায় আসেন পোপ ফ্রান্সিস

২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসেন ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস। তিনদিনব্যাপী এই ঐতিহাসিক সফর ছিল আন্তঃধর্মীয় সহাবস্থানের বার্তা ও মানবিকতার অনন্য উদাহরণ। তবে এই সফরের সবচেয়ে আলোচিত ও আবেগঘন মুহূর্ত ছিল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ এবং তাদের 'রোহিঙ্গা' নামে স্বীকৃতি দেওয়া।
ঢাকা পৌঁছানোর পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন পোপ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত আন্তঃধর্মীয় সভায় তিনি বলেন, 'ধর্ম যেন বিভেদের উৎস না হয়ে সংহতির মাধ্যম হয়।'
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছে এবং এটি বিশ্বে একটি চমৎকার উদাহরণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সফরের অংশ হিসেবে তিনি রাজধানীর কাকরাইলের রমনা ক্যাথেড্রাল, তেজগাঁওয়ে মাদার তেরেসা হাউজ এবং হলি রোজারিও চার্চে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে সংবেদনশীলতা
পোপের সফরের প্রেক্ষাপটেই ছিল রোহিঙ্গা সংকট। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
পোপ ফ্রান্সিস সফরের আগে মিয়ানমারেও যান এবং সে দেশের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে সেখানে 'রোহিঙ্গা' শব্দটি ব্যবহার না করায় সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
বিবিসি'র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ১ ডিসেম্বর, ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ১৬ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে দেখা করেন পোপ। তাদের কারও মাথায় হাত রেখে তিনি কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, 'আজ আমি আপনাদের কথা বলতে পারি। আপনাদের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা আপনাদের দুর্ভোগের গল্প শুনলাম। আমি দুঃখিত… আমি ক্ষমা চাই।'
এই সময়ই প্রথম তিনি 'রোহিঙ্গা' শব্দটি উচ্চারণ করেন।
মানবিক অবস্থানের প্রশংসা
পোপের এই বক্তব্য ও রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রকাশিত সহানুভূতি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানায়, মানবতার পক্ষে এই অবস্থান সময়োপযোগী এবং সাহসিকতার পরিচয়। বাংলাদেশের সরকারও তার সফরকে কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করে।
খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতি বার্তা
পোপ ফ্রান্সিস ঢাকার তেজগাঁওয়ে সেন্ট মেরি'স ক্যাথেড্রাল পরিদর্শন করেন এবং প্রায় লাখখানেক ক্যাথলিক খ্রিস্টানের উপস্থিতিতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। এই ধর্মীয় সমাবেশে তিনি বলেন, 'তোমরা সংখ্যায় অল্প হলেও বিশ্বাসে দৃঢ় হও—এই বিশ্বাস তোমাদের সহিষ্ণুতা ও ভালোবাসার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ুক।'
পোপ ফ্রান্সিসের এই সফর শুধু ধর্মীয় সফর ছিল না, বরং তা হয়ে উঠেছিল মানবতার বার্তা বহনকারী এক আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে তাঁর সফর বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক ধরনের নৈতিক সমর্থন এনে দেয়।
এছাড়া আন্তঃধর্মীয় সংলাপ, সংখ্যালঘুদের প্রতি সহানুভূতি ও শান্তির বার্তা বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির সংস্কৃতি আরও জোরদার করতে সহায়ক হয়।
পোপ ফ্রান্সিসের সফর বাংলাদেশে স্মরণীয় হয়ে থাকবে মানবতা, সংবেদনশীলতা ও আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে। একজন ধর্মগুরুর মুখে 'রোহিঙ্গা' শব্দটি উচ্চারিত হওয়া শুধু একটি প্রতীকী পদক্ষেপ ছিল না—এটি ছিল নিপীড়িত মানুষের প্রতি বিশ্ব বিবেকের সম্মান প্রদর্শনের এক সাহসী প্রয়াস।
এই সফর ছিল স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো কোনো পোপের আগমন। এর আগে ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় পোপ জন পল সফর করেছিলেন