সৌদি আরবের বিস্তীর্ণ মরুভূমি একসময় ছিল সবুজ, সমৃদ্ধ এক স্বর্গোদ্যান

সৌদি আরবের মধ্যাঞ্চলের গুহাগুলোতে পাওয়া স্ট্যালাগমাইট নিয়ে করা এক নতুন গবেষণায় জানা গেছে, এই অঞ্চল গত প্রায় ৮ মিলিয়ন বছরের মধ্যে অনেকটা সময়জুড়ে সবুজ ও উর্বর ছিল। এই ঘটনাটিকে 'গ্রিন অ্যারাবিয়া' বলা হয়, এতদিন এটি শুধু একটি অনুমান ছিল, কিন্তু এবার এর পক্ষে জোরালো প্রমাণ মিলেছে।
সম্প্রতি বিজ্ঞান সাময়িকী 'নেচার'-এ এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়।
গবেষণায় জানা গেছে, বিশ্বের যেসব মরুভূমিকে একটি ভৌগলিক 'বাধা' হিসেবে ধরা হয়—যেমন পশ্চিমে সাহারা মরুভূমি, মধ্যপ্রাচ্যের আরব মরুভূমি এবং পূর্বদিকে ভারতের থার মরুভূমি—এই পুরো অঞ্চলটি সব সময় মরুভূমি ছিল না।
কিছু সময়ে এই অঞ্চলগুলোতে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়েছিল এবং সবুজ তৃণভূমির (সাভানার) মতো পরিবেশে রূপান্তরিত হয়েছিল।
এই ধরনের অনুকূল ও বাসযোগ্য পরিবেশ আফ্রিকা থেকে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীদের বাইরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। এর ফলে হোমো স্যাপিয়েন্স (আধুনিক মানুষ) এবং আমাদের কিছু পূর্বপুরুষ, যাদের হোমিনিন বলা হয়, আফ্রিকা ছেড়ে অন্য অঞ্চলে অভিবাসন করতে পেরেছিল।
অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির হিউম্যান ইভোলিউশন গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ মাইকেল পেট্রাগলিয়া বলেন, 'এখন আমরা যেভাবে বিশাল বালুর সমুদ্র দেখে অভ্যস্ত, তা সব সময় এমন ছিল না।'
তিনি বলেন, 'এই পরিবেশগত পরিবর্তন মানুষের বিবর্তনে বিশাল প্রভাব ফেলেছে।'
বিজ্ঞানীরা কীভাবে টাইমলাইন (সময়ের ইতিহাস) নির্ণয় করেন
পেট্রাগলিয়া এই গবেষণার একজন জ্যেষ্ঠ লেখক।
তিনি ২০১০ সাল থেকে 'গ্রিন অ্যারাবিয়া'- তত্ত্ব নিয়ে কাজ করে আসছেন, মূলত এই অঞ্চলের প্রাচীন শুকিয়ে যাওয়া হ্রদগুলোর তলদেশ থেকে সংগৃহীত পলির স্তর বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি এই গবেষণা করছেন।
এই পলির স্তরগুলোর মধ্যে ছিল অতীতে সেখানে জন্মানো উদ্ভিদের চিহ্ন এবং সেই সময়কার জলবায়ুর কারণে জমে থাকা বিভিন্ন প্রকার মাটি ও খনিজের স্তর।
এসব বিশ্লেষণে জানা গেছে, আরব উপদ্বীপ—এবং সম্ভবত সাহারা ও পূর্বাঞ্চলের মরুভূমিগুলোতেও—দীর্ঘকাল ধরে আর্দ্র ও বাসযোগ্য পরিবেশ ছিল।
তবে পলির স্তরগুলো মাত্র আধা মিলিয়ন বছর বা প্রায় ৫ লাখ বছর আগের। তার আগের জলবায়ুর ইতিহাস বোঝা সম্ভব হয়নি।
কিন্তু এবার, সৌদি আরবের মধ্যাঞ্চলের গুহাগুলো থেকে সংগৃহীত নতুন জলবায়ু তথ্য ব্যবহার করে গবেষকরা গত ৮ মিলিয়ন বছর বা ৮০ লাখ বছরের জলবায়ুর ইতিহাস নির্ণয় করতে পেরেছেন। এটি একটি বিশাল অগ্রগতি।
এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এসেছে আস সুলব নামক একটি জায়গা থেকে। এটি রিয়াদের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত একটি ক্ষয়িষ্ণু চুনাপাথরের মালভূমি। ২০১৯ সালে সেখানকার সাতটি গুহা থেকে ২২টি শিলার নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
এই নমুনাগুলোর বেশিরভাগই ছিল স্ট্যালাগমাইট থেকে নেওয়া, এগুলো গুহার মেঝে থেকে উপরের দিকে বেড়ে ওঠে। খনিজ-সমৃদ্ধ পানি ধীরে ধীরে গুহার ছাদ থেকে চুইয়ে মেঝেতে পড়ে এবং ওই স্থানে সেই খনিজ জমতে জমতে স্ট্যালাগমাইট তৈরি হয়।
এই শিলাগুলো, বিশেষ করে গুহার মধ্যে গঠিত স্ট্যালাগমাইটগুলো, বহু লক্ষ বছরের জলবায়ুর প্রাকৃতিক রেকর্ড ধরে রেখেছে। এগুলো দেখে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন
কখন অঞ্চলটি ছিল আর্দ্র ও সবুজ, আর কখন শুকনো ও মরুভূমির মতো।
চাইলে আমি ব্যাখ্যা করতে পারি কীভাবে স্ট্যালাগমাইট জলবায়ুর ইতিহাস ধরে রাখে।

এই গবেষণার অন্যতম লেখক মাল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক হিউ গ্রোকাট বলেছেন, স্ট্যালাগমাইটগুলোতে প্রায়ই এমন প্রমাণ থাকে যা বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন। যেমন- সীসা, ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়াম এর চিহ্ন, যেগুলোর সাহায্যে বয়স নির্ণয় করা যায়।
ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম ডেটিং হলো একটি রেডিওঅ্যাক্টিভ পদ্ধতি, যার মাধ্যমে শিলার বয়স নির্ধারণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা নমুনায় থাকা ইউরেনিয়ামের পরিমাণ পরিমাপ করেন এবং দেখেন সেটি কতটা থোরিয়ামে রূপান্তরিত হয়েছে।
অর্থাৎ, ইউরেনিয়াম একধরনের রেডিওঅ্যাক্টিভ উপাদান, যা সময়ের সাথে সাথে ভেঙে থোরিয়ামে পরিণত হয়। বিজ্ঞানীরা এই পরিবর্তনের হারের হিসাব জানেন। তাই যদি তারা দেখেন, একটি নমুনায় কতটা ইউরেনিয়াম আছে এবং কতটা থোরিয়ামে পরিণত হয়েছে, তাহলে তারা খুব সহজেই হিসাব করতে পারেন নমুনাটি কত বছরের পুরনো
এই পদ্ধতিতে প্রায় ৬ লাখ বছর পর্যন্ত পুরনো নমুনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নির্ভুলভাবে বয়স নির্ণয় করা যায়।
ইউরেনিয়াম-সিসা ডেটিং তুলনামূলকভাবে নতুন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ইউরেনিয়াম আইসোটোপগুলোকে দীর্ঘকাল ধরে ক্ষয়প্রাপ্ত সিসার সঙ্গে তুলনা করা হয়। এই পদ্ধতিতে আরও অনেক বেশি পুরাতন, যেমন প্রায় ৭.৪৪ মিলিয়ন বছর আগের স্ট্যালাগমাইটের বয়স নির্ণয় করা যায়।
আরব অনেকাংশে উপেক্ষিত
নতুন এই জলবায়ু গবেষণার ফলাফল মাইকেল পেট্রাগলিয়ার আগের করা গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে মিলে গেছে। ওই গবেষণায় গ্রিন অ্যারাবিয়া তত্ত্বকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে।
এই তত্ত্বে বলা হয়েছে, আফ্রিকা এবং ইউরেশিয়ার (এশিয়া ও ইউরোপ) মধ্যকার মরু অঞ্চলগুলো—যার মধ্যে সাহারা এবং আরও পূর্বের মরুভূমিগুলোও অন্তর্ভুক্ত—দীর্ঘ সময় ধরে সবুজ ও উর্বর ছিল।
পেট্রাগলিয়া বলেন, অনেক সময় আদিম মানুষ ও প্রাণীরা আফ্রিকা থেকে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে অভিবাসনের পথ বর্ণনা করা চিত্র-ম্যাপগুলোতে আরব উপদ্বীপকে প্রায় উপেক্ষা করা হয়।
এই গবেষণার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চাইছেন যে, আরব উপদ্বীপও একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ ছিল, যার মাধ্যমে আফ্রিকা থেকে বিভিন্ন প্রাণী ও আদিম মানুষ ইউরেশিয়ায় অভিবাসন করেছিল।
তবে, একটি 'গ্রিন আরব' আফ্রিকা থেকে ইউরেশিয়ায় প্রাণী ও মানবজাতির অভিবাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ হতে পারে।
পেট্রাগ্লিয়া বলেন, আরব যখন আর্দ্র ছিল, সাহারা এবং অন্যান্য মরুভূমিও তখন আর্দ্র ছিল। এটি এমন এক ধরনের জলবায়ু পরিবর্তন, যা সম্ভবত পৃথিবীর কক্ষপথের (অরবিট) পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের কারণে এটি হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, 'এই আবিষ্কারগুলো অত্যন্ত চমকপ্রদ। এটি শুধুমাত্র আরব উপদ্বীপের জন্য নয়, পৃথিবীর অনেক স্থানের জন্য জলবায়ু তথ্যের একটি নতুন উৎস।'
আর্দ্র পর্যায়গুলো
নতুন গবেষণাপত্রে গত ৮ মিলিয়ন বছর ধরে আরব উপদ্বীপে ঘটা অন্তত ছয়টি আর্দ্র পর্যায়ের প্রমাণ উল্লেখ করেছে। এছাড়াও এতে সম্ভবত আরও দুটি অপ্রমাণিত আর্দ্র পর্যায়েও কথাও বলা হয়েছে।
গ্রুকাট ব্যাখ্যা করেন, স্ট্যালাগমাইটগুলোর উচ্চতা তখনই বেড়েছিল যখন পরিবেশে যথেষ্ট আর্দ্রতা ছিল। অর্থাৎ যখন মাটির মধ্য দিয়ে গুহায় পানি প্রবাহিত হতে পারত। এই আর্দ্র পরিবেশ ছিল স্ট্যালাগমাইটের বৃদ্ধির প্রধান শর্ত। এই আর্দ্র পরিবেশে পানি ও খনিজগুলো স্ট্যালাগমাইটে জমা হতো। আর সেই শিলা নমুনাগুলোর আইসোটোপগুলো বিজ্ঞানীদের গুহায় পানি প্রবাহিত হয়ে স্ট্যালাগমাইট বৃদ্ধির সময়কাল নির্ণয় করতে সাহায্য করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, আরব উপদ্বীপের আর্দ্র সময়কাল ছিল এক মিলিয়ন বছরের বেশি থেকে হাজার হাজার বছর পর্যন্ত। এই সময়কাল প্রাণী এবং আদিম মানুষের উত্তর আফ্রিকা থেকে আরব উপদ্বীপে বিচরণ করা এবং উর্বর অঞ্চলে অভিবাসনের জন্য যথেষ্ট দীর্ঘ। তবে এ বিষয়ে আরও অনেক কিছু জানা এখনও বাকি।

পেট্রাগ্লিয়া ব্যাখ্যা করেছেন, বেশ কয়েক বছর ধরে এই অঞ্চলের গুহাগুলোর ওপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা হচ্ছে। তবে এসব গবেষণার ফলাফল এখনও প্রকাশিত হয়নি।
তিনি বলেন, 'আমরা এখনও সৌদি আরবের গুহা গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি।'
গ্রুকাট জানান, ইতোমধ্যে আরব উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলের গুহাগুলো থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে অভিযান চালানো হয়েছে, যা আর্দ্র পর্যায়গুলোর ভৌগোলিক বিস্তৃতি আরও সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে সাহায্য করতে পারে।
অভিভূত
যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিওক্লিম্যাটোলজিস্ট পল উইলসন [ তিনি নতুন এই গবেষণার সঙ্গে স্পৃক্ত নন] বলেছেন, পুনর্গঠিত জলবায়ু রেকর্ড দেখে তিনি 'অভিভূত'।
তিনি জানান, এটি এখন পর্যন্ত বিদ্যমান সব রেকর্ডের চেয়ে অনেক বেশি বিশদ ও নির্ভুল।
তার নিজের গবেষণার জন্য গভীর সমুদ্রের তলদেশ থেকে সংগৃহীত নমুনা থেকে জানতে পারেন, সমুদ্রের তলদেশের মৃত্তিকায় গত ১১ মিলিয়ন বছরের মধ্যে সাহারায় কয়েকটি আর্দ্র সময়কালের ধুলাবালি অনেক কম পরিমাণে ছিল। এই আদ্র সময়গুলোর সঙ্গে পৃথিবীর সূর্যকে কেন্দ্র করে কক্ষপথের পরিবর্তনেরও মিল পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফ্রিকা নিয়ে ভালোভাবে গবেষণা করা হলেও আরবকে বেশিরভাগই উপেক্ষা করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, 'এটা আমাদের বহুদিনের ধারণার একটা দারুণ শক্তিশালী প্রমাণ।'