ট্রাম্পের শুল্ক চীনকে আবার মহান করে তুলছে!

মিত্রদের প্রতি সদাচার করুন— কিছুদিন আগে এমন বার্তা দিয়েছিলেন চীনে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত নিকোলাস বার্নস। বৈশ্বিক শক্তির প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে চীনকে হারাতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবেই একথা বলেন তিনি। এ উপদেশ আজ যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। এশিয়ায় আমেরিকাকে প্রাসঙ্গিক রাখতে চাইলে, ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও উচিৎ হবে এটিকে গুরুত্বের সাথে নেওয়া।
ট্রাম্প বাণিজ্য অংশীদারদের বিরুদ্ধে যে পাল্টা শুল্কারোপ করেছেন, তার ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত পুরো বিশ্বই। এশিয়ার প্রধান প্রধান অর্থনীতিগুলোও এই মুহূর্তে শুল্ক প্রত্যাহারের লক্ষ্যে বাণিজ্য আলোচনার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু, দীর্ঘমেয়াদে তারা পরস্পরের মধ্যেই অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে দৃঢ় করবে। এ দেশগুলো এমন পরাশক্তির দিকে ফেরার আগে এবার আরও বেশি বিচার-বিবেচনা করবে— যে কিনা তাদের ওপর শাস্তিমূলক শুল্কের বোঝা চাপায়। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের সম্প্রসারণবাদী তৎপরতা— দেশটির আকর্ষণের ছটা কিছুটা মলিন করলেও, আমেরিকার ক্ষেত্রে এই বিবেচনা এবার করবেই তারা। তাছাড়া, চীনের এহেন কর্মকাণ্ডের জেরে আঞ্চলিক যে অসন্তোষ রয়েছে, ওয়াশিংটন সেটিকে কাজে লাগানোর সুযোগই হাতছাড়া করছে।
চীনের মতো উদীয়মান বিশ্ব প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়াটাই সঙ্গত, যখন ট্রাম্প নিজেও দাবি করেন, বাণিজ্য অংশীদাররা 'আমেরিকার ক্ষতি' করেছে। কিন্তু, শুল্কের বিষয়ে তাঁর অন্য সিদ্ধান্তগুলো খুবই গোলমেলে। কারণ, কোনো দেশই বাদ পড়েনি। এমনকী অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের মতো অংশীদাররাও নয়। শুল্কের আঘাত অসন্তোষ ছড়াচ্ছে ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইনের মতো দেশেও। যাদের প্রত্যেকেই এতদঞ্চলে বেইজিংয়ের উত্থানকে মোকাবিলায় ওয়াশিংটনের জন্য কার্যকর মিত্র ছিল। ফলে আমেরিকার শুল্ক যুদ্ধ তার লক্ষ্যেরও পরিপন্থী।
এতে আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতার যে ক্ষতি হচ্ছে, তা রাতারাতি হয়তো চোখে পড়বে না। বরং, পুরো প্রভাবটা পরের কয়েক দশক ধরে অনুভব করা যাবে। এশিয়ার দেশগুলো কার সাথে বাণিজ্য করবে, কার সাথেই বা গড়বে নিরাপত্তা জোট, কার থেকে অস্ত্র কিনবে বা উন্নয়ন সহযোগিতা চাইবে, গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান করবে— এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়েই তা দেখা যাবে।
এপর্যন্ত এধরনের সম্পর্ক থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রই। নৌ পরাশক্তি হিসেবে, আমেরিকার অর্থনীতির কলেবর তর তর করে বিকশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও নৌপথ উন্মুক্ত রাখার মাধ্যমে। এটি বিশ্বের সার্বিক স্থিতিশীলতাতেও রাখে অবদান, এমনটাই উল্লেখ করেন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক স্যালি পেইন। তাঁর মতে, আমেরিকা ও তার অংশীদাররা এতে কেবল ধনীই হয়নি, বরং সামষ্টিকভাবে আরও নিরাপদ থেকেছে। এতে ইন্দো-প্যাসিফিকে কৌশলগতভাবে এগিয়ে থাকার সুবিধাটাও বজায় রাখতে পেরেছে আমেরিকা। সম্প্রতি অত্র অঞ্চলে তাঁর সফরে যেকথা স্বীকারও করেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ।
ওয়াশিংটন এগিয়ে থাকার সুবিধাটি এবার হারানোর ঝুঁকিতে আছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ২ হাজার অধিবাসীর মধ্যে আইসিইএএস-ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপের ফলাফলেও মেলে তার ইঙ্গিত। বলাবাহুল্য এ জরিপ করা হয়েছিল মার্কিন শুল্কারোপের আগে। জরিপে দেখা যায়, তাদের অধিকাংশই ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে কোন একটি পক্ষ বেঁছে নিতে বললে– আমেরিকাকেই বেঁছে নেন। দক্ষিণ চীন সাগরের মতো অঞ্চলে বেইজিংয়ের সামরিক পেশিশক্তির প্রদর্শনই তাদের চীনের ওপরে আস্থাকে হ্রাস করেছে। গত বছরের একই জরিপের যে ফলাফল ছিল এটি তার সম্পূর্ণই বিপরীত।
তবে বর্তমানে যদি ওই জরিপে অংশ নেওয়াদের একই প্রশ্ন করা হয়— তাহলে তাদের উত্তরও যে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে, তা-ও বলাইবাহুল্য। এরমধ্যেই এশিয়ার সরকারগুলো তাদের সামনে থাকা উপায়গুলো খতিয়ে দেখছে। চলতি সপ্তাহে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ১০টি রাষ্ট্রের জোট আসিয়ানের অর্থমন্ত্রীদের বৈঠক। মার্কিন শুল্কের বিষয়ে একযোগে পদক্ষেপ নিতেই এ বৈঠক করবেন তাঁরা। আসিয়ান-ভুক্ত দেশগুলোর নানান প্রভেদের কারণে এটি এই মুহূর্তেই হয়তো সফল হবে না। তবে ভবিষ্যতে এই চিত্র বদলাবে।
বিশ্বায়নের ফলে ব্যাপক উপকৃত দেশের মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো আসিয়ানের সদস্যরা। শুল্ক বিশ্ববাণিজ্যের যে চরম ক্ষতি করবে ইতোমধ্যেই স্পষ্টভাবে সেবিষয়ে বক্তব্য দিয়েছে তারা। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লরেন্স ওং হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, বিশ্ব ১৯৩০ এর দশকের মতো বিপজ্জনক হতে চলেছে, ওই দশকে বাণিজ্য যুদ্ধ শেষপর্যন্ত সত্যিকারের সশস্ত্র যুদ্ধের রূপ নেয়— যা আবার জন্ম দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের।
অন্যদিকে, বন্ধুদের সাথে কেমন আচরণ করা উচিৎ চীন যে তা জানে, তারই প্রমাণ দিচ্ছে। গেল ডিসেম্বরে চীন তার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বেশকিছু পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। রিজিওনাল কম্প্রেহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ বা আরসেপ জোটেরও মুখ্য চালকের আসনে চীন। এই জোটে যে ১৫টি দেশ রয়েছে, ২০২২ সালের হিসাবমতে, বৈশ্বিক জিডিপির ২৯ শতাংশই হচ্ছে তাদের। ফলে ওয়াশিংটনের বৈরী অর্থনৈতিক নীতি থেকে রক্ষা পেতে আরও অনেক দেশই এ জোটে যোগ দিতে চাইবে।
আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের সঙ্গে সৌহার্দ্য বাড়ানোরও প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বেইজিং। গেল মার্চেই চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার এক বৈঠকে— দেশগুলো অবাধ ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে পণ্য বাণিজ্যের আহ্বান জানায়। বৈরীতার ইতিহাসকে পেছনে রেখে, যৌথ ঘোষণায় তারা নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীরতর করার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছে। এনিয়ে তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তি না হলেও— বৈঠকটি যে হয়েছে এটাই সবচেয়ে গুরুত্ববহ। এতে প্রতিভাত হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বৈরীতার মুখে এই তিন দেশ নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে চাইছে।
নিরাপত্তা সম্পর্কের হাত ধরেই আসে অর্থনৈতিক সম্পর্ক। এই মুহূর্তে দুনিয়ার কোনো দেশের ভক্তাকুলই মার্কিন ভোক্তাদের জায়গা নিতে পারবে না। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গার্হস্থ্য ব্যয় ১৯ লাখ কোটি ডলারে পৌঁছায়, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বিগুণ এবং চীনের প্রায় তিন গুণ। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বাজার প্রবেশে বাধার মুখে পড়লে— এশিয়ার দেশগুলো মানিয়ে চলতে চাইবে, সেক্ষেত্রে বিশ্ববাণিজ্যের পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে পথ চলতে যা দরকার— বেইজিং তাদেরকে ঠিক সে ধরনের সহায়তারই প্রস্তাব দিচ্ছে।
অর্থনৈতিক অভিঘাত থেকে রক্ষা পেতে, এশীয় দেশগুলোকে হয়তো বাধ্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে ও সম্পর্ক ধরে রাখতে হবে। বর্তমান অনির্ভরযোগ্যতা সত্ত্বেও— তারা হয়তো এই জোটকে টিকিয়ে রাখতেও চাইবে, কারণ এই অঞ্চলে আয় বৃদ্ধি ও জীবনমান উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক।
ওয়াশিংটনের খামখেয়ালিতে ক্ষতিগ্রস্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো মিত্রদের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ বাড়তে পারে।
তবে সামরিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কও পুনর্বিবেচনা করবে তারা। ইতোমধ্যেই তেমন কিছু পরিকল্পনা নিয়ে ভাবনাচিন্তাও হচ্ছে। যেমন জাপান ও ন্যাটোর মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ও প্রতিরক্ষা শিল্প-সহযোগিতা বাড়ানোর আলোচনা চলছে।
ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ সবেই শুরু হয়েছে, যেখানে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র দুই পরাশক্তিই বাজে আচরণ করছে। এ দুয়ের মাঝে আটকা পড়া দেশগুলো চাইছে তাদের ক্ষতির বোঝা কমাতে। এশিয়ার দেশগুলো চাইছে এই দৈত্যদের লড়াইয়ের ময়দানের মধ্যে দিয়েই এগোনোর মধ্য মধ্যবর্তী একটা পথ। কিন্তু, দীর্ঘমেয়াদে তাদের কৌশলগত অগ্রাধিকারের পাল্লা ঝুঁকবে বেইজিংয়ের পক্ষেই। ফলে যে লড়াই শুরু হয়েছিল বাণিজ্যকে ঘিরে, তা পুরো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক মানচিত্রের বিন্যাসকে নতুন রূপ দিতে পারে— যার কেন্দ্রে থাকবে চীন।
লেখক: কারিশমা ভাসোয়ানি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের একজন মতামত কলামিস্ট। তিনি এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করেন, বিশেষত তার মূল আগ্রহের জায়গা হচ্ছে চীন। এর আগে তিনি বিবিসির লিড এশিয়া প্রেজেন্টার হিসেবে— দুই দশকের বেশি সময় কাজ করেছেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।