চীনের ওপর ১০৪ শতাংশ শুল্কারোপ ট্রাম্পের

ডোনাল্ড ট্রাম্প বুধবার থেকে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদারদের পণ্যের ওপর একগুচ্ছ শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা থেকে তিনি সরে দাঁড়াচ্ছেন না। যদিও এতে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে এবং অনেকেই তাকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, 'অনেক' দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে চাচ্ছে। তার প্রশাসন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা বুধবার থেকে কার্যকর হবে।
এদিকে বেইজিং হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, প্রয়োজনে তারা এর 'শেষ দেখে ছাড়বে'। কারণ, ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, চীন যদি তার পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ৩৪ শতাংশ শুল্কের জবাবে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়, তবে তিনি আরও ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করবেন। এতে আগের ২০ শতাংশ শুল্কসহ চীনা পণ্যের ওপর মোট শুল্কের হার দাঁড়াবে ১০৪ শতাংশ।
হোয়াইট হাউস নিশ্চিত করেছে যে চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করছে, তা বুধবার থেকেই কার্যকর হবে।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেন, "প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মনোবল পাহাড়ের মতো শক্ত, তিনি কোনো অবস্থাতেই পিছু হটবেন না। আর তার নেতৃত্বে আমেরিকা কখনোই ভেঙে পড়বে না।"
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপদেষ্টা ও বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী ইলন মাস্কও প্রেসিডেন্টকে তার সিদ্ধান্ত বদলাতে অনুরোধ জানিয়েছেন। একইসঙ্গে রক্ষণশীল ব্যবসায়ী লিওনার্ড লিও ও চার্লস কোচের প্রতিষ্ঠানের মতো সংগঠনের অর্থায়নে পরিচালিত লিবারটেরিয়ান গোষ্ঠী নিউ সিভিল লিবার্টিজ অ্যালায়েন্স নতুন শুল্ককে 'অবৈধ' দাবি করে আদালতে মামলা করেছে।
সম্প্রতি আরোপ করা শুল্ক গত সপ্তাহে আরোপ করা ১০ শতাংশ শুল্কের চেয়েও বেশি। নতুন এসব শুল্ক নির্দিষ্ট কিছু দেশের জন্য আলাদাভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা এই পদ্ধতিকে অবাস্তব ও সমালোচনাযোগ্য বলে অভিহিত করেছেন।
গত সপ্তাহে নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর কয়েক দিন ধরে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা চলছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর ২০ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ এবং কম্বোডিয়ার ওপর ৪৯ শতাংশ হারে ধার্য নতুন শুল্কগুলো অস্থায়ী হতে পারে। এমন আশ্বাসের কারণে গত মঙ্গলবার কিছুটা স্থিতি ফিরে এসেছে বিশ্ব বাজারে।
কিন্তু বাজারের এই ইতিবাচক সাড়া বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ওয়াল স্ট্রিটে দিন শেষে বড় ধরনের পতন দেখা যায়।
এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ১.৬ শতাংশ হারে কমে দাঁড়ায় ৪,৯৮২.৭৭ পয়েন্টে, যা এক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ৫,০০০ পয়েন্টের নিচে নামল। ডাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ সূচক কমেছে ০.৮ শতাংশ। প্রযুক্তি খাতকেন্দ্রিক নাসডাক কম্পোজিট সূচক সবচেয়ে বেশি চাপে পড়ে, যার পতন হয়েছে ২.২ শতাংশ।
দিনের শুরুতে লন্ডনের এফটিএসই ১০০ সূচক ২.৭ শতাংশ বেড়েছে, যা ট্রাম্পের ঘোষণার পর যে ক্ষতি হয়েছিল, তার কিছুটা পুষিয়ে দিয়েছে। ট্রাম্পের সহযোগীরা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিনটিকে 'মুক্তির দিন' বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
টোকিওতে নিক্কেই ২২৫ সূচক ৬ শতাংশ বেড়েছে, আর হংকংয়ের হ্যাং সেং এর সূচক বেড়েছে ১.৫ শতাংশ।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেন, নতুন শুল্ক হার ইতোমধ্যেই 'সর্বোচ্চ মাত্রায়' রয়েছে। তিনি আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন, আলোচনার মাধ্যমে এসব শুল্ক কমানো সম্ভব হবে।
মঙ্গলবার মার্কিন অর্থনীতি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্কট বেসেন্ট বলেন, "আমার মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় বাণিজ্য ঘাটতি আছে এমন কিছু বড় দেশ খুব শিগগিরই এগিয়ে আসবে।"
তিনি আরও বলেন, "যদি তারা গঠনমূলক প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার টেবিলে আসে, তাহলে আমাদের মধ্যে কিছু ভালো চুক্তি হতে পারে।"
এর একদিন আগে শুল্কগুলো কী আলোচনার পথ তৈরি করছে নাকি এগুলো স্থায়ী হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে সোমবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, "দুটোই হতে পারে। কিছু শুল্ক স্থায়ী থাকতে পারে, আবার আলোচনাও হতে পারে।"
এদিকে মঙ্গলবার ট্রাম্প আবারও কয়েকটি দেশের সঙ্গে তার চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একটি সম্ভাব্য চুক্তিরও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লেখেন, "তাদের শীর্ষ পর্যায়ের দলটি এখন যুক্তরাষ্ট্রে আসছে এবং পরিস্থিতি খুব ভালো দেখাচ্ছে। আমরা আরও অনেক দেশের সঙ্গেই আলোচনা করছি। তাদের সবাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করতে চায়।"
ট্রাম্প আরও বলেন, 'ওয়ান স্টপ শপিং' ধারণাটি সুন্দর ও কার্যকর প্রক্রিয়া!! চীনও একটি চুক্তি করতে মরিয়া হয়ে আছে। তবে তারা কীভাবে শুরু করবে, সেটা জানে না। আমরা তাদের ফোনের জন্য অপেক্ষা করছি। এটা ঘটবে!"
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের চ্যান্সেলর রাচেল রিভস বাজারে অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগ কমাতে পার্লামেন্টে বলেন, তিনি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলির সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি যিনি নিশ্চিত করেছেন, বাজার কার্যকরভাবে চলছে এবং আমাদের ব্যাংকিং সিস্টেম স্থিতিশীল রয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "একটি বাণিজ্যযুদ্ধ কারোরই স্বার্থে নয়।" তিনি নিশ্চিত করেন যে যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি নতুন চুক্তি করার চেষ্টা করছে। ট্রাম্প যুক্তরাজ্যের রপ্তানির ওপর ১০% শুল্ক আরোপ করেছেন, যা গত সপ্তাহান্তে চালু করা ন্যূনতম শুল্কের স্তরের সাথে সংগতিপূর্ণ।
তবে লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের 'ব্রিটিশ পণ্য কিনুন' আহ্বানে সাড়া দেননি রাচেল রিভস। এ বিষয়ে রিভস বলেন, "ব্রিটিশ পণ্য কেনার ক্ষেত্রে, আমি মনে করি সবাই নিজের সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা যা দেখতে চাই না, তা হলো একটি বাণিজ্যযুদ্ধ।"
এদিকে শুল্কারোপের বিষয়ে চীন সম্পূর্ণ ভিন্ন মত দিয়েছে। সরকারি সংবাদ সংস্থা শিনহুয়া তাদের এক তীব্র সম্পাদকীয়তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে 'খোলামেলা চাঁদাবাজির' জন্য অভিযুক্ত করেছে।
চীন বলছে, "যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত যুক্তি একেবারেই হাস্যকর। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, 'আমি চাইলে তোমাকে আঘাত করতে পারি এবং তোমার প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত নয়। তার পরিবর্তে, তোমাকে শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে'। বিষয়টিকে হাস্যকর বলেছে চীন।
তাদের মতে, এটি কূটনীতি নয়, এটি হলো সরাসরি চাপ সৃষ্টি করার নীতি।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পোস্ট করা ১৯৮৭ সালের রোনাল্ড রিগান এর একটি ভাষণ সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়েছে। সেই ভিডিও ক্লিপে এ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুল্ক ব্যবহারের সমালোচনা করেন এবং বলেন যে এটি প্রতিশোধের জন্ম দেয় এবং অবশেষে মার্কিন অর্থনীতির ক্ষতি করে। চীনের সংবাদ মাধ্যম দ্য পেপার 'এটি ২০২৫ সালে একটি নতুন তাৎপর্য ধারণ করেছে' বলে মন্তব্য করেছে।
চীনের এ প্রতিক্রিয়ায় মঙ্গলবার বেসেন্ট দাবি করেন, চীন প্রতিশোধ নিতে সাহসী হয়ে একটি বড় ভুল করছে। সিএনবিসিকে তিনি বলেন, "তারা 'পেয়ার অফ টু' নিয়ে খেলছে।" তিনি আরও বলেন, "চীন আমাদের ওপর শুল্ক বাড়ালে আমরা কী হারাবো? আমরা তাদের তুলনায় তাদের কাছে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করি, তার পাঁচভাগের একভাগ। সুতরাং, এটা তাদের জন্য একটি হারানো হাতের মতো।"