বিছানায় শুয়ে স্ক্রিনে সময় কাটানো ঘুমের জন্য ‘ক্ষতিকর’: গবেষণা

যারা শুয়ে শুয়ে দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তাদের মধ্যে অনিদ্রা ও ঘুমের ঘাটতির প্রবণতা বেশি—এমনটাই উঠে এসেছে এক গবেষণায়।
নরওয়ের ৪৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর ওপর এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।
এ গবেষণায় ইঙ্গিত মিলেছে, প্রতি বাড়তি এক ঘণ্টা স্ক্রিন টাইমের সঙ্গে অনিদ্রার ঝুঁকি বাড়তে পারে ৬৩ শতাংশ, আর ঘুম কমতে পারে প্রায় ২৪ মিনিট।
তবে গবেষকেরা জানান, তারা শুধু স্ক্রিন ব্যবহারের সঙ্গে ঘুমের মানের সম্পর্ক দেখাতে পেরেছেন; সরাসরি এর কারণ প্রমাণ করতে পারেননি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘুমানোর আগে মোবাইল দূরে রাখা, মনে প্রশান্তি আনে এমন কাজ করা এবং নির্দিষ্ট রুটিন মেনে চলা ঘুমের মান উন্নত করতে পারে।
এই গবেষণাটি ২০২২ সালে ১৮ থেকে ২৮ বছর বয়সি শিক্ষার্থীদের জাতীয়ভাবে প্রতিনিধিত্বকারী তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এর লক্ষ্য, ঘুমানোর বিছানায় শুয়ে স্ক্রিনে সময় দেওয়ার পরিমাণ এবং ঘুমের ধরনে কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা।
গবেষকরা আরও জানতে চেয়েছিলেন, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রভাব অন্যান্য স্ক্রিনভিত্তিক কার্যকলাপের চেয়ে আলাদা কি না।
নরওয়েজিয়ান ইনস্টিটিউট অভ পাবলিক হেলথের গবেষক এবং এ গবেষণার প্রধান লেখক ড. গুনহিল্ড জনসেন হিয়েটল্যান্ড বলেন, স্ক্রিনে কী দেখা হচ্ছে, তার চেয়ে স্ক্রিনে কতক্ষণ সময় কাটানো হচ্ছে সেটাই ঘুমের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে।
তিনি বলেন, তারা সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য স্ক্রিন কার্যকলাপের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য পাননি। অর্থাৎ স্ক্রিন ব্যবহারের ধরন নয়, বরং স্ক্রিন ব্যবহারের পরিমাণই ঘুমে বিঘ্ন ঘটানোর মূল কারণ।
ঘুম না সোশ্যাল মিডিয়া?
২০২২ সালের নরওয়ে স্বাস্থ্য ও কল্যাণ জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রশ্ন করা হয়েছিল—তারা ঘুমানোর পর বিছানায় কোনো ধরনের ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করেন কি না।
অপশনগুলোর মধ্যে ছিল সিনেমা বা টিভি দেখা, সোশ্যাল মিডিয়া চেক করা, ইন্টারনেট ব্রাউজ করা ও গেম খেলা।
যারা ঘুমানোর আগে স্ক্রিন ব্যবহার করেন বলে জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে ৬৯ শতাংশ বলেছেন, তারা সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও অন্যান্য স্ক্রিন কার্যকলাপও করেন।
তাদের আরও প্রশ্ন করা হয়েছিল—সপ্তাহে কয় রাত এভাবে স্ক্রিন ব্যবহার করেন, কতক্ষণ করেন, আর ঘুম পেতে বা ঘুম ধরে রাখতে সমস্যা হয় কি না, খুব ভোরে জেগে ওঠেন কি না অথবা সারাদিন ক্লান্তি বোধ করেন কি না।
যারা বলেছিলেন, সপ্তাহে অন্তত তিন দিন এই সমস্যাগুলো তিন মাস ধরে হচ্ছে—তারা অনিদ্রা বা ইনসমনিয়ায় ভুগছেন বলে চিহ্নিত করা হয়।
গবেষণায় বিছানায় শুয়ে স্ক্রিন ব্যবহার এবং ঘুমের ব্যাঘাত বা অনিদ্রার মধ্যে একটি সম্পর্ক পাওয়া গেলেও গবেষকরা বলছেন, এর মানে এমন নয় যে এটাই ঘুমের ব্যাঘাতের কারণ।
ড. হিয়েটল্যান্ড বলেন, 'এই গবেষণা কারণ নির্ধারণ করতে পারে না—যেমন, স্ক্রিন ব্যবহার অনিদ্রার কারণ নাকি অনিদ্রায় ভোগা শিক্ষার্থীরাই স্ক্রিনে বেশি সময় কাটান, তা নির্ধারণ করতে পারে না।'
তারা আরও বলেন, গবেষণাটির তথ্য এককভাবে অংশগ্রহণকারীদের নিজেদের জানানো অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে নেওয়ায় এতে পক্ষপাত থাকতে পারে। তাই এর ফলাফলকে বিশ্বজনীন বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
ঘুম বিশেষজ্ঞ জোশুয়া পাইপার বলেন, ঘুমের ওপর ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাবের 'মূল্যবান এবং ক্রমবর্ধমান প্রমাণ' হাজির করেছে এই গবেষণা।
তিনি বিবিসিকে বলেন, 'এটা ঘুমের সুযোগও এবং ঘুমের মান দুটোই নষ্ট করে। ফলে অনেকের ঘুমাতেই কষ্ট হয়, আবার কারও কারও জেগে থাকতে কষ্ট হয়।'
অনেকে স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা কমিয়ে বা নাইট মোড ব্যবহার করে প্রভাব কমাতে চাইলেও পাইপার বলেন, আগের অনেক গবেষণায় উঠে এসেছে, আসল ক্ষতির কারণ হলো স্ক্রিনে স্ক্রল করে যাওয়া এবং ডিভাইসের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকা।
ভালো ঘুমের জন্য পরামর্শ
গভীর রাত পর্যন্ত ফোন ব্যবহার ও বাড়তি স্ক্রিন টাইম ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের মতো কাজ শরীর ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং ঘুমের ওপর ঠিক কতটা প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে।
তবু বিশেষজ্ঞরা ঘুমাতে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ করার পরামর্শ দেন।
তারা আরও বলেন, নিয়মিত একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস গড়ে তোলাও ঘুমের মান উন্নত করতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থা 'মাইন্ড' ও 'রিথিঙ্ক' পরামর্শ দিয়েছে, ঘুমের আগে জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা না করে বরং মনে প্রশান্তি আনে এমন কাজ করা ভালো—যেমন শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, বই পড়া বা গরম পানিতে গোসল।
ঘুমের আগে ক্যাফেইন, অ্যালকোহল বা ভারী খাবার এড়ানো; হালকা ব্যায়াম; আর সম্ভব হলে শোবার ঘরকে আরও আরামদায়ক করে তোলার পরামর্শও দিয়েছে তারা।
ঘুম থেরাপিস্ট ড. ক্যাট লেডারলে বিবিসিকে বলেন, দেহঘড়ি ঘড়ি ঠিক রাখতে দিনের বেলায়, বিশেষ করে সকালে কিছুক্ষণ প্রাকৃতিক আলো গায়ে লাগানো খুবই জরুরি।
তিনি বলেন, আনন্দদায়ক কিন্তু খুব উত্তেজনাপূর্ণ নয়—এমন কাজ করা ভালো ঘুমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
গবেষণার লেখকরাও এই বিষয়ে আরও গভীর গবেষণার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন—বিশেষত দীর্ঘমেয়াদে ঘুমের ধারা পর্যবেক্ষণ এবং রাতের বেলায় ডিভাইসের নোটিফিকেশন ঘুমে কতটা ব্যাঘাত ঘটায়, সেসব বিষয়েও গবেষণার ওপর জোর দিয়েছেন তারা।