বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপে পোশাক শিল্পে সুবিধা হলো ভারতের

ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর শুল্ক নীতি বিশ্ব বাণিজ্যে আলোড়ন তুলেছে। তবে এই অস্থিরতাই কিছু কিছু দেশের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক নীতির ফলে ভারতের পোশাক শিল্পসহ উৎপাদন খাতে সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে বিবিসি'র এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।
গত বুধবার (২ এপ্রিল) হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ওপর পারস্পরিক শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) আরোপের তালিকা প্রকাশ করেন। তালিকা অনুযায়ী, মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ (যা আনুষ্ঠানিক আদেশে ২৭ শতাংশ), চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক বসানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
আগামী ৯ এপ্রিল থেকে ভারতীয় পণ্যগুলোর ওপর সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে। হোয়াইট হাউসের তথ্য অনুযায়ী, শুল্ক বৃদ্ধির আগে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক অংশীদারদের জন্য গড় শুল্ক হার ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যেখানে ভারতের গড় শুল্ক হার ছিল ১৭ শতাংশ।
তবে চীন, ভিয়েতনাম (৪৬ শতাংশ), থাইল্যান্ড (৩৬ শতাংশ) ও বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি শুল্ক আরোপ করায় ভারতের জন্য নতুন বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে দিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই)। বিশেষ করে, চীন ও বাংলাদেশের রফতানির ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতীয় টেক্সটাইল নির্মাতাদের প্রবেশের সম্ভাবনা বেড়েছে।
এছাড়া, চীন ও থাইল্যান্ডের নেতৃত্বাধীন মেশিনারি, অটোমোবাইল ও খেলনা খাতেও উচ্চ শুল্কের কারণে উৎপাদন স্থানান্তরের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। জিটিআরআই-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত যদি বিনিয়োগ আকর্ষণ, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি সম্প্রসারণ করতে পারে, তাহলে এই সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব।
তবে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, ভারত কি এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে?
বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর নির্ভরশীল কোম্পানিগুলোর জন্য উচ্চ শুল্ক উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে, যা ভারতের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। ভারতের রফতানি বৃদ্ধি পেলেও (বিশেষত সেবা খাতে), দেশটি এখনও বড় বাণিজ্য ঘাটতির সম্মুখীন। বিশ্ব রফতানিতে ভারতের অংশ মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ।
ট্রাম্প একাধিকবার ভারতকে 'শুল্ক রাজা' এবং 'বাণিজ্যের বড় অপব্যবহারকারী' বলে অভিহিত করেছেন। তার নতুন শুল্ক নীতির ফলে ভারতীয় রফতানিকারীদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা আরও কঠিন হতে পারে।
জিটিআরআই-এর অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষামূলক শুল্ক নীতি বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে পরিবর্তন এনে ভারতের জন্য সুযোগ তৈরি করবে। তবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে ভারতকে ব্যবসায়িক পরিবেশ সহজ করতে হবে, লজিস্টিকস ও অবকাঠামোয় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং নীতিগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। এসব নিশ্চিত হলে ভারত ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক উৎপাদন ও রফতানি কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।'
তবে দিল্লিভিত্তিক কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের গবেষক বিশ্বজিৎ ধর মনে করেন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ভারতের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের ফলে পোশাক খাতে আমরা কিছুটা হারানো অবস্থান ফিরে পেতে পারি। তবে বাস্তবতা হলো—আমরা বহু বছর ধরে পোশাক খাতকে গুরুত্ব দিইনি এবং বিনিয়োগ করিনি। সক্ষমতা না বাড়ালে শুল্ক পরিবর্তনের সুফল কীভাবে পাওয়া যাবে?'
বর্তমানে, ৪৫ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ভারত শুল্ক যুদ্ধ থেকে রেহাই পায়নি।
ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য ইনস্টিটিউটের (আইআইএফটি) ডব্লিউটিও স্টাডিজ সেন্টারের সাবেক প্রধান অভিজিৎ দাস বলেন, 'ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত—চলমান বাণিজ্য আলোচনা দেশটিকে পারস্পরিক শুল্ক আরোপের হাত থেকে রক্ষা করবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু এখন এই শুল্কের মুখে পড়া বড় ধরনের ধাক্কা।'
তবে স্বস্তির খবর হলো, ফার্মাসিউটিক্যালস খাত পারস্পরিক শুল্কের আওতামুক্ত থাকছে। ফলে ভারতের জেনেরিক ওষুধ প্রস্তুতকারীরা এতে স্বস্তি পাবেন। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত ৯০ শতাংশ জেনেরিক ওষুধের প্রায় অর্ধেকই সরবরাহ করে ভারত।
তবে ইলেকট্রনিকস, অটোমোবাইল যন্ত্রাংশ, শিল্পযন্ত্র এবং সামুদ্রিক পণ্যের রফতানি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস খাতের জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ 'প্রোডাকশন-লিংকড ইনসেনটিভস' কর্মসূচির মাধ্যমে স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে বিপুল বিনিয়োগ করা হয়েছে।
বিশ্বজিৎ ধর বলেন, 'আমাদের রফতানিকারীদের সক্ষমতা নিয়ে আমি শঙ্কিত। অনেক ছোট উৎপাদকেরা ২৭ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির ধাক্কা সামলাতে পারবে না। ফলে তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। উচ্চ লজিস্টিক খরচ, বাড়তি ব্যবসায়িক ব্যয় ও দুর্বল বাণিজ্য অবকাঠামো চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।'
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় সুবিধা আদায়ের কৌশল হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসন এই শুল্ক আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির প্রতিবেদনে ভারতের কঠোর আমদানি বিধি, স্টেন্ট ও চিকিৎসা ইমপ্লান্টের মূল্যের সীমাবদ্ধতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সংরক্ষণে দুর্বলতার বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশ্বজিৎ ধর মনে করেন, চীন বা ভিয়েতনামের চেয়ে এগিয়ে যাওয়া রাতারাতি সম্ভব নয়—এই সুযোগ কাজে লাগাতে সময়, পরিকল্পনা ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা গড়ে তোলা প্রয়োজন।