গাজায় ইসরায়েলের হামলা, নিহত অন্তত ৪০৪

গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর 'ব্যাপক' হামলায় বাংলাদেশ সময় বিকাল পৌনে ৫টা পর্যন্ত অন্তত ৪০৪ জন নিহত ও ৫৬২ জন আহতের খবর পাওয়া গেছে।
হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতির পর গাজায় এটিই ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বিমান হামলা। এ হামলায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের মধ্যে বহু শিশু রয়েছে।
মন্ত্রণালয় বলছে, 'এখন পর্যন্ত ৪০৪ জন শহিদের মরদেহ ও আহত অবস্থায় ৫৬২ জনকে গাজা উপত্যকার বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও অনেকেই এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন।'
হামলার ঘটনায় হামাসের এক শীর্ষ কর্মকর্তা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হামলার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অফিস একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনীকে 'সন্ত্রাসী সংগঠন হামাসের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে' নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'
আরও বলা হয়, 'এটি হামাসের আমাদের জিম্মিদের মুক্তি দিতে বারবার অস্বীকৃতি জানানো এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের দূত স্টিভ উইটকফ ও মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে পাওয়া সকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরিণাম। ইসরায়েল এখন থেকে হামাসের বিরুদ্ধে বর্ধিত সামরিক শক্তি প্রয়োগ করবে।'
স্বাস্থ্যকর্মী এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুযায়ী, গাজার কেন্দ্রে দেইর আল-বালাহতে তিনটি বাড়ি, গাজা শহরে একটি ভবন এবং খান ইউনিস ও রাফাহ-র বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হয়েছে। ফিলিস্তিনি সিভিল ইমার্জেন্সি সার্ভিস জানিয়েছে, গাজায় অন্তত ৩৫টি বিমান হামলা হয়েছে।
সাতটি হাসপাতালের রেকর্ড অনুযায়ী, রাতভর ও মঙ্গলবার ভোরে চালানো হামলায় অন্তত ৩৩০ জন নিহত হয়েছেন। এ পরিসংখ্যানে অন্যান্য ছোট স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনা মরদেহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এবং উদ্ধারকর্মীরা এখনও নিহত ও আহতদের জন্য সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন।
খান ইউনিস, গাজা শহর এবং মধ্য গাজার হাসপাতালগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চলমান সংঘাতে। নাসের হাসপাতাল, আল-আকসা হাসপাতাল এবং আল-আহলি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা প্রায় ৮৫টি মৃতদেহ পেয়েছে। এছাড়া, রাফাহ এবং দক্ষিণ গাজায় এক পরিবারের ১৬ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ।
১ মার্চে প্রথম ধাপের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর থেকে মধ্যস্থতাকারীরা ভবিষ্যতের জন্য একটি উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর জন্য আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে এবং কোনো চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার বিষয়ে মতবিরোধের ফলে সংঘাত বাড়ছে।
হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ এনেছে। ইসরায়েল দাবি করছে, হামাস বারবার জিম্মিদের মুক্তি দিতে অস্বীকার করেছে এবং শান্তি প্রস্তাবগুলোও প্রত্যাখ্যান করেছে।
একজন হোয়াইট হাউজ মুখপাত্র বলেছেন, ইসরায়েল হামলা চালানোর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সাথে পরামর্শ করেছে। সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, হামলাগুলি মধ্যম স্তরের হামাস কমান্ডার ও নেতাদের লক্ষ্য করে এবং তাদের দলের অবকাঠামো লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে।
গাজার রাফাহ অঞ্চলে ইসরায়েলি ট্যাংক থেকে ভারী মর্টার ও গুলি চালানোর খবর পাওয়া গেছে। এর ফলে বহু পরিবারকে তাদের ঘর ছেড়ে উত্তর গাজা, বিশেষ করে খান ইউনিসে চলে গেছে। এই পরিবারগুলো, যারা ইতোমধ্যে চলমান সংঘাতে শরণার্থী হয়েছিল, এখন আবারও নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই দোহায় ইসরায়েলি ও হামাস দলের মধ্যে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। মিশরীয় ও কাতারি মধ্যস্থতাকারীরা উভয় পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব মেটানোর চেষ্টা করছেন। ইসরায়েল গাজায় আটক ৫৯ জিম্মির মুক্তির বিনিময়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দিচ্ছে। তবে হামাস একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী পুরোপুরি প্রত্যাহারের দাবিতে অটল রয়েছে, যা মূল যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
হামাস তাদের বিবৃতিতে বলেছে, 'আমরা দাবি করছি, মধ্যস্থতাকারীরা নেতানিয়াহু এবং জায়োনিস্ট আক্রমণকারীদেরকে চুক্তি লঙ্ঘন ও শর্ত ভঙ্গের জন্য পূর্ণ দায়িত্ব নিতে বলুক।'
এই পরিস্থিতি মানবিক সংকট আরও তীব্র করেছে। একাধিকবার সতর্ক করা সত্ত্বেও, ইসরায়েল গাজায় ত্রাণ পাঠানো বন্ধ করেছে এবং হামাস যদি জিম্মিদের মুক্তির দাবি পূরণ না করে, তবে যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার হুমকি দিয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস বিদ্রোহীরা গাজা সংলগ্ন ইসরায়েলি কমিউনিটিতে আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ জনকে হত্যা করে এবং ২৫১ জনকে গাজায় জিম্মি করে নিয়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়া ইসরায়েলি বিমান হামলা ও সামরিক অভিযানে ৪৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর অভিযানে গাজার ব্যাপক অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। আনুমানিক ৭০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা, পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ এবং আশ্রয়ের তীব্র ঘাটতি রয়েছে। গাজা উপত্যকার ২.১ মিলিয়ন জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষ বারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারীরা দীর্ঘস্থায়ী চুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সহিংসতা বাড়তে থাকায় গাজা আরও একটি সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ আবারও বাস্তুচ্যুত হচ্ছে এবং বহু মানুষ সংঘাতের মধ্যে পড়ে গেছে।