আরবি পাণ্ডুলিপিতে মিলল বিখ্যাত গ্রিক গণিতবিদের হারানো রচনার সন্ধান

বিজ্ঞানীরা প্রাচীন গ্রীক গণিতবিদ অ্যাপোলোনিয়াসের হারিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ দুটি বই একটি আরবি পাণ্ডুলিপির মধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে বলে জানিয়েছেন। অ্যাপোলোনিয়াস প্রাচীন বিশ্বে 'দ্য গ্রেট জিওমিটার' নামে পরিচিত ছিলেন। পাণ্ডুলিপিটি নেদারল্যান্ডসের লেইডেন ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।
সম্প্রতি এটি লেইডেন ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত ৫০ অধ্যায়ের নতুন গ্রন্থ 'প্রফেটস, পোয়েটস অ্যান্ড স্কলারস'-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অ্যাপোলোনিয়াস (খ্রিস্টপূর্ব ২৬২-১৯০) প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম প্রভাবশালী গণিতবিদ ছিলেন। তিনি 'দ্য কনিক্স অফ অ্যাপোলোনিয়াস' এর জন্য খ্যাতি অর্জন করেন।
'দ্য কনিক্স অফ অ্যাপোলোনিয়াস' (প্রায় ২০০ খ্রিস্টপূর্ব) প্রাচীন গ্রীক গণিতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এখানে উপবৃত্ত, পরাবৃত্ত এবং অধিবৃত্তের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই গবেষণার আটটি বই ছিল। তবে রেনেসাঁ যুগে ইউরোপীয় পণ্ডিতরা মাত্র প্রথম চারটি বই খুঁজে পান।
হারিয়ে যাওয়া পঞ্চম ও সপ্তম বই দুটি ডাচ অধ্যাপক ও গণিতবিদ জ্যাকব গোলিয়াস লেইডেন ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে আসেন। বিভিন্ন সফরের সময় তিনি প্রায় ২০০টি মূল্যবান পাণ্ডুলিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ক্রয় করেন।
প্রফেটস, পোয়েটস অ্যান্ড স্কলারস বইটির ৫০টি অধ্যায়ে প্রাচ্যের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের সম্পর্কের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সঙ্গে। ১৭ শতকে প্রথমবারের মতো ইউরোপের পণ্ডিতরা আরবি পাণ্ডুলিপির সংস্পর্শে আসেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে এখানে।
১৭ শতকে ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের ক্ষেত্রে ডাচদের মধ্যে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন থমাস এর্পেনিয়াস। তার সম্পর্কে ভূমিকাতে বইটির সম্পাদকরা লিখেছেন, 'তিনি আরবি পাঠ্য সংস্করণ, ছাত্রদের জন্য প্রাথমিক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে একটি আরবি ব্যাকরণ রচনা করেন। এটি পরবর্তী দুই শতাব্দী ধরে সংশ্লিষ্ট কাজের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়।'
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য বা উত্তর আফ্রিকায় প্রথম পদার্পণকারী ডাচ ব্যক্তি ছিলেন জ্যাকব গোলিয়াস (১৫৯৬-১৬৬৭)। সম্পাদকদের মতে গোলিয়াস মূলত তার রচিত 'লেক্সিকন এরাবিয়ান-ল্যাটিনাম' বইয়ের জন্য পরিচিত। এটি ১৬৫৩ সালে এলজেভিয়ার কোম্পানির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, এবং তার সংগ্রহ করা আরবি লেক্সিকোগ্রাফিক পাণ্ডুলিপির ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়।
গোলিয়াসের কেনা পাণ্ডুলিপিগুলো এই গ্রন্থে ভূমিকা রাখা বহু গবেষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যেমন, একটি অধ্যায়ে ১১ শতকয়ের একটি আরবি পাণ্ডুলিপি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এটি ছিল অ্যাপোলোনিয়াসের হারানো গাণিতিক কাজের অনুবাদ। একইসঙ্গে প্রবন্ধটিতে গোলিয়াসের সংগ্রহ করা আরও চারটি আরবি পাণ্ডুলিপি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে আরব ও মুসলিম সভ্যতার সোনালি যুগের বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যের নানা দিক তুলে ধরা হয়।
ডাচ গণিতবিদ ও ইতিহাসবিদ ইয়ান পিটার হোগেনডাইক বলেন, 'অ্যাপোলোনিয়াসের আরবি অনুবাদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু বৈজ্ঞানিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বইটি রঙিন চিত্রসহ সুসজ্জিত এবং দক্ষ আরবি ক্যালিগ্রাফিতে লেখা। ক্যালিগ্রাফিগুলো অসাধারণ এবং এতে অন্তর্ভুক্ত জ্যামিতিক চিত্রগুলো অত্যন্ত যত্ন সহকারে আঁকা হয়েছে।'
সম্পাদকদের মতে এই গ্রন্থটি 'লেইডেন ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরির প্রাচীন ও আধুনিক সংগ্রহের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে পাঠকদের পরিচিত করানোর জন্য ৫০-এর বেশি গবেষক ও গ্রন্থাগারিকের অবদানের সংকলন।'
এই গ্রন্থটি সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্যভাবে লেখা হয়েছে। বইটি প্রাচীন চিত্র, মানচিত্র ও আরবি, তুর্কি এবং পার্সি পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ দ্বারা সমৃদ্ধ। এতে মধ্যযুগে আরব ও মুসলিমদের বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যের বিশ্লেষণ রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে আরবি ভ্রমণ সাহিত্য থেকে সিন্দাবাদের মতো কিছু কল্পকাহিনীও।

আরবি পাণ্ডুলিপির উপর লিখিত অংশ 'গ্রেট আরবি হেরিটেজ'-এ মহাকাশবিদ্যা, গণিত, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, এবং গ্রহবিদ্যাসহ বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে খ্যাতনামা মুসলিম মহাকাশবিদ ইবন মুহাম্মদ আল-কাজভিনী'র গ্রন্থ আজায়েব আল-মাখলুকাত ও খারাইব আল-মাওজুদাত (সৃষ্টির বিস্ময় ও বর্তমান অস্তিত্ব)-এর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এটি একটি বিশ্বকোষ-ধর্মী কাজ, যেখানে সাধারণ প্রাণী যেমন পিঁপড়ে, কৃমি, উকুন থেকে শুরু করে রহস্যময় ও কাল্পনিক প্রাণীরও বর্ণনা রয়েছে। যেমন, একটি কাল্পনিক কচ্ছপের কথা বলা হয়েছে। দ্বীপ ভেবে যার উপর নাবিকরা তাদের জাহাজ নোঙর করেছিল। এটি বিখ্যাত নাবিক সিন্দাবাদ এর যাত্রায় পাওয়া প্রাণীদের মতোই।
গ্রন্থের একটি আকর্ষণীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে, 'বইয়ের বর্ণনাগুলি বুঝতে মাঝে মাঝে পূর্বধারণা থেকে মুক্ত হতে হয়।" যেমন, কাজভিনী একটি সামুদ্রিক প্রাণীর বর্ণনা দেন এভাবে, 'প্রাণীটির মুখ মানুষের মতো, সাদা দাড়ি আছে, শরীর উঁচু ব্যাঙের মতো, চুল গরুর মতো এবং আকার বাছুরের মতো।' একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায় যে এটি আসলে একটি সীলের বিবরণ।
শারজাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণনামূলক বিশ্লেষণ ও গাণিতিক মডেলিং-এর অধ্যাপক মোস্তফা জাহরি বলেন, 'পশ্চিমা গ্রন্থাগারগুলোতে আরবি পাণ্ডুলিপির বিশেষ মূল্য রয়েছে। যেমন লেইডেন ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিটি ইসলামী সভ্যতার গণিত ও জ্যামিতির অমূল্য রেকর্ড সংগ্রহশালা। পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেমন ব্রিটিশ লাইব্রেরি এবং ফরাসি জাতীয় গ্রন্থাগারে হাজার হাজার আরবি, ফার্সি ও ওসমানীয় শাসনামলের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত রয়েছে। এখানে বিরল জ্যামিতিক গ্রন্থও অন্তর্ভূক্ত। এই সংগ্রহগুলো প্রাচীন ও আধুনিক শিক্ষার মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করে।'
তবে অনেক পাণ্ডুলিপি এখনও যথাযথভাবে অধ্যয়ন করা হয়নি। ইউট্রেখট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমন্বয়ক উইলফ্রেড ডি গ্রাফ বলেন, 'আরবি ও ইসলামী পাণ্ডুলিপির কেবল একটি ছোট অংশই অধ্যয়ন করা হয়েছে।'
তিনি গবেষণার অভাবের কারণ হিসেবে পশ্চিমা দেশে প্রাচ্যের ভাষাগুলিতে যেমন, আরবি, ফার্সি ও তুর্কি ভাষায় দক্ষ পণ্ডিতের অভাবকে চিহ্নিত করেন। কারণ অধিকাংশ ইসলামী পাণ্ডুলিপি এসকল ভাষাতেই লেখা।
অধ্যাপক জাহরি আরও বলেন, 'বর্তমানে আরও বেশি প্রাচীন গ্রন্থ উন্মোচিত হচ্ছে। এগুলো পণ্ডিতদের জন্য 'ইসলামি ঐতিহ্যে বিজ্ঞানের উন্নয়ন' সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা পেতে সহায়ক হচ্ছে।'
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি পাণ্ডুলিপিগুলোর উপর ভিত্তি করে পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের একটি দল সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করে। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের শেখানো হয় কীভাবে আরব এবং মুসলিম বিজ্ঞানীরা "অবজাত" নামক একটি সংখ্যা পদ্ধতিতে সংখ্যা লিখতেন। এটি আরবি বর্ণমালার প্রতীককে নির্দেশ করে, যেগুলো ডান থেকে বামে লেখা হয়।
অবজাত একটি সংখ্যা পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ২৮টি আরবি বর্ণমালার প্রথম অক্ষর 'আলিফ' ১ এবং দ্বিতীয় অক্ষর 'বা' ২ থেকে ৯ পর্যন্ত প্রতিনিধিত্ব করে।
কর্মশালাটির আয়োজক উইলফ্রেড বলেন, 'ইসলামি ঐতিহ্যের বিজ্ঞানীরা অবজাত পদ্ধতিকে যৌথভাবে সেক্সাজিমাল পদ্ধতির সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। আজও সময় (ঘণ্টা, মিনিট ও সেকেন্ড) এবং কোণ (ডিগ্রি, আর্ক মিনিট ও আর্ক সেকেন্ড) পরিমাপের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়।'
কর্মশালায় পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা আরবি পাণ্ডুলিপিগুলো আরবি একাডেমিক গোষ্ঠীদের সামনে উপস্থাপন করেন এবং মধ্যযুগে আরব ও মুসলিম বিজ্ঞানীরা কীভাবে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতেন তা প্রদর্শন করেন।
এছাড়া একটি আরবি পাণ্ডুলিপিতে অ্যাপোলোনিয়াসের দুটি হারানো কাজের উদ্ধৃতি পাওয়া গেছে। এটি মধ্যযুগে আরবদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যের ওপর আলোকপাত করে।
একটি অধ্যায়ে ১১শ শতাব্দীর একটি পাণ্ডুলিপি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সারাগোসার রাজা আল-মু'তামান ইবন হুদ (১০৮১-১০৮৫) এর সাথে সম্পর্কিত এটি। এতে দেখানো হয়েছে কীভাবে মুসলিম বিজ্ঞানীরা ইউরোপিয়ানদের প্রায় পাঁচশ বছর আগেই প্রাচীন গ্রিক জ্যামিতির একটি ধাঁধার সমাধান করেছিলেন। পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী মুসলিম বিজ্ঞানীদের এই সমাধানটি 'বুক অফ পারফেকশন' নামক একটি বিশাল গাণিতিক বিশ্বকোষের অংশ।
১৪ শতকয়ের একটি আরবি পাণ্ডুলিপি মতে, মুসলিম বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে ও তুলনামূলক কম ত্রুটির সঙ্গে ১৬০টিরও বেশি শহরের ভৌগোলিক অবস্থান নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
'শহরগুলোর নাম কালো কালি দিয়ে লেখা। আর লাল রঙে লেখা সংখ্যাগুলো দ্রাঘিমাংশের ডিগ্রি ও মিনিট এবং অক্ষাংশের ডিগ্রি ও মিনিট নির্দেশ করে। সংখ্যাগুলো সাধারণত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ব্যবহৃত 'বর্ণমালাভিত্তিক অবজাত' পদ্ধতিতে লেখা হয়েছিল। যেখানে প্রতিটি অক্ষর একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার মান বহন করে। প্রথম কলামে আধুনিক ইরানের পশ্চিম ও পূর্ব আজারবাইজানের স্থানগুলোর নাম উল্লেখ রয়েছে।