বেলুচিস্তানে ট্রেনে হামলা: ‘বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা’র বর্ণনা দিলেন মুক্ত যাত্রীরা

পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে জাফর এক্সপ্রেসের ঘটনাকে 'একটি বিভীষিকাময় দিন' বলে উল্লেখ করেছেন মুক্তি পাওয়া যাত্রীরা।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রেনের এক যাত্রী ইশাক নুর বলেন, "গুলি চলার সময় আমরা যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে কী হবে আমরা জানতাম না।"
ট্রেনে থাকা ৪০০-এর বেশি যাত্রীর একজন ছিলেন ইশাক নুর। ট্রেনটি গত মঙ্গলবার কোয়েটা থেকে ছেড়ে পেশোয়ারে যাচ্ছিল। ওই ট্রেনে হামলা চালায় বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) এবং যাত্রীদের জিম্মি করে রাখে। হামলায় এখন পর্যন্ত ট্রেনের চালকসহ বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ৩০০ যাত্রীকে মুক্ত করা হয়েছে এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীর ৩৩ জন সদস্য নিহত হয়েছে। উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, বাকি যাত্রীদের উদ্ধারে কয়েকশ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ হেলিকপ্টার ও বিশেষ বাহিনীর সদস্যও মোতায়েন করেছে।
বিএলএ সতর্ক করেছে যে, জিম্মিদের উদ্ধারের চেষ্টা চালানো হলে 'গুরুতর পরিণতি' ভোগ করতে হবে।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ট্রেনে থাকা অন্তত ১০০ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তবে এখনও কতজন যাত্রী জিম্মি রয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। মুক্ত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে এক ডজনের বেশি আহতকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু সশস্ত্র বিদ্রোহী ট্রেন ছেড়ে পার্শ্ববর্তী পার্বত্য এলাকায় চলে গেছে, সঙ্গে অজ্ঞাতসংখ্যক যাত্রীকেও নিয়ে গেছে।

বুধবার, কোয়েটা রেলস্টেশনে বহু কাঠের কফিন লোড হতে দেখেছে বিবিসি। এক রেলওয়ে কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কফিনগুলো খালি এবং সম্ভাব্য হতাহতদের বহনের জন্য পাঠানো হচ্ছে।
কোয়েটা থেকে লাহোরে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন মুহাম্মদ আশরাফ। ট্রেনে হামলা চালানো হলে, তিনি গভীর রাতে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন।
তিনি বলেন, "যাত্রীদের মধ্যে প্রচণ্ড আতঙ্ক বিরাজ করছিল। দৃশ্যটা ছিল বিভীষিকাময়।"
এরপর ওই দলটি প্রায় চার ঘণ্টা হেঁটে পরবর্তী রেলস্টেশনে পৌঁছায়। কয়েকজন দুর্বল যাত্রীকে কাঁধে তুলে নিয়ে যান অন্যরা।
তিনি বলেন, "আমরা খুব কষ্ট করে স্টেশনে পৌঁছেছি, কারণ আমরা ক্লান্ত ছিলাম। আর আমাদের সঙ্গে নারী ও শিশুরাও ছিল।
তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ভ্রমণ করা ইশাক নূর জানান, ট্রেনে প্রথম বিস্ফোরণটি এতটাই তীব্র ছিল যে, তার এক সন্তান আসন থেকে পড়ে যায়।
তিনি ও তার স্ত্রী একেকজন একেক সন্তানকে আগলে ধরেন গোলাগুলির মধ্যে।
তিনি বলেন, "গোলাগুলির মধ্যে সন্তানদের গায়ে যাতে কোনো আঘাত না লাগে আমরা সেভাবে তাদের ধরে রেখেছিলাম।"
মুশতাক মুহাম্মদ ট্রেনের তৃতীয় বগিতে ছিলেন।
তিনি বলেন, "আক্রমণকারীরা নিজেদের মধ্যে বেলুচি ভাষায় কথা বলছিল। আর তাদের নেতা বারবার বলছিলেন, বিশেষ করে নিরাপত্তা সদস্যদের উপর নজর রাখতে, যেন তারা তাদের হাতছাড়া না হয়।"
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আক্রমণকারীরা কিছু বেলুচিস্তানের বাসিন্দা, নারী, শিশু ও প্রবীণ যাত্রীদের ছেড়ে দিতে শুরু করে, জানান ইশাক নূর।
তিনি বলেন, তিনি আক্রমণকারীদের জানান, তিনি বেলুচিস্তানের তুরবাত শহরের বাসিন্দা। তার সঙ্গে নারী ও শিশু থাকায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এদিকে, ট্রেনের চালক আমজাদ ইয়াসিনের পরিবারের সদস্যরা উদ্বেগের মধ্যে আছেন। কারণ তারা শুনেছেন ট্রেন চালক আমজাদ আহত হয়েছেন। তারা জানান, ২৪ বছর ধরে ট্রেন চালানোর অভিজ্ঞতা থাকা আমজাদ প্রায় আট বছর আগে আরেকটি ট্রেনে বিস্ফোরণের ঘটনার শিকার হয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন।
তার ভাই আমির বিবিসিকে কোয়েটা থেকে বলেন, "গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা তীব্র মানসিক চাপের মধ্যে ছিলাম। মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে,।"
বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) কয়েক দশক ধরে স্বাধীনতার দাবিতে বিদ্রোহ চালিয়ে আসছে এবং পুলিশ স্টেশন, রেললাইন ও মহাসড়ক লক্ষ্য করে একাধিক প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে।

'ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক'
বেলুচিস্তানে বিদ্রোহ দমনে ২০০০ দশকের শুরু থেকে অভিযান চালিয়ে আসছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনী। তাদের অভিযানে হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ উঠলেও তারা তা অস্বীকার করে আসছে।
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এবং যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ বিএলএ-কে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে।
পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশন ট্রেন ছিনতাইয়ের ঘটনায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এক্স-এ দেওয়া এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, "আমরা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে বেলুচিস্তানের নাগরিকদের সংকট নিরসনে জরুরি ভিত্তিতে মানবাধিকার রক্ষা করে গণমুখী ঐক্যমত্য গঠনের এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানাই।"
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এ ট্রেনে হামলার ঘটনার 'তীব্র নিন্দা' জানিয়েছেন এবং অবশিষ্ট যাত্রীদের দ্রুত মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন।