বাংলাদেশি পর্যটক নেই, ফাঁকা দোকানপাট: কারও ব্যবসা বন্ধ, কেউ চিন্তিত অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে

এ বছর রমজান পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য লড়ছেন ভারতের কলকাতার নিউমার্কেট এবং এর আশেপাশের ব্যবসায়ীরা। কারণ রমজান মাস তাদের ব্যবসায়ের মৌসুম। আর তাদের সবচেয়ে বড় গ্রাহক হলো বাংলাদেশিরা। কিন্তু ভিসা নিষেধাজ্ঞার কারণে এবার তেমন কোনো বাংলাদেশি নেই।
কিছু ব্যবসায়ী ইতোমধ্যেই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। অনেকে আছেন, তারা নিশ্চিত নন যে কতদিন তারা এভাবে চলতে পারবেন।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের কারণে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই ভারতীয় হাইকমিশন এখনও আগের মতো বাংলাদেশে পর্যটন ভিসা চালু করেনি। বাংলাদেশিদের একমাত্র মেডিকেল ভিসা দেওয়া হচ্ছে।
কলকাতার মির্জা গালিব স্ট্রিটে অবস্থিত একটি বাজেট হোটেল গুলশান প্যালেস। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এর লবি ছিল জনশূন্য। রিসিপশনে বসে থাকা রিসিপশনিস্ট মোবাইল দেখছিলেন আর হোটেলের মালিক আর. কে. বসে বিলে সাইন করছিলেন।
আর. কে. বলেন, "আমি জানি না কীভাবে চালিয়ে যেতে হবে।" হোটেলটিতে ১৩টি কক্ষ রয়েছে। আগে বছরের এই সময় মাসে একদিন রুম খালি থাকতো না। গত বৃহস্পতিবার মাত্র চারটি কক্ষে অতিথি ছিল এবং তাদের কেউ বাংলাদেশি নন। তিনি বলেন, "কয়েক মাস ধরে এভাবেই চলছে। এমনকি অর্ধেক কক্ষও বুক করা নেই।"
হোটেলে একটি নন-এসি কক্ষের ভাড়া আগে ছিল দৈনিক ১১০০ থেকে ৬০০ রুপি। সেখানে এখন একটি এসি রুমের ভাড়া ১২০০ রুপি, আগে এ কক্ষ দুই হাজার রুপির নিচে দেওয়া হতো না।
তিনি বলেন, "আমরা আর কি করতে পারি? যাই হোক না কেন, ওভারহেড খরচ আছে তা বহন করতে হবে। আমাকে বিদ্যুৎ বিল, ট্যাক্স এবং কর্মীদের বেতন দিতে হবে।"
নিউমার্কেটে সালোয়ার স্যুট বিক্রির শ্রীনগর নামে একটি দোকানে চারজন লোক ছিল। তারা সবাই দোকানের কর্মচারী। ম্যানেজার বলেন, "ব্যবসা ৭৫ শতাংশ কমে গেছে।"
তিনি আরও বলেন, "আগে রমজানের দিনগুলোতে পাগলাটে ভিড় দেখা যেত। দোকান কাস্টমারে ভরা থাকতো। আর ১০ জন ক্রেতার মধ্যে সাতজনই থাকতেন বাংলাদেশি।"
মারকুইস স্ট্রিটে শাড়ি ও স্যুটের জন্য বিখ্যাত শামসি ফ্যাশন নামের দোকানটি বন্ধ হয়ে গেছে।
দোকানের মালিক কামরুদ্দিন মল্লিককে জিজ্ঞেস করলে বলেন, "আমাকে মাসে আড়াই লাখ রুপি দোকান ভাড়া দিতে হতো। আর অন্যান্য আরও ওভারহেড খরচ ছিল আড়াই লাখ রুপি। ব্যবসা না হলে কীভাবে আমি মাসে পাঁচ লাখ রুপি খরচ করতে পারি?"
মারকুইস স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, কিড স্ট্রিট, সাডার স্ট্রিট, রফি আহমেদ কিদওয়াই রোড এবং নিউমার্কেটের আশেপাশের এলাকাগুলোতে বাংলাদেশ থেকে আসা দর্শনার্থীতে আদতে মুখরিত হবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।
এসব এলাকার শাড়ির দোকান, শেরওয়ানি এবং সালোয়ার স্যুটের দোকান, বাংলা খাবারের হোটেল, গেস্ট হাউস, ট্রাভেল এজেন্ট, ট্যুর অপারেটর, কারেন্সি চেঞ্জার এবং এমনকি রাস্তার বিক্রেতারা যারা আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র বিক্রি করে তারা সবাই বাংলাদেশি ক্রেতার উপর নির্ভরশীল।
নির্জন রাস্তা এবং খালি দোকানগুলো এখন ব্যস্ততার বদলে বিষণ্ন বদনে স্থানীয়দের কাছেই পণ্য বিক্রি করছেন।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী খান বলেন, "বেশ কিছু হোটেল মালিক যারা ইজারা নিয়ে হোটেল ব্যবসা শুরু করেছিলেন তারা ভাড়া দিতে না পেরে সম্পত্তি ছেড়ে দিয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যাবে।"
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটি জনপ্রিয় খাবারের দোকান প্রিন্সের মালিক চয়ন সাহা বলেন, তিনি কাঁচামাল কেনার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দিয়েছেন। আমার গ্রাহকদের ৮০ শতাংশই ছিল বাংলাদেশি। এখন, তারা চলে গেছে।
এসময় এক বাংলাদেশি দম্পতির দেখা মেলে। আজিজুর রহমান খান এবং স্ত্রী সোনিয়া শহর ঘুরতে বের হয়েছিলেন। তখন তারা একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন।
আজিজুর বাংলাদেশ থেকে মেডিকেল ভিসায় ভারতে এসেছেন। তার ডায়াবেটিসের অবস্থা বেশ জটিল। তিনি থিয়েটার রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসেছেন। তিনি বলেন, "তিন মাসেরও বেশি সময় অপেক্ষার পর আমরা ভিসা পেয়েছি।"
তিনি ঢাকা থেকে বাসে এসেছেন এবং আজ রোববার ফিরে যাবেন। তিনি বলেন, "বাসটিতে ৪৫টি আসন ছিল কিন্তু মাত্র ২৫টি আসনে যাত্রী আছে।"
মার্কুইস স্ট্রিটের একজন কারেন্সি এক্সচেঞ্জার শ্যামল সাহা এখন প্রতিদিন গড়ে ৩০০ ডলার করে লেনদেন করছেন। গত বছর এ সময় তিনি পাঁচ হাজার ডলারের বেশি লেনদেন করেছেন।
তিনি বলেন, "পর্যটন ভিসা চালু না হলে এ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না।"