এই শহরের নালা-নর্দমায় ঘুরে বেড়ায় কুমিরের দল

নিউইয়র্ক সিটির নালা নিয়ে বহুদিন ধরে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে—সেখানে না-কি অন্ধ, অ্যালবিনো কুমিরেরা ঘুরে বেড়ায়। এই রহস্যময় সরীসৃপেরা শহরের লোককথার অংশ হয়ে উঠেছে। এমনকি নিউইয়র্কবাসীরা প্রতি ফেব্রুয়ারিতে 'অ্যালিগেটর ইন দ্য সুয়ার ডে' উদযাপনও করে।
তবে ফ্লোরিডায় নালায় কুমির থাকা কোনো কল্পকাহিনি নয়। প্রায়ই এ শহরের ড্রেন পাইপে কুমির ঢুকে পড়ে। এইতে জানুয়ারির শেষের দিকে কেপ কোরালে একটি পানি নিষ্কাশন নালায় আটকে থাকা ১০.৫ ফুট লম্বা একটি কুমির উদ্ধার করা হয়েছে।
সব কুমিরই দুর্ঘটনাবশত নালায় ঢুকে পড়ে না। সম্প্রতি আরবান ন্যাচারালিস্ট জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানা গেছে, ফ্লোরিডার এক শহরের স্টর্মওয়াটার ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে যাতায়াতের নিরাপদ পথ হিসেবে ব্যবহার করছে কুমিরসহ প্রায় তিন ডজন প্রাণী। ভূপৃষ্ঠ থেকে বৃষ্টি ও বরফগলা পানি নিষ্কাশনের জন্য এ ধরনের ড্রেন ব্যবহার করা হয়।
গবেষণার প্রধান লেখক ও ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার পিএইচডি গবেষক অ্যালান আইভরি এই বিষয়টিকে 'টিনএজ মিউট্যান্ট নিনজা টার্টলস' সিনেমার দৃশ্যের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, 'ভাবতেই পারিনি সেখানে এত প্রাণী পাওয়া যাবে।'
নালায় ইঁদুরদের উপস্থিতি নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। তবে অন্যান্য প্রাণী সেখানে কী করছে, সে বিষয়ে তথ্য তুলনামূলকভাবে কম। এই ভূগর্ভস্থ জটিল নালা-ব্যবস্থা বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য তৈরি, তবে এটি পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত নয়। ফলে এটি প্রাণীদের জন্য বিকল্প চলাচলের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গবেষকরা ফ্লোরিডার গেইনসভিল শহরের ঝড়ের পানি নিষ্কাশন নালাগুলোতে পর্যবেক্ষণ চালান। ৩৩টি নালায় ম্যানহোলের নিচে মোট ৩৯টি মোশন-সেন্সর ক্যামেরা ক্যামেরা স্থাপন করা হয়।
ক্যামেরাগুলো ৬০ দিনের জন্য রাখা হয়েছিল। তবে সব ক্যামেরা সেই সময় পর্যন্ত টিকতে পারেনি। কিছু প্রবল পানির স্রোতে ভেসে যায়, আবার কিছু প্রাণীদের হাতে পড়ে।

আইভরি বলেন, 'আমরা মাঝেমধ্যে দেখতাম, র্যাকুন ক্যামেরা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে! ওরা মই বেয়ে উঠে ম্যানহোল থেকে ক্যামেরা খুলে ফেলে।'
তবে বেশিরভাগ ক্যামেরাই উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এতে ৩৫টি প্রাণীর প্রায় ৩,৮০০টি উপস্থিতির তথ্য ধরা পড়ে। সাধারণত নালায় ছোট-বড় ইঁদুরের আধিক্য বেশি থাকে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, ওই নালাগুলোতে গেছো ব্যাঙ, আর্মাডিলো এবং ১২টি পাখির প্রজাতিও পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ক্যারোলাইনা রেন নামে ছোট পাখির উপস্থিতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নালায় সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে স্তন্যপায়ী প্রাণী। র্যাকুনের উপস্থিতি ধরা পড়ে প্রায় ১,৮০০ বার। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় মাইটিস বাদুড়, যা প্রায় ৭০০ বার ক্যামেরায় ধরা পড়ে। গবেষকদের ধারণা, এই ছোট বাদুড়গুলো খাবারের সন্ধানে নালার ভেতর ঘুরে বেড়ায়।
কিছু বড় প্রাণী, যেমন হরিণ ও বনবিড়ালকে নালার প্রবেশপথের আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে, তবে খুব কমসংখ্যক প্রাণী ভেতরে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম কুমির।
গবেষক দলটি নালায় ৫০টি কুমিরের উপস্থিতি নথিভুক্ত করে। বেশিরভাগ কুমির জলাশয়ের মধ্যে চলাচলের জন্য নালাকে পথ হিসেবে ব্যবহার করছিল, তবে কিছু কুমিরকে নালার বন্ধ প্রান্তের দিকে সাঁতার কাটতে দেখা গেছে। গবেষকদের অনুমান, এগুলো সম্ভবত মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়েছিল।
আইভরি বলেন, 'ব্যাপারটা এমন যেন ওরা মাছকে ফাঁদে ফেলতে নালার বন্ধ প্রান্ত ব্যবহার করছে—মানুষের তৈরি অবকাঠামোকে নিজেদের শিকারের কৌশল হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে।'
গবেষকরা যদিও শুধুমাত্র গেইনসভিল এলাকার নালা নিয়ে কাজ করেছেন, তবে তারা মনে করেন, ফ্লোরিডার অন্যান্য শহরেও একইভাবে বিভিন্ন প্রাণী নালা ব্যবহার করে। এমনকি বিপন্ন ফ্লোরিডা প্যানথারের জন্য ব্যস্ত সড়ক পারাপারের সুবিধার্থে বিশেষ টানেলও নির্মাণ করা হয়েছে।

মন্ট্রিয়লের কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যান্ডস্কেপ ইকোলজি গবেষক জোচেন জ্যাগার আগে থেকেই ধারণা করেছিলেন, কিছু প্রাণী ঝড়ের পানি নিষ্কাশন নালা ব্যবহার করে। তবে নতুন গবেষণাটি দেখিয়েছে, শহুরে প্রাণীরা এসব মানবসৃষ্ট অবকাঠামো কতটা কার্যকরভাবে নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগাচ্ছে।
ড. জ্যাগার নিজেও কালো ভাল্লুক ও মুস হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর জন্য হাইওয়ের নিচে থাকা কালভার্টের মতো পথগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি মনে করেন, প্রায়শই প্লাবিত হয়ে যাওয়া এসব টানেলে শুকনো চলাচলের ব্যবস্থা তৈরি করলে বন্যপ্রাণীদের জন্য তা আরও সহায়ক হবে।
আইভরি ও তার সহগবেষকরা মনে করেন, একইভাবে ফ্লোরিডার ঝড়ের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে। গবেষণা চলাকালে তারা দেখেছেন, ভারী বৃষ্টির সময় সাপ ও ব্যাঙ প্রায়ই নালায় ভেসে যায় এবং অনেক সময় বের হতে সমস্যায় পড়ে। নালার প্রবেশপথের কাছে ছোট ছোট র্যাম্প বসালে এরা সহজেই বেরিয়ে আসতে পারবে।
এই পরিবর্তন নালার অন্যান্য বাসিন্দাদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ম্যানহোলের নিচে ঝুলে থাকা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় মাইটিস বাদুড়গুলোর জন্য বের হওয়ার বাড়তি পথ না থাকলে তারা বিপদে পড়তে পারে। শহরের কৃত্রিম পরিবেশে উপযুক্ত গুহার অভাবের কারণে ইতোমধ্যেই কিছু বাদুড়ের সংখ্যা কমছে।
আইভরি বলেন, 'নালাগুলো যদি কৃত্রিম আশ্রয় হিসেবে কাজ করে, তবে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যদি কোনো বাদুড় সেখানে আশ্রয় নেয় এবং ঠিক তখনই বন্যা হয়, তবে তারা পানির স্রোতে ভেসে যেতে পারে।'