দাবা খেলা যেভাবে ভারতের একটি গ্রামকে মদ, জুয়া থেকে বাঁচিয়েছে

ফোন, মানিব্যাগ আর আধখাওয়া চায়ের কাপগুলো এলোমেলোভাবে টেবিলে পড়ে আছে। পাশে দুই প্রতিযোগীর দাবা খেলা ঘিরে ভিড় জমেছে। দৃশ্যটি দক্ষিণ ভারতের এক চায়ের দোকানের।
প্রতিযোগীদের একজন ১৫ বছরের গৌরীশঙ্কর জয়রাজ। তিনি চোখ বেঁধে খেলছেন। এর অর্থ, তার মনে একটি কল্পিত দাবার বোর্ড রয়েছে, যা তিনি প্রয়োজনমতো ব্যবহার করেন।
তার প্রতিপক্ষ বেবি জন, বয়সে বেশ বড়। তবে তার মুখে স্পষ্ট অস্বস্তির ছাপ। কাঁধের ভঙ্গি আর চাপা ঠোঁট বলছে, আর কয়েকটি চালের মধ্যেই তার হার নিশ্চিত। এটি হলে ৪০ মিনিটের মধ্যে চতুর্থবারের মতো হারতে হবে তাকে।
জন বলেন, 'গৌরীশঙ্কর মাত্র ১৫ বছর বয়সি, কিন্তু অসাধারণ প্রতিভাবান দাবাড়ু। চোখ বাঁধা অবস্থাতেও সে আমাকে হারিয়ে দেয়।'
জয়রাজ ও জন ভারতের কেরালা রাজ্যের ত্রিশূর জেলার পশ্চিমঘাটের পাদদেশে অবস্থিত মারোত্তিচাল গ্রামের বাসিন্দা। ছয় হাজার জনসংখ্যার এই গ্রাম ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে 'ভারতের দাবা গ্রাম' নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। কারণ এখানে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই অন্তত একজন দাবায় দক্ষ।
গ্রামজুড়ে বাসস্টপের যাত্রীছাউনি, মুদি দোকানের সামনে কিংবা খেলার মাঠে নিয়মিত দাবার প্রতিযোগিতা হয়। মারোত্তিচাল দাবা সমিতির সভাপতি জন জানান, গ্রামের ৭৫ শতাংশ বাসিন্দা দাবায় পারদর্শী।
বিশ্ব দাবা ফেডারেশনের (এফআইডিই) হিসাবে জয়রাজ ভারতের সক্রিয় শীর্ষ ৬০০ দাবাড়ুর একজন। গত সেপ্টেম্বরে ভারত দাবা অলিম্পিয়াড ২০২৪-এ ওপেন ও নারী বিভাগে স্বর্ণপদক পায়। ডিসেম্বরে দেশের সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার গুকেশ ডোম্মারাজু (১৮) বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন। একই মাসে গ্র্যান্ডমাস্টার কোনেরু হাম্পি 'এফআইডিই উইমেনস ওয়ার্ল্ড র্যাপিড চেস চ্যাম্পিয়নশিপ' জেতেন। ফলে ভারতীয় দাবার জন্য এটি ছিল এক বিজয়ের বছর।
বর্তমানে এফআইডিই র্যাঙ্কিংয়ে জয়রাজের অবস্থান ২০১২। বিশ্বনাথন আনন্দ ও ডোম্মারাজুর পথ অনুসরণ করে তিনিও গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
চার দশক আগে এই গ্রাম ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতায়। মদ্যপান ও জুয়ার কারণে গ্রামের বহু পরিবার ধ্বংসের মুখে পড়ে।

সত্তরের দশকে মারোত্তিচালের কয়েকটি পরিবার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য বাদাম থেকে অ্যালকোহল তৈরি করত। কিন্তু আশির দশকের গোড়ায় গ্রামটি অবৈধ মদ উৎপাদনের আঞ্চলিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।
গ্রামের বাসিন্দা জয়রাজ মানাঝি বলেন, 'লোকজন শুধু মদ খেত না, নিজের বাড়িতেই তা তৈরি ও বিক্রি করত।' কৃষকেরা ফসল উৎপাদন ছেড়ে মদ বানানো ও জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। আয়ের পথ সংকুচিত হতে থাকায় দারিদ্র্য চরমে পৌঁছে যায়। অনেক শিশু জামাকাপড় ছাড়াই দিন কাটাত, কেউবা থাকত না খেয়েই।
এই পরিস্থিতিতে আশার আলো হয়ে আসেন চারালিয়াইল উন্নিকৃষ্ণান। আশির দশকের শেষ দিকে তিনি গ্রামে ফেরেন।
যৌবনে মাওবাদী আন্দোলনে জড়িয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন উন্নিকৃষ্ণান। পরে আন্দোলন ছেড়ে তিরিশের কোঠায় তিনি গ্রামে ফিরে একটি চায়ের দোকান দেন। তবে গ্রামবাসীর মাদকাসক্তি তাকে পীড়া দিতে থাকে।
পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়ে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপর গ্রামে মদ তৈরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের স্ত্রী ও মায়েদের একত্রিত করেন তিনি।
কয়েক মাস ধরে তিনি ও তার সহযোগীরা রাতের আঁধারে মদের আস্তানায় হানা দিতেন। গোপন মজুত ও সরঞ্জাম নষ্ট করতেন। বাধার মুখেও দমেননি, কারণ গ্রামের একাংশ তাদের সমর্থন করছিল।
এসব অভিযানের পর উন্নিকৃষ্ণান গ্রামবাসীদের দাবা খেলার আমন্ত্রণ জানাতেন।
বেবি জন আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার জন্য তহবিল সংগ্রহ করেন। স্কুল পাঠ্যক্রমে দাবাকে অন্তর্ভুক্ত করতে প্রচার চালান। তিনি বলেন, 'দাবাই আমাদের একত্র করেছে। এটি নিয়ে আলোচনার ফলে মানুষ মদের আসর ছেড়ে খেলায় মন দেয়।'
উন্নিকৃষ্ণান চায়ের দোকানে শুধু চা নয়, ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা বলতেন। দাবার মাধ্যমে গ্রামকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।
কিছুদিনের মধ্যেই দাবার বোর্ড পুরো গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। মদাসক্তরা দাবা বোর্ডের চারপাশে বসতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে মদ ও জুয়া ছেড়ে তারা দাবার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন।
উন্নিকৃষ্ণান প্রায় ১,০০০ গ্রামবাসীকে দাবা শিখিয়েছেন। এমনকি তিনি নিজেও আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ডমাস্টারদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। বর্তমানে মারোত্তিচালের তরুণ দাবাড়ুরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন।
২০১৬ সালে মারোত্তিচাল ইউনিভার্সাল রেকর্ডস ফোরামের 'ইউনিভার্সাল এশিয়ান রেকর্ড' অর্জন করে। এশিয়ার মধ্যে একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি অপেশাদার দাবাড়ু থাকার জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়।

জন বলেন, '৬৭ বছর বয়সি উন্নিকৃষ্ণান আজ মারোত্তিচালে রাজা ও ত্রাতা হিসেবে পরিচিত।'
দাবা যেভাবে জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে
জুয়ার বিপরীতে দাবায় সুযোগের প্রায় কোনো ভূমিকা নেই। এটি একেবারেই দক্ষতানির্ভর খেলা। যে খেলোয়াড় সেরা চালগুলো দেয়, সেই জয়ী হয়। এতে হার-জিতের জন্য দুর্ভাগ্যকে দায়ী করার সুযোগ নেই।
উন্নিকৃষ্ণান দাবা সম্পর্কে সরাসরি কিছু না বললেও স্বীকার করেন যে খেলাটি মারোত্তিচালে মদ্যপান ও জুয়া কমিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তিনি এটিকে 'বড় ধরনের প্রভাব' বলেই মনে করেন।
বিশ্বজুড়ে দাবাকে আসক্তি নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক বিকারের চিকিৎসায় সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। স্পেনে মাদক, অ্যালকোহল ও জুয়া আসক্তদের পুনর্বাসন কার্যক্রমে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের মনোবিজ্ঞানী রোজি মিকস বলেন, 'কারাগারে দাবা ক্লাব চালু করলে বন্দিদের মধ্যে সহিংসতা কমবে, তারা যোগাযোগসহ নানা দক্ষতা গড়ে তুলতে পারবেন এবং অবসর সময় ইতিবাচক কাজে ব্যয় করতে পারবেন।'
মারোত্তিচালে দাবার ইতিবাচক প্রভাব জায়েম ভাল্লুরের মতো গভীরভাবে খুব কম মানুষই অনুভব করেছেন। ৫৯ বছর বয়সি ভাল্লুর মারোত্তিচাল চেস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও অন্যতম উদ্যমী খেলোয়াড়।
পঁচিশ বছর আগে এক ভয়াবহ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন ভাল্লুর। দুই মাস লাইফ-সাপোর্টে থাকার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
তার বন্ধুরা হাসপাতালে দাবার বোর্ড নিয়ে আসতেন। দাবা খেলা তার মানসিক দক্ষতা উন্নত করতে সহায়ক হয়। বর্তমানে শুধু তার ডান হাত অবশ রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, 'দাবা আমাকে জীবনে ফিরিয়ে দিয়েছে।'
২০২৩ সালে এই গল্প চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক কবীর খুরানার নজরে আসে। তিনি 'দ্য প্যান অফ মারোত্তিচাল' নামে ৩৫ মিনিটের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যেখানে গ্রামবাসীদের আসক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও পুনরুদ্ধারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।