ভূপৃষ্ঠের নিচে হাইড্রোজেনের বিশাল মজুত আবিষ্কার

বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠের নিচে হাইড্রোজেন গ্যাসের বিশাল মজুত খুঁজে পেয়েছেন। সম্প্রতি সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভের করা এক গবেষণা থেকে এই তথ্য জানা যায়।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন উত্তোলন করা গেলে, তা শক্তির চাহিদা পূরণে একটি নতুন, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই সহায়ক হতে পারে।
পরিবেশবান্ধব শক্তির অপ্রতূলতা জলবায়ু সংকটের মূল সমস্যা বলে আলোচিত। তাই দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব শক্তির সন্ধানে গবেষণা চালিয়ে আসছেন। এ অবস্থায় পৃথিবী পৃষ্ঠের নীচে লুকিয়ে থাকা হাইড্রোজেনের এই বিশাল মজুত আবিষ্কার রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
তবে প্রশ্ন হলো এই নতুন শক্তির উৎস আসলে কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে?
পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভূ-রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সময় ভূগর্ভস্থ হাইড্রোজেন গঠিত হয়। এখন পর্যন্ত এটি পৃথিবীর কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে পাওয়া গেছে, যেমন- আলবেনিয়া ও মালি।
সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে, এই হাইড্রোজেন মজুত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে।
গবেষকরা মনে করছেন, যদি আমরা এই ভূগর্ভস্থ হাইড্রোজেনের মাত্র ২ শতাংশও উত্তোলন করতে পারি, তবে তা আমাদের ১.৪ × ১০^১৬ জুল শক্তি সরবরাহ করবে।
শুনে মনে হতে পারে এটা অনেক বেশি পরিমাণ শক্তি, তবে আসলে এটি সারা পৃথিবীর মানুষের ৩৫ মিনিট ব্যবহৃত শক্তির সমান।
তবে, এই পরিমাণ শক্তি পৃথিবীর সমস্ত প্রাকৃতিক গ্যাসের রিজার্ভের দ্বিগুণ। গবেষকরা বলছেন যে এটি নেট-জিরো কার্বন লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হতে পারে।
বর্তমানে মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বা ইলেকট্রোলাইসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হাইড্রোজেন উৎপন্ন হয়। এতে প্রচুর পানি ব্যবহার হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চ কার্বন ফুটপ্রিন্ট সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে, ভূগর্ভস্থ হাইড্রোজেন উত্তোলন তুলনামূলক কম কার্বন নিঃসরণ করবে। যদিও এখন পর্যন্ত মালি ছাড়া আর কোথাও এটি উত্তোলন করা হচ্ছে না।
নতুন গবেষণার জন্য, মার্কিন জিওলজিক্যাল সার্ভের গবেষকরা একটি মডেল তৈরি করেছেন, যার সাহায্যে পৃথিবীজুড়ে এই হাইড্রোজেন রিজার্ভের আকার অনুমান করা গেছে।
এই মডেল অনুযায়ী, পৃথিবীর পৃষ্ঠের নিচে ৫.৬ × ১০^৬ মেট্রিক টন (যা ৩.৭ মিলিয়ন গাড়ি বা ১.৫৬ বিলিয়ন ফ্লামিঙ্গোর সমান ওজন) হাইড্রোজেন থাকতে পারে।
তবে এখনই সারা পৃথিবীতে এই হাইড্রোজেন উত্তোলনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত কি না- এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত নন।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল)- এর ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞানী প্রফেসর বিল ম্যাকগুয়াইর [তিনি এই গবেষণায় জড়িত ছিলেন না] বিবিসি সায়েন্স ফোকাস-কে বলেছেন, 'এভাবে এত বড় পরিসরে হাইড্রোজেন উত্তোলন করে যদি আমরা কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং জলবায়ু সংকট সমাধান করতে চাই, তবে তার জন্য একটি বিশাল বৈশ্বিক উদ্যোগের প্রয়োজন হবে, বাস্তবে আমাদের হাতে এত সময় নেই।'
তিনি বলেন, 'এটি বাস্তবায়ন করতে বিপুল পরিমাণ সহায়ক পরিকাঠামো প্রয়োজন হবে। যেমন- রিগ, অ্যাক্সেস রোড, স্টোরেজ, পরিবহন ইত্যাদি। তাছাড়া আমরা যদিও জানি কতটা হাইড্রোজেন রয়েছে, কিন্তু ভূগর্ভের ঠিক কোন কোন স্থানে এই মজুত রয়েছে, তা এখনও পুরোপুরি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়নি।'
তিনি আরও বলেন, 'এছাড়া বাতাস ও সূর্য থেকে যে পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়, তা দিয়ে আমরা সহজেই আমাদের শক্তির চাহিদা পূরণ করতে পারি। এছাড়া এই প্রযুক্তি সহজ, পরীক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই আমাদের সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে আরও একটি সীমিত শক্তির উৎসকে কাজে লাগানোর দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।'
তাই যদিও এই বিপুল ভূগর্ভস্থ হাইড্রোজেনের উৎস আবিষ্কার অনেক বড় অর্জন, তবে এটি কি জলবায়ু সংকটের সমাধান করতে পারবে কি না, তা এখনও এক বড় প্রশ্ন।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি