স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ৪.৫২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ পাকিস্তান থেকে ফেরত আনার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার

১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদ থেকে ন্যায্য হিস্যা হিসেবে ৪.৫২ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই দাবির মধ্যে রয়েছে তহবিল, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন খাতের অর্থ।
দীর্ঘ ১৫ বছর পর দুই দেশের মধ্যে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে এই দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করা হবে। বৈঠকটি আগামী ১৭ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, এই দাবির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পাঠানো ২০ কোটি ডলারের বৈদেশিক সহায়তা।
কর্মকর্তারা জানান, এই অর্থ স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঢাকা শাখায় থাকলেও, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ব্যাংকটির লাহোর শাখায় স্থানান্তর করা হয়।
এছাড়াও, স্বাধীনতার পর পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত বহু বাংলাদেশি সরকারি কর্মকর্তা নিজ দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তারা দেখতে পান, পাকিস্তান সরকার তাদের জমাকৃত প্রভিডেন্ট ফান্ড ও সঞ্চয়পত্রের অর্থ আর ফেরত দেয়নি।
এই অর্থগুলোও ৪.৫২ বিলিয়ন ডলারের মোট দাবির অংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত বিস্তারিত প্রমাণ সংগ্রহ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই দাবি উপস্থাপনের জন্য একটি সুসংহত ভিত্তি তৈরি করেছে, যেখানে বকেয়া অর্থের বিভিন্ন উপাদান স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই ইস্যুটি চলতি মাসের শেষ দিকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকেও আলোচনায় আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত ২৭ মার্চ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও অর্থ বিভাগের সচিবকে এক চিঠি পাঠায়, যেখানে দাবি-সংক্রান্ত বাকি থাকা যেকোনো প্রয়োজনীয় নথিপত্র জরুরি ভিত্তিতে পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়।
চিঠির একটি অনুলিপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর হাতে এসেছে।
পূর্বের দাবি
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সর্বশেষ পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১০ সালে। সেবারও ঢাকা অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদ থেকে ন্যায্য হিস্যা দাবি করে। সেই সঙ্গে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ এবং আটকে পড়া পাকিস্তানিদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের দাবি জানায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আত্মসাৎ করা ২০ কোটি ডলারের ঘূর্ণিঝড় সাহায্যের অর্থ ফেরতের দাবি বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই জানিয়ে আসছে। এর পাশাপাশি, অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদ থেকে প্রায় ৪.৩২ বিলিয়ন ডলারের ন্যায্য হিস্যার দাবিও বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে করে আসছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি অনুযায়ী, কেবল জনসংখ্যার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদের ৫৬ শতাংশের অংশীদার ছিল। বিদেশি মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশের অবদান বিবেচনায় নিলে এই হিস্যা দাঁড়ায় ৫৪ শতাংশে। আর যে কোনো সমতার নীতি অনুসরণ করলেও বাংলাদেশ অন্তত ৫০ শতাংশের দাবি জানাতেই পারে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্থিতি ভিত্তিক একটি হিসাব করেছিল বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন। ওই হিসাব অনুযায়ী, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানি সরকারি কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড জমা বাবদ ৯০ লাখ টাকা আটকে রেখেছিল।
এছাড়াও, যুদ্ধকালীন সময় রূপালী ব্যাংকের করাচি শাখায় রাখা ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকাও আর ফেরত দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে পাকিস্তান ওই অর্থ শেয়ারে রূপান্তর করে রূপালী ব্যাংককে বিষয়টি জানালেও, কখনো কোনো লভ্যাংশ দেয়নি।
বাংলাদেশ পরে ওই শেয়ার বিক্রি করে অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করলেও, তাতে কোনো সাফল্য মেলেনি।
বাংলাদেশ তার দায়িত্ব পালন করেছে
আরও অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান সরকারের বিক্রি করা বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র ও বন্ডের দায় পরিশোধ করেছে, যেমন প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র এবং আয়কর বন্ড। এই ঋণগুলো পাকিস্তান সরকারের কাছে পাওনা বলে মনে করছে বাংলাদেশ।
'স্টেটমেন্ট অব বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লেইমস রিসিভেবল ফ্রম স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান এন্ড গভার্নমেন্ট অব পাকিস্তান' শিরোনামের প্রতিবেদনে বিস্তারিত হিসাব দেওয়া হয়েছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতি অর্থের মোট মূল্য ছিল ৮৭০.৫৮ কোটি রুপি, যার অন্তত অর্ধেকের দাবিদার বাংলাদেশ। শুধু পাকিস্তানের ব্যাংকিং বিভাগকেই বাংলাদেশকে ৫৯.৬৩ কোটি রুপি পরিশোধ করতে হবে।
বিস্তারিত হিসাব করলে, ক্যাপিটাল পেইড আপ এর ৫০ শতাংশ হিসেবে ৮৮ লাখ রুপি, স্ট্যাচুটরি ফান্ডস (আইনগত তহবিল) এর ৫০ শতাংশ হিসেবে ২২.৬২ কোটি রুপি, ব্যালান্স হেল্ড আউটসাইট পাকিস্তান (পাকিস্তানের বাইরে রাখা অর্থ) এর ৫০% হিসেবে ৬.০৭ কোটি রুপি এবং অন্যান্য অ্যাসেট (সম্পদ) থেকে ২৭.৫৮ কোটি রুপি পাওনা রয়েছে বাংলাদেশের।
বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের কিছু ঋণ সিকিউরিটিজের ২১.৩৮ কোটি টাকা দায় নিয়েছে, যার ওপর ঢাকা দাবি করতে পারবে।
এছাড়াও, বাংলাদেশ ১৯৭১ সাল পূর্ববর্তী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক ইস্যু করা ২১.৩৮ কোটি টাকার ঋণ সিকিউরিটিজের দায়ও গ্রহণ করেছে।
এর মধ্যে রয়েছে– কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণ হিসেবে ১৪.০৭ কোটি টাকা, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ঋণ হিসেবে ২.৭৭ কোটি টাকা, পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের ঋণ হিসেবে ১.১৫ কোটি টাকা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ইউনিট বিনিয়োগের বিপরীতে ইস্যু করা সঞ্চয়পত্র হিসেবে ২.৪৬ কোটি টাকা এবং পাকিস্তানি প্রাইজ বন্ডের সাথে যুক্ত সঞ্চয়পত্র হিসেবে ৬.৫৮ কোটি টাকা।