মহাকাশে আটকা পড়েছেন দুই নভোচারী, নাসার এই বিজ্ঞানী তাদের বেদনা উপলব্ধি করতে পারেন

ফ্রাঙ্ক রুবিও যখনই এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে মহাকাশে আটকে থাকার মানসিক কষ্ট নিয়ে কথা বলেন, তার মুখে খানিকটা হলেও হতাশা ফুটে ওঠে। যদিও এটি একজন ডাক্তার, সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার পাইলট এবং নাসার মহাকাশচারীর প্রশিক্ষিত সংযমের বিরোধী।
২০২২ সালে তাকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া রাশিয়ান মহাকাশযানটির একটি লিকিং রেডিয়েটরের কারণে, তার সেখানে থাকার সময়সীমা ছয় মাসের পরিবর্তে এক বছরেরও বেশি বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
তার ছেলে যখন হাই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করে এবং বড় মেয়ের কলেজে প্রথম বছর পার করছে, তিনি তখন এই পৃথিবী থেকে বহুদূরে ছিলেন।
এর আগেও তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু সেবারের অনুভূতি ছিল একেবারে অন্যরকম।
রুবিও বলেন, 'একজন বাবা হিসেবে আপনি এসব মিস করছেন জানতে পারাটা কিছুটা হতাশার।'
তার পরিবার পৃথিবীতে থ্যাংকসগিভিং এবং ক্রিসমাস উদযাপন করছিল, আর তিনি তখন একঘেয়েমিতে ভুগতে ভুগতে এবং মহাকাশের প্রভাবে সৃষ্ট শারীরিক সমস্যাকে সঙ্গী করে নাসার তৈরি করা খাবার খেয়ে সময় কাটিয়েছেন।
মহাকাশে রুবিওর আটকে থাকার অভিজ্ঞতার মতোই অভিজ্ঞতা হচ্ছে বর্তমানে মহাকাশ স্টেশনে আটকে থাকা নাসার দুই নভোচারীর।
ব্যারি 'বুচ' উইলমোর এবং সুনিতা 'সুনি' উইলিয়ামস বোয়িংয়ের স্টারলাইনার ক্যাপসুলটি পরীক্ষা করার কাজ করেছিলেন, এটি নাসার জন্য তৈরি একটি নতুন মহাকাশযান। প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে তাদেরও পৃথিবীতে ফেরার পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হয়েছে।
স্টারলাইনার সফলভাবে তাদের স্পেস স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিল, কিন্তু হিলিয়াম লিক এবং থ্রাস্টারগুলোর ত্রুটির কারণে নাসা এটি ব্যবহার করে তাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার ব্যপারে ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়ে।
আর তাই এই দুই নভোচারী আট দিনের পরিকল্পিত মিশনে গিয়ে, আট মাসেরও বেশি সময় ধরে মহাকাশে আটকে রয়েছেন।
নাসা ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাদের সেখানে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওইসময় একটি স্পেসএক্স ড্রাগন মহাকাশযানে তারা পৃথিবীতে ফিরতে পারবে।

নাসা এখন পর্যন্ত স্টারলাইনারকে আরেকবার উৎক্ষেপণের সিদ্ধান্ত নেয়নি।
৮ নভেম্বর নাসার পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার জিমি রাসেল বলেন, স্টারলাইনারের ফ্লাইট সমস্যার কারণ কী তা এখনও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পরবর্তীতে মহাকাশযানের সিস্টেম, বিশেষত তার প্রপালশন সিস্টেমের 'আপগ্রেড এবং উন্নয়ন' পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ শুরু করার পরিকল্পনা করেছে।
এ বিষয়ে অবগত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বোয়িং স্টারলাইনার বিক্রি করার কথা ভাবছে। প্রতিষ্ঠানটি এই প্রকল্পে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি লোকসান করেছে।
জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন এটি কিনতে পারে।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘ সময় মহাকাশ স্টেশনে থাকা আমেরিকান রুবিও। টানা ৩৭১ দিন মহাকাশে থাকার রেকর্ড রয়েছে তার।
তবে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়ার মির মহাকাশ স্টেশনে ৪৩৭ দিন কাটিয়ে আসা রাশিয়ান মহাকাশচারী ভ্যালেরি পলিয়াকভের তুলনায় তার অবস্থান নগণ্য।
নাসা এবং তার মহাকাশচারীরা জানিয়েছেন, তাদের প্রশিক্ষণের সময় মিশনে কোনো ভুল হলে কি ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে তা নিয়ে বারবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
স্টারলাইনার ক্রুদের অবস্থা সম্পর্কে রুবিও বলেন, 'আমি মনে করি এটি স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে এটি কোনো আনন্দদায়ক পরিস্থিতি নয়। আমরা সবাই মানুষ। সুতরাং আপনি যখন আট থেকে ১৫ দিনের মিশন আশা করছেন এবং আপনি খবর পাচ্ছেন যে এটি দীর্ঘ হতে চলেছে, তা মেনে নেওয়া সবার ক্ষেত্রেই কঠিন।'
মহাকাশে মানুষের জীবন
মহাকাশ শরীর এবং মনের ওপর কঠিন প্রভাব ফেলে।
রুবিও যেমন বলেছেন, 'এটি মানুষের বিচরণ করা সবচেয়ে প্রতিকূল পরিবেশ।'
শূন্য-মাধ্যাকর্ষণে বসবাসকারী মানুষেরা প্রায়ই তীব্র মাথাব্যথায় ভোগেন। তাদের শরীরে 'ফ্লুইড শিফট' হলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে এবং শরীরের কিছু অংশ ফুলে যেতে পারে। তাদের প্রতিদিন অন্তত দুই ঘণ্টা ব্যায়াম করতে এবং নিয়মমাফিক জীবনযাপন করতে হয়, যাতে মহাকাশে যাওযার পর প্রথম কয়েক মাসে শারিরীক দুর্বলতা থেকে বাঁচতে পারেন।
এছাড়া আছে একঘেয়েমি। মহাকাশচারীরা ১৩ হাজার ৭০০ ঘন ফুটের একটি আন্তঃসংযুক্ত হলওয়েতে বাস করেন, যা সাধারণত ছয় ফুটের বেশি উঁচু বা প্রশস্ত নয়।
পৃথিবীতে পাঠানো চমৎকার ছবিগুলোর বেশিরভাগই 'কুপোলা' নামে পরিচিত একটি ছোট ঘর থেকে তোলা এবং মহাকাশচারীরা সেখানে খুব কম সময় কাটান।
রুবিও বলেন, 'আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে অবিশ্বাস্য সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন, তবে আপনি প্রতিদিন একই জায়গায় আবদ্ধ, যে স্থানটি মূলত কম্পিউটার আর তারের দেওয়াল।'

তিনি বলেন, 'আপনি কুপোলার বাইরে প্রতিদিন শুধুমাত্র কয়েক মিনিটের জন্য দেখতে পাবেন… তাই একঘেয়েমির সঙ্গে আপনাকে লড়াই করতেই হবে। এক্ষেত্রে আপনাকে বারবার নিজের বিরক্তি ও একঘেয়ে অনুভূতি ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে হবে, কারণ এটি আপনার দায়িত্ব।'
ওয়েস্ট পয়েন্ট থেকে গ্র্যাজুয়েট করা রুবিও মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার পাইলট হিসেবে কাজ করেছেন। পরে তিনি নাসার মহাকাশচারী প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, মহাকাশে থাকার কষ্ট সেনাবাহিনীতে কাজ করা অনেকের অভিজ্ঞতার চেয়ে তুলনামূলক ভালো।
তিনি উদাহরণ হিসেবে সামরিক যুদ্ধবন্দির কথা উল্লেখ করেন।
রুবিও বলেন, 'আপনি ওই পরিস্থিতিগুলো ভাবলে, নিজের জন্য তেমন দুঃখ হবে না।'
৪৮ বছর বয়সী রুবিও এখনও নাসার মহাকাশচারী হিসেবে হিউস্টনের জনসন স্পেস সেন্টারে কাজ করছেন।
তিনি জানান, কোনো একদিন আবারও তার মহাকাশে ফিরে যাওয়ার আশা রয়েছে।
কেউ কেউ মনে করেন মহাকাশচারীদের মহাকাশে দীর্ঘ সময় থাকার একটি ইতিবাচক দিক রয়েছে।
নাসা যদিও তাদের অগ্রাধিকার হিসেবে মহাকাশচারীদের চাঁদ থেকে পৃথিবীতে ফেরানোর পরিকল্পনা করছে, তবে স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক বলেছেন, তিনি ২০২৮ সালে একটি স্পেসএক্স স্টারশিপ মহাকাশযানে মহাকাশচারীদের মঙ্গল গ্রহে পাঠাতে চান। মানুষের শূন্য-গ্রাভিটি অবস্থায় থাকার সময় সীমা পরীক্ষা করতে এই মিশন চালানো হবে।
লকহিড মার্টিনের সাবেক প্রধান নির্বাহী নরম্যান অগাস্টিন বলেন, 'মহাকাশে দীর্ঘসময় থাকার অভিজ্ঞতা মঙ্গল গ্রহের মিশনের জন্য খুব সহায়ক।'
কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহাকাশ স্টেশনটি একটি চলমান, কয়েক দশক দীর্ঘ চিকিত্সা অধ্যয়নের পরীক্ষাগার হিসেবে কাজ করছে। মহাকাশচারীর মহাকাশে থাকা সময়ের বিস্তারিত তথ্য মানবদেহ কিভাবে দীর্ঘ সময় ধরে শূন্য-গ্রাভিটি অবস্থায় টিকে থাকে; তা বোঝার জন্য সহায়ক।
রুবিও বলেন, 'আগামী কয়েক দশক ধরে সেখানে যাওয়া প্রতিটি ব্যক্তি সেই তথ্য সংগ্রহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হবে।'
নাসা জানিয়েছে, সুনিতা ও উইলমোর মহাকাশ স্টেশনে তাদের প্রথম ছয় মাসে ৬০টিরও বেশি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সহায়তা করেছেন।
নাসা আরও জানিয়েছে, সুনিতা স্পেস স্টেশনে প্রথম ধাতব থ্রিডি প্রিন্ট তৈরিতে অবদান রেখেছেন। এছাড়া তারা দুজনেই কম-গ্রাভিটিতে থাকা অবস্থায় গাছে পানি দেওয়া এবং বায়ুচলাচল করার একটি পদ্ধতির ওপর কাজ করেছেন।
মনুষ্যবাহী মহাকাশযাত্রার পরবর্তী লক্ষ্য কী?
বোয়িংয়ের স্টারলাইনার ছাড়া নাসার কাছে তার নভোচারীদের মহাকাশ স্টেশনে আনা-নেওয়ার জন্য দুটি বিকল্প রয়েছে। তারা রাশিয়ার সোইজ মহাকাশযানে যেতে পারে, অথবা স্পেসএক্সের ড্রাগন ক্যাপসুলের ওপর নির্ভর করতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সংস্থাটি মহাকাশ স্টেশনে নভোচারীদের আনা-নেওয়া করতে আরেকটি আমেরিকান মহাকাশযান চায়।
তবে বোয়িংয়ের স্টারলাইনার কখনো সেই মিশন পুরোপুরি সম্পাদন করতে পারবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। হিলিয়াম লিক এবং থ্রাস্টার সমস্যার কারণ সম্পর্কে নাসা ও বোয়িং এখনও কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনটির আয়ুষ্কাল ইতোমধ্যে প্রাথমিক পরিকল্পনার চেয়ে ১০ বছরের বেশি সময় বাড়ানো হয়েছে, শত শত খুচরা যন্ত্রাংশ তাদের ব্যবহারযোগ্য জীবনকালের চেয়েও বেশি সময় কাজ করছে, যদিও রাশিয়ার দিক থেকে বাতাস লিক করছে। এর মেয়াদ আর বাড়ানো না হলে, ২০৩১ সালে এটি বাতিল হয়ে যাবে।
নাসা আশা করছে, এরপরে তারা একটি বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত মহাকাশ স্টেশন স্থাপন করতে পারবে।
গত সেপ্টেম্বর মাসে একটি লাইভ স্ট্রিমে উইলিয়ামস এবং উইলমোরকে দেখা যায়।
সেসময় তারা বলেছেন, প্রযুক্তিগত সমস্যার জন্য বোয়িংকে তারা দায়ী করেন না।
এমনকি উইলমোর বলেছেন, যেকোনো পরীক্ষামূলক ফ্লাইটে অপ্রত্যাশিত সমস্যা ঘটতে পারে।
পরিবারের সঙ্গে সময় না কাটাতে পারা সম্পর্কে ফক্স নিউজ রিপোর্টারের করা প্রশ্নের জবাবে উইলমোর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছেন, তার মেয়েদের তাকে ছাড়া বাঁচার এই অভিজ্ঞতা, তাদেরকে মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার একটি অনন্য সুযোগ দেবে।
অন্যদিকে সুনিতা বলেছেন, মহাকাশ তার 'খুশির স্থান'।
তিনি বলেছেন, তার স্বামী, মা এবং কাছের বন্ধুরা এটি ভালোভাবে বোঝেন।
তিনি তার দুইটি কুকুরকেও মিস করেন বলেও জানান।
পরিকল্পনার পরিবর্তনের বিষয়টি তার পরিবার কীভাবে মোকাবিলা করেছে- এ বিষয়ে তিনি বলেছেন: 'আমরা দুজনেই নেভির সদস্য, আমরা দুজনেই ডিপ্লয়মেন্টে গিয়েছি, যখন ডিপ্লয়মেন্ট পরিবর্তন হয়, তখন আমরা অবাক হই না... আমাদের পরিবারও এর সঙ্গে অভ্যস্ত।'
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি