মঙ্গল গ্রহ একসময় ছিল উষ্ণ ও ভেজা, নতুন প্রমাণ পেল নাসার রোভার

মঙ্গলগ্রহের পৃষ্ঠে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার রোভার যে পাথর খনন করেছে, তাতে প্রচুর পরিমাণে এক ধরনের খনিজ পদার্থ 'সিডারাইট' পাওয়া গেছে। এই আবিষ্কার থেকে গ্রহটির অতীতের উষ্ণ ও সিক্ত আবহাওয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারে নতুন প্রমাণ মিলেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই সময় মঙ্গলে বড় বড় জলাধার ছিল এবং সেখানে জীবনের অস্তিত্বও থাকতে পারত।
নাসার কিউরিওসিটি রোভার ২০১২ সালে মঙ্গলে অবতরণ করে। এর মূল লক্ষ্য ছিল—মঙ্গল কোনোদিন মাইক্রোবিয়াল বা এককোষী জীবনের উপযোগী পরিবেশ ধারণ করেছিল কি না, তা অনুসন্ধান করা। ২০২২ ও ২০২৩ সালে রোভারটি গেইল ক্রেটারে তিনটি জায়গায় খনন করে সিডারাইটের উপস্থিতি শনাক্ত করে। গেইল ক্রেটার একটি বিশাল প্রভাবগহ্বর, যার মাঝখানে একটি পর্বত রয়েছে।
সিডারাইট হলো আয়রন কার্বনেট জাতীয় খনিজ। এটি মূলত কয়েক বিলিয়ন বছর আগের তলছাপাথরে পাওয়া যায়। এই খনিজের উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে, এক সময় মঙ্গলে ঘন এবং কার্বন ডাই–অক্সাইডসমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল ছিল। এই গ্যাস গ্রিনহাউজ প্রভাব সৃষ্টি করে মঙ্গলের তাপমাত্রা বাড়াতে সহায়ক হয়, যা তার পৃষ্ঠে তরল পানির অস্তিত্ব রক্ষার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে।
মঙ্গলের ভূ–প্রকৃতিতে এমন বহু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলো দেখে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এক সময় গ্রহটির পৃষ্ঠে নদী, হ্রদ এমনকি সমুদ্রও ছিল। এসবই ইঙ্গিত দেয়, হয়তো এক সময় সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল।
পৃথিবীর মতো মঙ্গল ও শুক্র গ্রহেও কার্বন ডাই–অক্সাইডই মূল গ্রিনহাউজ গ্যাস। এটি সূর্যের তাপ শোষণ করে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়ায়। তবে এতদিন মঙ্গলের অতীতে ঘন কার্বন ডাই–অক্সাইডসমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডলের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, অজানা কোনো কারণে যখন মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল পাতলা হয়ে পড়ে এবং তাতে কার্বনের পরিমাণ কমে যায়, তখন ভূ–রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সেই কার্বন বিভিন্ন খনিজে রূপান্তরিত হয়ে গ্রহটির ভূত্বকে জমে থাকে—যেমন এই সিডারাইট খনিজে।
কিউরিওসিটি রোভার পাথরের যে নমুনা সংগ্রহ করেছে, তা ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার গভীর থেকে নেওয়া। এতে দেখা যায়, নমুনার ওজনের প্রায় ১০ দশমিক ৫ শতাংশই সিডারাইট। এই বিশ্লেষণ কিউরিওসিটির একটি ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার করে করা হয়।
এই গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক ও ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ–রসায়নবিদ বেঞ্জামিন টুটলো বলেন, 'মঙ্গলের জলবায়ু এবং বাসযোগ্যতার বিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—যদি সত্যিই মঙ্গলকে উষ্ণ রাখতে অনেক বেশি কার্বন ডাই–অক্সাইড প্রয়োজন হতো, তাহলে এখন পর্যন্ত তার খুব অল্প পরিমাণ খনিজ প্রমাণ আমরা কেন পাচ্ছি?'
তিনি বলেন, 'মডেল অনুযায়ী, কার্বনেট খনিজগুলো মঙ্গলের পৃষ্ঠে অনেক জায়গাতেই থাকার কথা। কিন্তু এতদিন ধরে রোভার এবং স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণে এর খুব সামান্য উপস্থিতিই ধরা পড়েছে।'
রোভারের যেসব পাথর বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তার মতো পাথর মঙ্গলের অন্যান্য স্থানেও শনাক্ত হয়েছে। গবেষকদের ধারণা, সেসব জায়গাতেও হয়তো প্রচুর কার্বনেট খনিজ রয়েছে এবং এগুলোর মধ্যেই আটকে রয়েছে অতীতের কার্বন ডাই–অক্সাইড।
গেইল ক্রেটারের বালু ও কর্দমাক্ত পাথরগুলো প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে এক হ্রদের তলদেশে জমা হয়েছিল বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। পরে মঙ্গলের আবহাওয়া ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে তা নির্জীব ও কঠোর পরিবেশে রূপ নেয়।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্টেরা ইনস্টিটিউটের গ্রহবিজ্ঞানী ও এই গবেষণার সহ–লেখক এডউইন কাইট বলেন, 'মঙ্গলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিবেশগত বিপর্যয় হলো—এক সময়ের বাসযোগ্য পৃষ্ঠ ধীরে ধীরে জীবহীন হয়ে যাওয়া।'
তিনি বলেন, 'আমরা এখনো জানি না কেন এই পরিবর্তন ঘটল। তবে এটা স্পষ্ট যে, এক সময় মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল ছিল ঘন এবং কার্বন ডাই–অক্সাইডে সমৃদ্ধ। তাই বোঝা জরুরি যে সেই কার্বন কোথায় গেল। নতুন পাওয়া এই খনিজ সে প্রশ্নের জবাবে বড় সূত্র হতে পারে।'
রোভারের এই আবিষ্কার প্রাচীন মঙ্গলের কার্বন চক্রের বিষয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিচ্ছে। পৃথিবীতে যেমন আগ্নেয়গিরি থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গত হয়ে তা সমুদ্রে মিশে চুনাপাথর গঠন করে, পরে প্লেট টেকটনিকের মাধ্যমে সেই পাথর আবার উত্তপ্ত হয়ে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ছাড়ে—মঙ্গলে সে প্রক্রিয়াটি নেই, কারণ সেখানে প্লেট টেকটনিকস নেই।
টুটলো বলেন, 'আমরা যে কার্বন চক্র মঙ্গলে দেখছি, তা অসমতা পূর্ণ। মানে, যতটা কার্বন ডাই–অক্সাইড খনিজে পরিণত হয়ে জমা হয়েছে, তার সামান্যই পরে বায়ুমণ্ডলে ফিরে এসেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের এই বিশ্লেষণ এখন মঙ্গলের জলবায়ু পরিবর্তনের মডেলে যুক্ত করা যাবে এবং এই অসম কার্বন চক্র কীভাবে মঙ্গলের বাসযোগ্যতা রক্ষা করেছে বা হারিয়েছে, তা আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে।'