কে-পপ, কে-সিনেমা, একটি নোবেল পুরস্কার, এবার আসছে কে-পোয়েট্রি

দক্ষিণ কোরিয়ার সাহিত্যের প্রতি ক্রমবর্ধমান চাহিদায় সর্বশেষ ও সবচেয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে আলোচিত বই হলো ৭২ বছর বয়সী কবি লি সেওং-বকের লেখা বই 'ইনডিটারমিনেট ইনফ্লোরেসেন্স'। জ্ঞানগর্ভ বাণী সম্বলিত এ সংকলনটি অন্য কবিদের ধীরস্থির ভাবে পরামর্শ দেওয়ার মতো উদ্দীপ্ত করে যাচ্ছে।
লি সেওং-বকের এ বইটিতে তেমনই একটি পরামর্শ হলো, "শব্দের বিরুদ্ধে এমনভাবে লড়াই করো যেভাবে তুমি দোলনায় পা দিয়ে পিছনে ঠেলে দাও। তখন তোমার এমন একটি অনুভূতি হবে যেন তোমার পা আকাশ স্পর্শ করছে।"
গত বছর আমেরিকার একটি ক্ষুদ্র প্রেস থেকে বইটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়। প্রত্যাশিতভাবে সেই অনুবাদের বই খুব দ্রুতই বিক্রি হয়ে যায়। যার কারণে আরও চারবার বইটি পুনর্মুদ্রণ করতে হয়। এখন বিশ্বের অন্যতম বড় প্রকাশক পেঙ্গুইন তাদের অ্যালেন লেন ইমপ্রিন্টের মাধ্যমে আগামী নভেম্বরে বইটির একটি ইংরেজি বড় সংস্করণ প্রকাশ করতে যাচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ পর এ সংবাদটি এসেছে। হান কাং কেবল প্রথম কোরিয়ান নন বরং প্রথম এশীয় নারী যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন।
৫৩ বছর বয়সী হানের উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে দ্য ভেজিটেরিয়ান এবং হিউম্যান অ্যাক্টস। তিনি নোবেল পাওয়ার পর বিশ্বব্যাপী তার বইয়ের বিক্রি অনেক বেড়ে গেছে। পুরস্কার ঘোষণা হওয়ার পর তার এক মিলিয়নেরও বেশি বই বিক্রি হয়েছে।
যখন সুইডিশ একাডেমি তার নোবেল জয়ের খবর জানায়, হানের প্রথম ইচ্ছাই ছিল দেশের জন্য গৌরব দাবি করা।
হান কাং বলেন, "আমি কোরিয়ান সাহিত্যের সঙ্গে বড় হয়েছি। একে আমার খুবই আপন মনে হয়। তাই আমি আশা করি এ খবরটি কোরিয়ান সাহিত্য পাঠক এবং আমার বন্ধু ও লেখকদের জন্য খুবই সুখকর।"
তার নোবেল বিজয়ের পর বর্তমানের সাহিত্যের বাজারে দক্ষিণ কোরিয়ার গল্পগুলোর প্রতি পাঠকের আকর্ষণ বাড়ছে।
সাম্প্রতিক বেস্টসেলার বইগুলোর মধ্যে রয়েছে- হাওয়াং বো-রেউমের লেখা ওয়েলকাম টু দ্য হিউনাম-ডং বুক ক্লাব; চো নাম-জুর লেখা কিম জিয়ং, বর্ন্ ১৯৮২ ও বারাক ওবামার ২০১৭ এবং কোরিয়ান-আমেরিকান মিন জিন লি লেখা পাচিনকো।
এছাড়া ইন-পিয়ং সনের হিট বই আলমন্ড এ বছরই প্রকাশিত হয়েছিল। তারই আরেকটি উপন্যাস 'কাউন্টারঅ্যাটাকস অ্যাট থার্টি: এ নভেল' আগামী বছর প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।
তাই আগামী ১৪ নভেম্বর লি সেওং-বকের ৪৭০টি কাব্যিক অন্তর্দৃষ্টির সংকলন প্রকাশের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতির ঢেউ আরেকটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এক দশক আগে কে-পপ সঙ্গীতের মাধ্যমে ব্রিটেনে কোরিয়ান সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করতে শুরু করে।
মজার বিষয় হলো, এখন এই কবির বইটির ভক্তদের মধ্যে বিটিএস ব্যান্ডের সদস্যরাও রয়েছেন। কোরিয়ার তরুণদের সঙ্গীত প্রবণতা যেমন জনপ্রিয় হয়েছে, তেমনি নেটফ্লিক্সের হিট সিরিজ স্কুইড গেম, পুরস্কারজয়ী চলচ্চিত্র প্যারাসাইট এবং ডিসিশন টু লিভ-এর মতো প্রভাবশালী দক্ষিণ কোরিয়ার টেলিভিশন নাটকের সফলতার মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতি সমানভাবে বিস্তৃত হয়েছে। এখন প্রকাশনা জগতও এই নতুন জোয়ারে প্রবেশ করেছে।
পুরস্কারজয়ী সুইডশ অনুবাদক অ্যান্টন হার বেস্টসেলার 'আই ওয়ান্ট টু ডাই বাট আই স্টিল ওয়ান্ট টু ইট ট্টকবোককি-এর অনুবাদ করার জন্য পরিচিত। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের এক দোকান থেকে লি সেওং-বকের সংকলনটি আবিষ্কার করেন এবং পড়ে তৎক্ষণাৎ মোহিত হন।
পরে তিনি ঝুঁকি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল-ভিত্তিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সাবলুনারিকে বইটি প্রকাশ করার জন্য রাজি করান। শীঘ্রই উদ্ধৃতিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। লি এর এসব উদ্ধৃতির প্রশসংকারীদের মধ্যে ঔপন্যাসিক আরও কওন থেকে শুরু করে র্যাপার কিম নাম-জুন পর্যন্ত রয়েছেন। তাছাড়া অ্যান্টন হার বলেছেন, বাজারটি দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। গত বছর পর্যন্ত প্রতি বছরই ১০ বা তার থেকেও বেশি কোরিয়ান বই ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে।
লি সেওং-বক মধ্য দক্ষিণ কোরিয়ার উত্তর গিয়ংসাং প্রদেশের একটি শহর স্যাংজুতে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি বর্তমানের কোরিয়ার অন্যতম বিশিষ্ট এবং খ্যাতিমান জীবিত কবি। তিনি ৩০ বছর ধরে কবিতা লেখা শিখিয়ে আসছেন। তার ছাত্ররা তার গত ১০ বছরের অনুপ্রেরণামূলক চিন্তাধারাগুলোকে সংকলিত করেছেন। এগুলো সর্বপ্রথম কোরিয়াতে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়।
সাবলুনারি প্রকাশনার প্রকাশক জোশ রথস স্বীকার করেছেন, বইটির প্রশংসা দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। তবে তিনি পরে বুঝতে পেরেছিলেন, কেন একজন লেখালেখিতে আগ্রহী ব্যক্তি এটি নিজের সংগ্রহে রাখতে চাইবে।
তিনি বলেন, "আমি ধারণাই করতে পারিনি যে বইটি ভাইরাল হয়ে যাবে। আমি যখন প্রথমবার এটি পড়েছিলাম তখন বইটিতে একদমই নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম।"
তিনি আরও বলেন, "বইটি আমাকে একজন লেখক এবং সম্পাদক হিসেবে জাগিয়ে দিয়েছিল। এবং এটাই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই আমি শুধু জানতাম, বইটি অবশ্যই প্রকাশ করতে হবে।"
লি সেওং-বকের অনেক উক্তিই কবিতার মতো মনে হবে। আবার অন্যগুলো মনে হবে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করছে। যেমন: "যদি তুমি কেবল যুক্তির ওপর নির্ভর করো, তাহলে তুমি আবেগ হারিয়ে ফেলবে। একটি স্তরকে উপেক্ষা করলে কবিতাটি তাহলে আর প্রাকৃতিক থাকে না, হয়ে যায় স্তব্ধ কিংবা প্রভাবিত।"
পেঙ্গুইনের প্রকাশক ক্লোই কারেন্স মনে করেন বইটি শুধু লেখক ও কবিদের জন্য একটি ম্যানুয়াল নয়। তিনি বলেন, "লি সিওং-বক একজন কবি। তবে যারা অনুপ্রেরণাহীন কিংবা আটকে গেছেন এমন যেকোনো সৃজনশীল ব্যক্তির কাছে লিয়ের কবিতা পৌছে যাবে। এর ক্ষমতা এটাই যে এটি মৌলিক।"
ক্লোই কারেন্স আরও বলেন, "আমি মনে করি, বইটি পাঠকদের আনন্দ দেয় কারণ এটি পৃথিবী এবং এর প্রাণীদের প্রাণবন্ত রূপে উপস্থাপন করে। তাছাড়া এটির পাঠককে বিস্মিত করার ক্ষমতাও রয়েছে। আমি এখন পর্যন্ত এমন আর কোনো বই দেখিনি। এ বইয়ের কবিতাগুলো প্রার্থনা থেকে শুরু করে বিন লাদেনকে আটক বা গলফ খেলার মতো বিষয়গুলোর সঙ্গেও যুক্ত করতে পারে।"
অনুবাদ: সাদিয়া আফরিন রেনেসাঁ