৮০ বছর বয়সী মাথার ভেতরে কী ঘটছে?

গত সপ্তাহে ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প এবং ৮১ বছর বয়সী বাইডেনের বিতর্কের পর মোটামুটি সবাই একমত যে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বয়স বেড়েছে। সেদিন তাকে দেখতে অনেক 'বয়স্ক ও দুর্বল' মনে হয়েছে। তার প্রত্যুৎপন্নমতিতা এবং বুদ্ধিমত্তা বেশ খানিকটা ফিকে মনে হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো বয়স আসলে মস্তিষ্কের কী ক্ষতি করে?
ফরচুন এ বিষয়ে আরও পরিষ্কার চিত্র পেতে বার্ধক্য সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে।
কর্টেক্স অবিশ্বাস্যরকম সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজির অধ্যাপক এবং হেলদি এজিং অ্যান্ড আলঝেইমার্স রিসার্চ কেয়ার সেন্টারের পরিচালক এমিলি রোগালস্কি ফরচুনকে বলেন, 'বার্ধক্যের ফলে মস্তিষ্কে অনেক পরিবর্তন ঘটে। এর মধ্যে একটি হলো মস্তিষ্কের বাইরের স্তর বা কর্টেক্সের সংকোচন।'
তিনি ব্যাখ্যা করেন, কর্টেক্স কোনো গাছের ওপরে থাকা ছালের মতো, মস্তিষ্কের কোষগুলোর ওপর প্রলেপ হিসেবে এটি থাকে।
তিনি বলেন, 'এটি আমাদের চিন্তাভাবনা এবং যোগাযোগের জন্য সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।'
তিনি আরও বলেছেন, স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত অংশে এর সঙ্কোচন ঘটে এবং এর ফলে স্মৃতিশক্তিতে প্রভাব পড়ে।
বিশ্বাস করুন বা না করুন, মস্তিষ্কের এই কার্যকারিতা ২০ বছর থেকে ৩০ বছরের শুরু পর্যন্ত সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে। কর্টেক্স সংকোচনের ফলে মনোযোগ এবং কার্যকারিতার দক্ষতাও ঝুঁকিতে পড়ে।
রোগালস্কি বলেছেন, 'এসব জিনিস আন্তঃসম্পর্কিত। কারণ কিছু মনে রাখার জন্য আপনার ভাল মনোযোগ থাকা দরকার। আমাদের মস্তিষ্কের একেকটা অংশ দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন না। এমনটা না যে একপাশে স্মৃতি থাকবে এবং আরেকপাশে মনোযোগ থাকবে এবং এদের মধ্যে কোনো মিথস্ক্রিয়া হবে না। সবমিলিয়ে এটি একটি জটিল সিস্টেম।'
বয়সের কারণে স্মৃতিশক্তি হ্রাস স্বাভাবিক
রাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড বিহেভিয়ারাল সায়েন্সের অধ্যাপক এবং রাশ আলঝেইমার্স ডিজিজ সেন্টারের নিউরোসাইকোলজিস্ট প্যাট্রিসিয়া বয়েল বলেন, ম্যাকনাইট ব্রেইন রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ আমেরিকান বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হ্রাসের বিষয়ে উদ্বিগ্ন।
বয়েল ফরচুনকে বলেন, 'তবে অনেকেই জানেন না যে বয়সজনিত স্মৃতিশক্তি হ্রাস মানেই গুরুতর রোগের লক্ষণ নয়। বেশিরভাগ মানুষ বুঝতে পারে না, বয়সজনিত স্মৃতিশক্তি হ্রাসের কারণে অনেকের শুধুমাত্র হালকা ভুলে যাওয়ার মতো প্রভাব পড়ে। মস্তিষ্কের বয়স বাড়ার একটি স্বাভাবিক প্রভাব এটি এবং এমনটা হওয়া মানেই গুরুতর কোনো স্মৃতি সমস্যা ভেবে দুশ্চিন্তা করার মানে হয় না।'
তার মতে স্বাভাবিক বার্ধক্যের কিছু লক্ষণ নিম্নরূপ:
- মাঝে মাঝে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া
- সময়ের হিসাব ভুলে যাওয়া
- কথা বলার সময় সঠিক শব্দ খুঁজে না পাওয়া
- প্রয়োজনীয় জিনিস কোথায় রেখেছেন তা মনে না থাকা।
বয়েল বলেন, 'বার্ধক্যজনিত শারীরিক পরিবর্তনগুলো যেমন স্বাভাবিক, তেমনি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধিমত্তায় প্রভাব পরাও স্বাভাবিক। যেমন: বয়স বাড়লে আমরা আস্তে-ধীরে চলাফেরা করি বা শরীরে ব্যথা-বেদনা বেড়ে যায়।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কের সংকোচন বাড়ে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের মস্তিষ্কের আয়তন হ্রাস পেতে থাকে। প্রায় ৬০ বছর বয়সে ফ্রন্টাল লোব এবং হিপ্পোক্যাম্পাসসহ মস্তিস্কের বৃদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত অংশগুলোয় সংকোচনের হার বৃদ্ধি পায়।
রোগালস্কি ব্যাখ্যা করেন, 'বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা আমাদের অনেক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলি। তবে আমাদের মনে রাখা উচিত কোমড় বা হাঁটুর হাড়ের মতো মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের সুযোগ নেই।'
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি মেলম্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের হেলথ পলিসি অ্যান্ড এজিং: ডিমেনশিয়া অ্যান্ড মাইল্ড কগনিটিভ ইমপেয়ারমেন্ট (এমসিআই) এর অধ্যাপক ড. জন রো বলেন, '৬৫ বছরের বেশি বয়সী ১২ থেকে ১৮ শতাংশের মধ্যে বয়সজনিত পরিবর্তন ঘটে।'
তিনি বলেন, প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় এই পরিবর্তনের যে প্রভাবগুলো পড়ে: মানুষ আরও বেশি ভুলে যায়, জিনিস হারিয়ে ফেলে, সময়ের কাজ সময়ে করতে পারে না প্রভৃতি।
জন রো আরও বলেন, প্রতি বছর প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হয়।
তবে কিছু মানুষ অধিক বয়সেও দুর্দান্ত পারফর্ম করছেন
রোগালস্কি জোর দিয়ে বলেন, বার্ধক্যের এই অমোঘ যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো কেবল কি ভুল হচ্ছে তা নিয়ে না ভেবে, নতুন সুযোগ নিয়ে ভাবা।
তিনি বলেন, 'বার্ধক্যের একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হলো বার্ধক্যজনিত অকর্মণ্যতার অপবাদ মেনে নেওয়া। বয়স অনুযায়ী ব্যক্তির প্রতি আমাদের প্রত্যাশার মাত্রা পরিবর্তন করা উচিত। অনেক সময় আবার মানুষটি যতটুকু করতে পারে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা তার সেই দায়িত্ব নেওয়া ও কাজকর্ম করার অধিকার টুকুও কেড়ে নিই।'
তিনি আরও বলেন, আধুনিক, বিলাসবহুল জীবন-যাপনের এটি অন্যতম সমস্যা। এখানে রুম পরিষ্কার থেকে কাপড় ধোয়া কোনো কিছুর জন্যই আর আগের মতো কায়িক শ্রম দিতে হয় না। অথচ আমরা যে দৈনন্দিন কাজগুলো করি, যেমন: থালা-বাসন ধোয়া বা হাঁটা প্রভৃতি দেহের পেশীগুলোকে শক্তিশালী রাখার জন্য সত্যিই উপকারী।
একইভাবে, আমাদের মস্তিষ্ককে কাজে ব্যস্ত রাখা এবং সক্রিয় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্নভাবে এটি করা যেতে পারে। যেমন: সামাজিকভাবে মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার মাধ্যমে, কিংবা নতুন কিছু শেখার মাধ্যমে।
তবে আমরা বয়স্কদের শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে যতটা ভাবি, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ততটা ভাবি না। শরীরচর্চার মতো করে আমরা আমাদের মস্তিস্ককে সক্রিয় রাখতে পারি। বিভিন্ন সুক্ষ্ম ও সৃজনশীল বিষয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেও মস্তিস্কেকে সক্রিয় রাখা যায়।
আমরা যদি এসব কাজ বন্ধ করে দিয়ে ভাবি আমরা বিশ্রাম নিচ্ছি, এটি হবে মস্ত ভুল।
রো জোর দিয়ে বলেন, 'তবে অনেক ব্যতিক্রম রয়েছে। আমরা দেখেছি বয়স্কদের অনেকে খুব উচ্চ পর্যায়ের বৌদ্ধিবৃত্তিক পারফর্ম করছেন। এরা এক ধরনের সুপারএজার।'
সুপারএজার হয়ে উঠুন...
রোগালস্কি সুপারএজিং রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে তার গবেষণার মাধ্যমে, জীববিজ্ঞান, পারিবারিক ইতিহাস এবং জীবনযাত্রার দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করেছেন।
তিনি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন কি এমন কারণ, যার কারণে কিছু মানুষের মস্তিস্কের বয়স তেমন বাড়ে না।
তিনি বলেন, 'আমরা দেখেছি জৈবিকভাবেই সুপারএজাররা অন্যদের থেকে আলাদা। ৮০ বছর বয়সী সুপারএজারের মস্তিষ্ক দেখতে ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের মতো। অর্থাৎ, তাদের মস্তিষ্কের সংকোচনের হার গড় ৮০ বছর বয়সীদের তুলনায় ধীর।'
তিনি আরও বলেন, 'সুতরাং মনে হয় কিছু একটা তাদের মস্তিষ্কের বাইরের স্তর বা কর্টেক্সের পাতলা হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে মোকাবিলা করছে। আমরা পরিমাপ করে দেখতে পাই, সুপারএজার মস্তিষ্কে আসলে ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের চেয়ে খুব বেশি সংকোচনা দেখা যায় না।'
প্রকৃতপক্ষে, মস্তিষ্কের সিঙ্গুলেট কর্টেক্স (এসিসি) নামে একটি অঞ্চল রয়েছে। অনুপ্রেরণা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সংবেদনশীল ও পরিস্থিতিগত সংকেত প্রদানে মস্তিস্কের এই অংশটি ভূমিকা রাখে। এটি সুপারএজারদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের তুলনায় বেশি ঘন।
তারা এসব মানুষেরা মস্তিষ্কে ভন ইকোনোমো নিউরন নামে একটি নিউরনের প্রাচুর্য আবিষ্কার করেছেন, যা বিজ্ঞানীদের সুপারএজারদের বোঝার জন্য একটি 'বায়োলজিক পাথওয়ে' পেতে সহায়তা করে।
কয়েক বছর আগে রো ফরচুনকে বলেছিলেন, তিনি একটি গবেষণা নেটওয়ার্ক চালাতেন, যারা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সফল বার্ধক্য' নিয়ে গবেষণা করেছিল।
একটি গবেষণায় তিনি ছয় বছর ধরে ৭৫ বছর বয়সী একটি দলকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। সেই সময়ের মধ্যে তাদের শারীরিক ও বুদিধমত্তা পরীক্ষা করেছিলেন।
রো বলেন, 'শেষ পর্যন্ত এদের মধ্যে ২৫ শতাংশের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি, ৫০ শতাংশের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে এবং বাকিরা মাঝখানে রয়ে গেছে।'
তিনি বলেন, দেখা গেছে যারা সবচেয়ে ভাল কাজ করেছেন সেসব সুপারএজারদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন: একা না থাকা, জ্ঞানার্জন এবং অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা থাকা প্রভৃতি।
ধরুন আপনি যদি আজ একদল ৮০ বছর বয়সী মানুষের জ্ঞানীয় দক্ষতার মূল্যায়ন করেন, আপনি মিশ্র ফলাফল পাবেন। হতে পারে এর মধ্যে একটি বা দুটি দম্পতি ডিমেনশিয়ায় ভুগছে, একজন বা দুজন সুপারএজার এবং বাকিরা মধ্যম।
এটি শুধু মানুষের মস্তিষ্কের ভিন্ন হারে পরিবর্তিত হওয়ার কারণেই নয়, জীবনধারা, জেনেটিক্স এবং অন্যান্য কারণেও এই পার্থক্য তৈরি হয়।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি