১ বছরের বেশি সময় মহাকাশে থাকলে শরীরের কী পরিবর্তন ঘটে?

মার্কিন নভোচারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিদিন মহাকাশে অবস্থান করেছেন নাসার নভোচারী ফ্রাংক রুবিও। তিনি ৩৭১ দিন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) কাটান।
এর আগে কোনো মার্কিন নভোচারী সর্বোচ্চ একটানা ৩৫৫ দিন মহাকাশে কাটিয়েছিলেন। ফ্রাংক রুবিও আইএসএস-এ থেকে পৃথিবীকে পাঁচ হাজার ৯৬৩ বার প্রদক্ষিণ করেছেন। সবমিলিয়ে তিনি ভ্রমণ করেছেন ২৫ কোটি ৩৩ লাখ কিলোমিটার।
তবে মহাকাশে একটানা সবচেয়ে বেশি সময় অবস্থানের রেকর্ড রাশিয়ান নভোচারী ভ্যালেরি পলিয়াকভের। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝিতে তিনি মির মহাকাশ স্টেশনে ৪৩৭ দিন কাটিয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে অভিকর্ষের পরিমাণ খুবই কম। তাই এত দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে অবস্থান করলে মানবদেহে কী কী পরিবর্তন তৈরি হয়, তা নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছে বিবিসি।
পেশি ও হাড়ে পরিবর্তন
শরীরের ওপর অভিকর্ষের নিরবচ্ছিন্ন টান না থাকায় মহাকাশে মানবদেহের পেশি ও হাড়ের ঘনত্ব দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় পিঠ, ঘাড়, পা ও কোয়াড্রিসেপের পেশি — কারণ অতি অল্প পরিমাণ অভিকর্ষের কারণে এগুলোকে পৃথিবীর মতো বেশি কাজ করতে হয় না।
আইএসএস-এ কেবল দুই সপ্তাহ পরেই পেশির ঘনত্ব ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। আর ছয় মাস অবস্থান করলে এ হার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

একইভাবে পৃথিবীর তুলনায় আইএসএস-এ তথা মহাকাশে নভোচারীর কঙ্কালকে বেশি চাপ সইতে হয় না, ফলে দেহের হাড়ের ঘনত্ব ও দৈর্ঘ্য দুটোই কমে যায়। মহাশূন্যে নভোচারীদের হাড়ের ঘনত্ব প্রতি মাসে ১ থেকে ২ শতাংশ এবং ছয় মাসে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।
পৃথিবীতে ফেরার পর হাড়ের ঘনত্ব আবার স্বাভাবিক হতে অনেক সময় চার বছরও লেগে যেতে পারে।
এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নভোচারীরার প্রতিদিন প্রায় আড়াই ঘণ্টা করে আইএসএস-এ ব্যায়াম ও প্রশিক্ষণে সময় ব্যয় করেন। এছাড়া তাদের খাবারদাবারেও বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়।
অভিকর্ষ যেহেতু শরীরকে নিচের দিকে টেনে রাখে না, তাই মহাকাশে দীর্ঘদিন অবস্থান করলে নভোচারীরা লম্বায় খানিকটা বাড়েন। কারণ অভিকর্ষজ টানের অভাবে তাদের মেরুদণ্ড কিছুটা সম্প্রসারিত হয়। এর ফলে মহাকাশে পিঠে ব্যথা এবং পৃথিবীতে এলে কশেরুকার ডিস্ক সরে যেতে পারে।
ওজন হ্রাস
আইএসএস-এ অতি অল্প পরিমাণে অভিকর্ষ থাকে। তবে সেখানে আটকে না রাখলে যেকোনো বস্তুই চারপাশে ভেসে বেড়ায় — হোক সেটা এক টুকরো পালক বা মানবদেহ। ফলে আইএসএস-এ শরীরের ওজন স্বাস্থ্যকর রাখা মহাকাশচারীর জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে।
যদিও নাসা নভোচারীর ওজন ধরে রাখার জন্য নানা ধরনের পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা রেখেছে, তারপরও মহাশূন্যের স্বল্প অভিকর্ষ মানবদেহে প্রভাব রাখতে পারে। নাসা'র নভোচারী স্কট কেলি একটি গবেষণার অংশ হিসেবে আইএসএস-এ ৩৪০ দিন সময় কাটান। ওই সময় তার জমজ ভাই পৃথিবীতে ছিলেন। দেখা যায়, কেলি মহাশূন্যে থাকার সময় তার শরীরের ৭ শতাংশ ওজন হারিয়েছিলেন।

দৃষ্টিশক্তি
পৃথিবীতে অভিকর্ষ দেহের নিচের দিকে রক্ত প্রবাহে সহায়তা করে। হৃদপিণ্ড ওই রক্ত পাম্প করে আবার ওপরে তুলে নেয়। কিন্তু মহাশূন্যে এ প্রক্রিয়ায় গড়মিল তৈরি হয় (যদিও শরীর এ পরিবর্তনের সঙ্গে কোনোভাবে মানিয়ে নেয়)।
আইএসএস-এ নভোচারীর মস্তিষ্কে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণ রক্ত জমা হতে পারে। এর কিছুটা চোখের পেছনে ও অপটিক স্নায়ুর চারপাশে জমাট বাঁধতে পারে। এতে চোখ ফুলে যায়।
এর ফলে নভোচারীর দৃষ্টিতে পরিবর্তন আসতে পারে। এসব পরিবর্তনের মাঝে রয়েছে দৃষ্টির ধার কমে যাওয়া অথবা চোখের গঠন পাল্টে যাওয়া। পৃথিবীতে ফিরে আসার পর বছর খানেকের মধ্যে এ পরিবর্তনগুলো আবার ঠিক হয়ে যায়। আবার কিছু কিছু পরিবর্তন স্থায়ীও হয়।
শরীরের ব্যাকটেরিয়া
স্কট কেলি পৃথিবীতে ফিরে আসার পর গবেষকেরা দেখেন, তার অন্ত্রে বাস করা ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের মধ্যে আইএসএস-এ যাওয়ার আগের সময়ের তুলনায় বিপুল পরিবর্তন সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য এ পরিবর্তন খুব একটা আশ্চর্যের নয়, কারণ আইএসএস-এ কেলির খাবার পৃথিবীর তুলনায় ভিন্ন ছিল।
এছাড়া মহাকাশ স্টেশনে তার চারপাশে ভিন্ন মানুষেরা উপস্থিত ছিলেন। আমাদের অন্ত্র ও মুখের অনেক মাইক্রোঅর্গানিজম আসে আমাদের চারপাশের মানুষজন থেকে।
ত্বক
মহাকাশে ৩০০ দিনের বেশি সময় থাকার কারণে স্কট কেলির ত্বক আরও বেশি ফরসা হয়ে উঠেছিল। এছাড়া পৃথিবীতে ফেরার পর প্রথম ছয়দিন তার ত্বক খুবই সংবেদনশীল ছিল, ত্বকে ফুসকুড়িও তৈরি হয়েছিল।
জিন
কেলিকে নিয়ে গবেষণার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ পাওনা হলো তার ডিএনএন'র ওপর মহাকাশে অবস্থানের প্রভাব জানতে পারা। মানুষের ডিএনএ'র প্রতিটি সূত্রকের শেষ মাথায় টেলোমিয়ার নামক নিউক্লিওটাইড ক্রম থাকে। মনে করা হয়, এগুলো আমাদের জিনকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে এই টেলোমিয়ার ছোট হতে থাকে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, মহাশূন্য ভ্রমণের কারণে এ টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য বদলে যেতে পারে।
গবেষকেরা দেখেন কেলি ও অন্য নভোচারীদের টেলোমিয়ার স্বাভাবিক অবস্থা থেকে কিছুটা বড় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পৃথিবীতে ফিরে আসার পর অল্প সময়ের মধ্যেই এটি পুনরায় আগের আকৃতিতে ফিরে যায়। তবে এমনটা কেন ঘটে তার উত্তর এখনো বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন বলে জানান কেলি ও তার ভাইকে নিয়ে গবেষণা করা যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সটিরি পরিবেশ ও তেজস্ক্রিয় স্বাস্থ্যের অধ্যাপক সুজান বেইলি।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা
মহাকাশে যাওয়ার আগে, আইএসএস-এ অবস্থানের সময় এবং পৃথিবীতে ফেরার পর স্কট কেলিকে একাধিক টিকা দেওয়া হয়েছিল। পৃথিবীতে ফেরার পর তার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা একইভাবে কাজ করছে দেখতে পান বিজ্ঞানীরা।
তবে বেইলি'র গবেষণায় দেখা গেছে, মহাকাশে দীর্ঘদিন অবস্থান করলে নভোচারীদের দেহে শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা কিছুটা কমে যেতে পারে।