জি-২০ নেতাদের কেন সুতি উত্তরীয় উপহার দিলেন মোদি?

ভারতের নয়াদিল্লিতে গত ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। এ সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে এসেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতারা। সম্মেলনের ফাঁকে রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) সকালে নয়াদিল্লির রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন বিশ্বনেতারা। এসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি খাদির উত্তরীয় পরিয়ে তাদেরকে স্বাগত জানান। ঘিয়ে রঙের এই উত্তরীয় ছিল নরেন্দ্র মোদির বিশ্বমঞ্চে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে তুলে ধরার একটি প্রয়াস।
ভারতের জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৯৪৮ সালে আততায়ীয় হাতে নিহত হন। রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর সময় বিশ্বনেতাদের যে খাদির উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়, এটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।
এদিন নরেন্দ্র মোদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের গলায় হাতে বোনা, সুতির উত্তরীয় পরিয়ে দিতে দেখা গেছে। মোদি, বাইডেন, সুনাক এবং অন্যরা এ উত্তরীয় গলায় জড়িয়ে সবরমতী আশ্রমের সামনে ছবি তোলেন। ভারতজুড়ে গান্ধীর বেশ কয়েকটি আশ্রমের মধ্যে গুজরাটের সবরমতী আশ্রম অন্যতম।
সারা বিশ্বে শান্তি ও অহিংসার বৈশ্বিক প্রতিমূর্তি মহাত্মা গান্ধীর কাছে খাদির উত্তরীয় ছিল স্বনির্ভরতার প্রতীক। স্বদেশী আন্দোলনের সময় আমদানি করা বা ব্রিটিশদের তৈরি পণ্য বয়কট করে ভারতীয়রা নিজেরাই স্থানীয়ভাবে এই কাপড় তৈরি করতেন।
এর মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে, ভারতীয়দের ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার ওপর নির্ভর করার প্রয়োজন নেই, বরং তারা নিজেরাই দেশের শিল্পব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে সক্ষম।

গান্ধী প্রায়ই নিজের পরিধেয় খাদির পোশাক নিজেই চরকায় বুনতেন। পরবর্তীতে এ চরকা হয়ে ওঠে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক।
রোববার রাজঘাটে বিশ্বনেতারা গলায় খাদির উত্তরীয় জড়িয়ে গান্ধীর শেষকৃত্যের স্থান হিসেবে চিহ্নিত উঁচু মার্বেলের প্ল্যাটফর্মের সামনে নীরবে সমবেত হন।
রোববার মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্স-এ (প্রাক্তন টুইটার) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লেখেন, "যেহেতু আজ বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রধানরা একত্রিত হয়েছেন, গান্ধীজির কালজয়ী আদর্শ আমাদের সম্প্রীতিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য সম্মিলিত লক্ষ্যের পথ নির্দেশক হবে।"
ভারতীয় সংস্কৃতিতে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ এক অবিস্মরণীয় ছাপ রেখে গিয়েছে। ভারতীয় রূপির প্রতিটি নোটেই রয়েছে গান্ধীর ছবি; অসংখ্য সরকারি ভবন, জাদুঘর, সড়ক এবং ল্যান্ডমার্ক তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদি গান্ধীকে জি-২০ সম্মেলনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে রাখলেও, তার নিজ দল ভারতীয় জনতা পার্টিতে (বিজেপি) গান্ধী এবং তার আদর্শ নিয়ে জটিলতা রয়ে গেছে।
ভারতের প্রধান হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক রয়েছে, যারা নরেন্দ্র মোদিকেও তাদের একজন সদস্য বলে মনে করে।
আরএসএস হিন্দুত্বের মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত, যা দেশের সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষে কাজ করে এবং স্পষ্টতই ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার পক্ষপাতী। আরএসএস-এর এই আদর্শ মহাত্মা গান্ধীর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।
১৯৪৭ সালে যখন ভারত ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশ ভারতকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত করার দাবি জানিয়েছিল: একটি হলো হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত এবং অন্যটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী এই বিভাজনের বিপক্ষে ছিলেন এবং তিনি সকল ধর্মের মানুষের জন্য অখণ্ড ভারতের কথা বলেছিলেন।
এর এক বছরেরও কম সময় পর নাথুরাম গডসে নামক এক প্রাক্তন আরএসএস সদস্য মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গান্ধীর ঘাতকের বন্দনা করার প্রবণতা দেখা গিয়েছে এবং একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদী আইকন হিসেবে তার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে।
একইসঙ্গে, বিজেপি এবং তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, যিনি ছিলেন গান্ধীর দীর্ঘদিনের মিত্র এবং গুণমুগ্ধ- তাঁর অবদানকে খাটো করে দেখার অভিযোগ রয়েছে।
নরেন্দ্র মোদি অবশ্য নাথুরাম গডসের মতো ঘাতকের বন্দনা করার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশের ভেতরে এবং বাইরে সবসময় মহাত্মা গান্ধীর প্রশংসা করে চলেছেন।
কিন্তু বিরোধী দলের নেতারা রোববার গান্ধীর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানোর বিষয়টিকে মোদির দ্বিমুখী আচরণ বলে অভিহিত করেছেন।
আগামী সাধারণ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে পরাজিত করতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নতুন গঠিত 'ইন্ডিয়া' জোট সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছে, "প্রতিটা আরএসএস-বিজেপি কর্মীর এই ভিডিও দেখা উচিত। আপনাদের হিরো নাথুরাম গডসেই মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল। কয়েক দশক ধরে, আপনারা গান্ধীজির বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছেন। আপনাদের নিজেদের মনই গান্ধীজির প্রতি ঘৃণায় ভরা এবং তাঁর অবদানকে খাটো করে দেখছেন এবং তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছেন।"