ভারতের শীর্ষ নারী কুস্তিগিরেরা কেন রাস্তায় নেমেছেন?

নয়াদিল্লির রাস্তায় অস্থায়ী প্রতিবাদস্থলে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে হাজির হয়েছেন নারীরা, তাদের জিনিসপত্র মশারীর নিচে স্তুপ হয়ে আছে ফুটপাতে। ৮টা নাগাদ তারা রাস্তাতেই শুরু করছেন ট্রেইনিং, কেউ দৌড়াচ্ছেন, কেউবা ড্রিল করছেন তাঁবুর পাশে। তারা ভারতের শীর্ষ নারী কুস্তিগির। যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত রেসলিং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার (ডাউএফআই) প্রেসিডেন্ট ব্রিজভূষণ শরণ সিং এর বিরুদ্ধে আরও শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন এই কুস্তিগিররা। খবর সিএনএন-এর।
ব্রিজভূষণ ভারতের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) একজন রাজনীতিবিদ ও আইন প্রণেতা। এর আগেও তিনি বিতর্কিত মন্তব্য করে ও এক তরুণ রেসলারকে মঞ্চের ওপর চড় মেরে খবরের শিরোনামে উঠে আসেন। তবে তিনি বরাবরই যৌন হয়রানির সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের প্রতিবাদ ও হস্তক্ষেপের পর দিল্লি পুলিশ তার বিরুদ্ধে দুটি কেস দাখিল করে যার মধ্যে যৌন হয়রানির বিষয়টিও রয়েছে।
কিন্তু প্রতিবাদকারীরা ডব্লিউএফআই থেকে তার পদত্যাগ চান এবং তা না হওয়া পর্যন্ত তারা প্রতিবাদ চালিয়ে যাবেন বলে সিএনএনকে জানিয়েছেন।
প্রতিবাদের সহ-নেতা, দু'বারের অলিম্পিয়ান ভিনেস ফোগাট বলেছেন, "আমরা অলিম্পিয়ান, আমরা স্বর্ণপদক জয়ী, আমরা চ্যাম্পিয়ন। এখানে মারাত্মক অবিচার হয়েছে। আমরা দেশের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছি।"
জানুয়ারি মাসে ভারতের ক্রীড়া মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, তারা যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্ত করে দেখবে। কিন্তু তিন মাস অতিবাহিত হলেও সরকার খুব বেশিদূর এগুতে পারেনি বলে অভিযোগ রেসলারদের।
এ বিষয়ে ব্রিজভূষণ বলেন, "আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও দিল্লি পুলিশের ওপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে। আমি তদন্তের জন্য প্রস্তুত আছি।"
তবে, এ বিষয়ে সিএনএন-এর কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
অবহেলার অভিযোগ
ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ ওঠে জানুয়ারি মাসে। তখন এক তরুণীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ খতিয়ে দেখার দাবি জানায় কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় রেসলার।
ভারতীয় অলিম্পিক এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্টের কাছে লেখা এক চিঠিতে শীর্ষ পাঁচজন রেসলার বলেছেন, তারা তরুণ রেসলার, বিশেষ করে নারী খেলোয়াড়দের জন্য 'নিরাপদ ও শঙ্কামুক্ত' জায়গা তৈরি করতে চান। চিঠিটি টুইটারে শেয়ার করা হয়।
চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের একজন হলেন ফোগাট। তিনি দাবি করেছেন, ২০২১ টোকিও অলিম্পিকে মেডেল হাতছাড়া হওয়ায় ব্রিজভূষণ তাকে মানসিক হয়রানি ও নির্যাতন করেছিলেন।
এই চিঠি জনসম্মুখে আসার পর ফোগাট ও অন্যান্যরা ব্রিজভূষণের পদত্যাগ দাবি করে রাস্তায় নামেন। এসময় ডাব্লিউএফআই অভিযোগ অস্বীকার করে। ভারতের ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বিষয়টি দেখার কথা জানায় এবং অভিযুক্তকে কয়েক সপ্তাহের জন্য সরে যেতে বলে। এরপর প্রতিবাদ বন্ধ হয়। কিন্তু তিন মাস অতিবাহিত হলেও ব্রিজভূষণ পদত্যাগ করেননি।
অলিম্পিক পদক জয়ী সাক্ষী মালিক বলেন,"জানুয়ারিতে রেসলারদের অভিযোগ আমলে নেওয়া হয় নি, গভর্নিং বডির প্রাথমিক তদন্তে কোন স্বচ্ছতা ছিলো না। এ জন্যই আমরা আবার রাস্তায় ফিরে এসেছি। আমাদের আসতেই হতো।"
গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের ক্রীড়া মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বলেছেন, ব্রিজভূষণ সিং-এর বিরুদ্ধে একটি 'নিরপেক্ষ তদন্ত' হবে। "মোদি সরকার সব সময় এথলেটদের সাথে আছে। খেলাধুলা ও খেলোয়াড়রাই আমাদের প্রাধান্যের বিষয় এবং আমরা এ ব্যাপারে কোন আপস করবো না।"
বিজেপি'র কয়েকজন মন্ত্রী জনসম্মুখে ব্রিজভূষণকে সমর্থন করে বলেছেন রেসলাররা তাদের অভিযোগের কোন প্রমাণ দিতে পারেন নি।
"পদত্যাগ আমার জন্য কোন সমস্যা নয়। কিন্তু আমি অপরাধী হিসেবে পদত্যাগ করবো না", বলেছেন ব্রিজভূষণ সিং।
রেসলারদের পক্ষে সমর্থন বাড়ছে
শুক্রবার পর্যন্ত প্রতিবাদস্থলে তরুণ-বৃদ্ধ সমর্থকদের ভিড় দেখা গেছে। প্রতিবাদকারীদের সাথে স্থানীয় একদল কৃষকও ততক্ষণে যোগ দেন।
পুরুষরাও তাদের সমর্থন জানাচ্ছে। বলজিৎ সিং নামে একজন জানিয়েছেন, তাদের এ প্রতিবাদের যোগ দিতে তিনি ৮০ কিলোমিটার ভ্রমণ করে এসেছেন। তিনি বলেন, "এই মেয়েদের সাথে যা ঘটেছে তা খুব খারাপ। আমরা এখানে এসেছি তাদের সমর্থন জানাতে, শক্তি যোগাতে। তারা জানুক যে তারা একা নয়। আমরা তাদের সাথে আছি, এবং ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত থাকবো।"
টোকিও অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী নিরাজ চোপড়া টুইটারে জানিয়েছেন, এথলেটদের রাস্তায় দেখতে তার কষ্ট হচ্ছে। "জাতি হিসেবে আমরা প্রত্যেক ব্যক্তির নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ", নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার সাথে বিষয়টি দেখার আহবান জানিয়ে টুইট করেন নিরাজ।
এ প্রতিবাদ নিয়ে ভারতীয় টেনিস খেলোয়াড় সানিয়া মির্জা বলেছেন, "খেলোয়াড় হিসেবে এবং একজন নারী হিসেবে এসব দেখা খুবই কষ্টের।"
প্রতিবাদকারীরা দীর্ঘ অপেক্ষার জন্য প্রস্তুত
ব্রিজভূষণ এখনও ডাব্লিউএফআই এর প্রেসিডেন্ট, কিন্তু ফেডারেশনের নিয়ন্ত্রণ দিন দিন তার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।
গত সপ্তাহে ভারতীয় অলিম্পিক এসোসিয়েশন ঘোষণা দেয়, নতুন নেতা নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ডাব্লিউএফআই চালানোর জন্য দুই সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, "কমিটি আন্তর্জাতিক ইভেন্টে ক্রীড়াবিদদের নির্বাচন এবং অংশগ্রহণসহ ফেডারেশনের বিষয়গুলো পরিচালনা করার জন্য নিয়োজিত থাকবে।"
তবে, এ ধরনের মামলা আদালতে নিষ্পত্তি হতে কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে। তাছাড়া, অনেক অভিযুক্ত জামিন পেয়ে বাইরেও থাকে।
এ নিয়ে মানবাধিকার আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার বলেন, নারীদের যৌন হয়রানি ভারতে "সবচেয়ে বড় বাধাগুলোর মধ্যে একটি।"
তিনি আরও বলেন, যৌন হয়রানির হাইপ্রোফাইল কেসগুলো খুব জটিল হয়ে ওঠে যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি 'শক্তিশালী' এবং 'কর্তৃত্বপূর্ণ' কেউ হয়।
তবে ফোগাট এবং অন্যান্য কুস্তিগিররা বলেন, তারা দীর্ঘ অপেক্ষার জন্য প্রস্তুত। "পুরো ভারত আমাদের সাথে আছে। এটি একটি দীর্ঘ যাত্রা হতে পারে। তবে আমি পূর্ণ আশা করি আমরা ন্যায়বিচার পাব," বলেন তিনি।