ইউক্রেনে মার্কিন স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধাদের যত ছলছাতুরী আর ব্যর্থতা

রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর রণাঙ্গনে অনেক মার্কিনীই ছুটে গিয়েছিলেন ইউক্রেনের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সামরিক বাহিনীর সদস্য, কেউ বা যুদ্ধের জন্য অর্থ তুলেছেন, অনেকে আবার যুদ্ধ সরঞ্জাম দেওয়ারও অঙ্গীকার করেছেন।
কিন্তু যুদ্ধের এক বছর পার হওয়ার পর এখন এ মার্কিন স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকেই নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন, যুদ্ধের মূল্য উদ্দেশ্য থেকে সরে এসেছেন। কেউ কেই যুদ্ধের জন্য তোলা অর্থ অপচয় করেছেন, অনেকে নিজের পূর্ববর্তী সামরিক অভিজ্ঞতার মিথ্যা গল্প ফেঁদেছেন। কেউবা আবার যুদ্ধ থেকে ব্যক্তিগত লাভের চেষ্টা করছেন। বিস্তারিত জানিয়েছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
মার্কিন মেরিনের একজন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল বর্তমানে ফেডারেল তদন্তের কেন্দ্রে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ইউক্রেনে অবৈধভাবে সামরিক প্রযুক্তি রপ্তানি করেছেন। আরেকজন সেনাসদস্য ইউক্রেনের হয়ে লড়াই করতে গিয়ে বেইমানি করে রাশিয়ার পক্ষে যোগ দিয়েছেন।
কানেকটিকাটের একজন ব্যক্তি নিজের সামরিক অভিজ্ঞতার মিথ্যা বর্ণনা দিয়ে ইউক্রেনে গিয়েছেন। এরপর যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে অনলাইনে সরাসরি তথ্য সম্প্রচার করেছেন। এর ফলে প্রকাশ হয়ে গেছে যুদ্ধক্ষেত্রে তার দলের সঠিক অবস্থান। এছাড়া তিনি মার্কিন অস্ত্রের সহজলভ্যতা নিয়েও গর্ব প্রকাশ করেছেন। সাবেক আরেকজন কনস্ট্রাকশন কর্মী ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে পাকিস্তান ও ইরান থেকে ইউক্রেনে যোদ্ধা আনার পরিকল্পনা করছেন।
বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করছেন, কিন্তু কোনো পেশাদার সৈনিক দিয়ে নয়। অর্থাৎ যেসব ব্যক্তি মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোনো যুদ্ধের ধারে-কাছেও আসতে পারতেন না, তারাই এখন বিস্তর অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সহযোগে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে সক্রিয় রয়েছেন।

অনেক স্বেচ্ছাসেবকই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ইউক্রেনে গিয়েছেন সদিচ্ছা নিয়ে। তারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে ইউক্রেনের হয়ে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করছেন। অনেকেই ইতোমধ্যে মারাও গিয়েছেন। কেউ কেউ বেসামরিক নাগরিকদের সহায়তা করেছেন, কেউবা আহতদের সেবা দিয়েছেন। অনেকে গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ সচল রাখার জন্য আর্থিক অনুদান তোলার ব্যবস্থা করেছেন।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস স্বেচ্ছাসেবক দলগুলোর প্রায় ১০০ পৃষ্ঠার বেশি কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছে এবং ৩০ জনের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যোদ্ধা, তহবিল উত্তোলক, দাতা এবং মার্কিন ও ইউক্রেনীয় কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইউক্রেনের শুভাকাঙ্ক্ষীদের যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আহ্বান করেন। এ ডাকে সাড়া দিয়ে তখন অনেক বিদেশি নাগরিকই ইউক্রেনের হয়ে লড়তে গিয়েছিলেন। এদের অনেকে বিদেশি যোদ্ধাদের জন্য ইউক্রেনের তৈরি করা ইন্টারন্যাশনাল লিজিয়ন দলে যোগ দেন। ইউক্রেনের রাজধানী আক্রমণের মুখে থাকায় তখন এ বিদেশি যোদ্ধাদের সবার অতীত ইতিহাস ঘেঁটে দেখার সুযোগ হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী স্পষ্টভাবে কিছু বলেনি। তবে জানিয়েছে, রাশিয়ান এজেন্টরা নিয়মিতই এসব স্বেচ্ছাসেবী দলের ভেতরে প্রবেশ করতে চেয়েছিল, তাই ইউক্রেন বাহিনী বিষয়টি নিয়ে সবসময়ই সতর্ক ছিল।
ইউক্রেনের রণক্ষেত্রে অন্যতম পরিচিত মার্কিনী হলেন জেমস ভাসকেজ। যুদ্ধ শুরু হলে কানেকটিকাটের এ কনট্রাক্টর ইউক্রেন যাওয়ার ঘোষণা দেন। সে সময় তার এলাকার সংবাদপত্র তাকে মার্কিন সেনাবাহিনীর স্টাফ সার্জেন্ট হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তার এ যুদ্ধে যাওয়ার গল্প প্রচার করে।

এরপর থেকে ভাসকেজ যুদ্ধক্ষেত্রের অনেক ভিডিও প্রচার করতে থাকেন। কমপক্ষে একবার তিনি ভিডিওতে তার দলের সুনির্দিষ্ট অবস্থান সবার কাছে প্রকাশ করে দিয়েছেন। এক ভিডিওতে তিনি অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মের সময় কুয়েতে এবং নয়-এগারোর পর ইরাকে থাকার দাবি করে অনুদানের আহ্বানও জানান। সে ভিডিওতে তিনি বলেছিলেন, 'এটা পুরোদস্তুর ভিন্ন একটি জানোয়ার।'
কিন্তু ভাসকেজ আদতে কখনোই কুয়েত, ইরাক বা অন্য কোথাও যুদ্ধ করেননি বলে জানিয়েছেন পেন্টাগনের একজন মুখপাত্র। তার দক্ষতা জ্বালানি ও ইলেট্রিক্যাল সারাইয়ে। আর তিনি আর্মি রিজার্ভ দল তার দাবি অনুযায়ী সার্জেন্ট হিসেবে ত্যাগ করেননি, বরং তিনি একজন প্রাইভেট ফার্স্ট ক্লাস ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সবচেয়ে নিচু পদগুলোর একটি এটি।
তারপরও খুব সহজেই মার্কিন অস্ত্র পেয়েছিলেন ভাসকেজ। এমনকি মার্কিন বিভিন্ন রাইফেলও তিনি অনায়াসেই সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু এগুলোর উৎস কী? 'আমি আসলেই নিশ্চিত নই,' এক খুদেবার্তায় দ্য টাইমসকে জানান তিনি। রাইফেল সম্পর্কে তিনি বলেন, সেগুলো 'ব্র্যন্ড নিউ, কেবল বাক্স থেকে বের করা হয়েছে এবং আমাদের কাছে প্রচুর পরিমাণে আছে।' এক টুইটে তিনি এমনও লিখেছিলেন ইউক্রেনের যুদ্ধে তাকে যুদ্ধের আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলতে হবে না।
তবে দ্য টাইমস তার ভুয়া সামরিক সেবার দাবি নিয়ে প্রশ্ন করার পর তিনি তৎক্ষণাৎ তার টুইটার অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় করে ফেলেন। এছাড়া তিনি জানিয়েছেন, যেহেতু কর্তৃপক্ষ তার মিলিটারি কন্ট্রাক্টের অসত্য তথ্যের বিষয়ে জেনে গেছে, তাই তিনি হয়তো ইউক্রেন ছেড়ে চলে যাবেন।

ভাসকেজ জানিয়েছেন, তিনি তার মিলিটারি রেকর্ডকে কয়েক দশক ধরে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন। সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হয়ে যাওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন তিনি। কিন্তু কী কারণে, তা জানাননি। 'সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে লাখো মিথ্যা বলতে হয়েছিল,' বলেন তিন।
যুদ্ধের শুরুতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিয়নে ভর্তি করানোর সময় বিদেশি স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যাকগ্রাউন্ড পরীক্ষা করতে ১০ মিনিটেরও কম সময় নিয়েছিল ইউক্রেন সরকার। এ সুযোগে ইউক্রেনে বন্দি থাকা এক পোলিশ অপরাধী একটি যোদ্ধা ইউনিটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে যান। সৈনিকেরা জানিয়েছেন, ওই ব্যক্তি যথার্থভাবে সরবরাহ বণ্টন করেননি, নারীদের জ্বালাতন করেছেন এবং তার অধীন সৈন্যদের হুমকি দিয়েছেন।
মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক একজন প্রাইভেট ফার্স্ট ক্লাস জন ম্যাকইন্টায়ারকে লিজিয়ন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে বাজে আচরণের জন্য। এরপর ভদ্রলোক রাশিয়ার পক্ষে চলে যান এবং সম্প্রতি দেশটির একটি রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনে তাকে দেখা যায়। সেখানে দাবি করা হয়েছে, ম্যাকইন্টায়ার মস্কোকে সামরিক গোয়েন্দা তথ্য দিয়েছেন।
মার্কিন নেভির সাবেক ক্রিপটোলজিস্ট ও এমএসএনবিসির কর্মী ম্যালকম ন্যান্স গত বছর ইউক্রেনে যান লিজিয়নে শৃঙ্খলা আনার জন্য। কিন্তু তিনিও বিশৃঙ্খলাতেই ডুবে গেছেন। অভিজ্ঞ এ সমরবিদ লিজিয়নের জন্য একটি কোড অব অনারও লিখেছিলেন। অস্ত্রশস্ত্রও দান করেন তিনি। কিন্তু বর্তমানে তিনি এক ধরনের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গেছেন। টুইটারে তিনি সাবেক একজন মিত্রের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারও করেছেন। লিজিয়নের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনোরূপ প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগ তুলেছেন ন্যান্স।

ইউক্রেনের জন্য তহবিল উত্তোলনকারী আরেকজন সাবেক লিজিয়ন সদস্য বেন ল্যাকি নিজেকে মার্কিন মেরিন হিসেবে দাবি করে লিজিয়নে যোগ দিয়েছিলেন। এ দলের আরেক সদস্য রায়ান রুথ চেষ্টা করছেন তালেবানদের থেকে পালিয়ে যাওয়া আফগান সেনাদেরকে ইউক্রেনের জন্য নিয়োগ করতে। পাকিস্তান ও ইরান থেকে প্রয়োজনে অবৈধভাবে ভুয়া পাসপোর্টের মাধ্যমে হলেও এসব যোদ্ধাদের ইউক্রেনে নিয়ে যেতে চান রুথ।
৬৫ বছর বয়সী গ্র্যাডি উইলিয়ামসের গল্পটা আরও আকর্ষণীয়। ছোটবেলা থেকে বন্দুক ছুঁড়তে পারতেন, তাই ইউক্রেনে গিয়েছিলেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে। প্রথমে পোল্যান্ডে যান তিনি, সেখান থেকে হিচহাইকিং করে ইউক্রেনে। এরপর ট্রেনে চড়ে কিয়েভ পৌঁছান তিনি।
কিয়েভে মিলিটারি পোষাক ও সরঞ্জাম পরিহিত দুই মার্কিনীর সঙ্গে দেখা হয় গ্র্যাডির। তারা তাকে দলে ভিড়িয়ে নেন। এরপর তার হাতে বন্দুক তুলে দেওয়া হয়। তারপর বুকার কাছে ইউক্রেনীয় সেনাদের সঙ্গে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে অল্পের জন্য মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন তিনি। পরে সেনাবাহিনী বুঝতে পারে গ্র্যাডি যুদ্ধ করার জন্য কোনো রেজিস্ট্রেশন করেননি। তাকে ফেরত পাঠানো হয়।
এরপর নতুন মিশন শুরু করেন গ্র্যাডি। যুদ্ধের স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য অর্থ তুলতে শুরু করেন। জর্জিয়ায় গিয়ে তিনি প্রায় ১৬,০০০ ডলার তোলেন। কিন্তু আরেক স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে বাদানুবাদের কারণে তাকে জর্জিয়া থেকে বের করে দেওয়া হয়। যোদ্ধাদের জন্য ইলেকট্রিক মোটরসাইকেল লাগবে — এমন দাবি করে অর্থ তুলেছিলেন গ্র্যাডি। পরে তিনি জানান, মোটরসাইকেলের জন্য ৬,৯০০ ডলার ডাউনপেমেন্ট দিয়েছেন। আর বাকি ডলার খরচ করেছেন নিজের যাতায়াত ও অন্যান্য খরচে।
ভালো উদ্দেশ্যে কাজ করতে গিয়ে অর্থ অপচয়ের এরকম নজির আরও আছে। কানাডিয়ান এবজন লেফটেন্যান্ট কর্নেলের অধীনে পরিচালিত মিরিয়া এইড নামক একটি দল বিভিন্ন দাতার দেওয়া এক লাখ ডলার খরচ করেছে মার্কিন বাহিনীর ব্যবহৃত নাইট-ভিশন ডিভাইস কিনতে। কিন্তু দেখা গেল তারা যেগুলো কিনেছেন সেগুলো চীনের তৈরি কম কার্যকরী সরঞ্জাম।