রাশিয়াকে ভাঙতে চায় পশ্চিমারা, কিন্তু নিজেদেরই পতন ডেকে আনছে…

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর এক পদস্থ কর্মকর্তা গর্বভরে দাবি করেন, 'যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা রাশিয়ানদের রক্তপাত ঘটাতে চলেছি'। একথার তাৎপর্য স্পষ্ট হতে সময় লাগেনি, রাশিয়া তার স্বাধীন প্রতিবেশী ইউক্রেনে অবৈধ আগ্রাসন চালিয়েছে, বাকি বিশ্বও এই যুদ্ধের অভিঘাতে আক্রান্ত।
তবে এই দাবির বিষয়ে আমার কিছু আপত্তি আছে।
রাশিয়া একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, যার আছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার। তারা নিকট প্রতিবেশী দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে, অন্যদিকে আমেরিকা এক মহাসমুদ্র ও মহাদেশ দূরে অবস্থিত। আবার, মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়াজুড়ে তাদের কৌশলগত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলোর সাথে ইউক্রেনের বাস্তবতা ভিন্ন।
মাতাল হয়ে জুয়ো খেলা
আমাদের সময়কার পররাষ্ট্রনীতির প্রধান প্রধান বিষয়ে কৌশলগত চিন্তাভাবনা করতে অস্বীকার করে চলেছে ওয়াশিংটন। বিরল কিছু ক্ষেত্রে যখন ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকরা কৌশলগত চিন্তাভাবনা করেন, সেখানেও তাদের রাষ্ট্রক্ষমতার বাস্তবসম্মত প্রয়োগের চেয়ে জুয়ো খেলার মতো ঝুঁকি নিতে দেখা যায়। কেবল বেহেড মাতাল হলেই এমনটা করা সম্ভব। ইউক্রেন নিয়েও আমেরিকানদের আচরণে তা স্পষ্ট।
অন্যদিকে, রাশিয়ানরা ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়েছে। তাদের পুরো জাতিকে এই যুদ্ধের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছে। জনপ্রিয় ভূরাজনৈতিক পিটার জেইহানের ভাষায়, 'এটাই রাশিয়ার শেষ যুদ্ধ'। তাদের সমাজ আর এক দশকের বেশি টিকবে না। রাশিয়ার অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাও ধসে পড়বে। কারণ তাদের লৌহমানব পুতিন ইউক্রেনে খুব বেশি শক্তিক্ষয় করে ফেলেছেন, হয়েছেন নিয়ন্ত্রণহীন।
এসব ধারণা সত্য হতে পারে। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা এসব ধারণার সীমা পরীক্ষা করার জন্যই ন্যাটো সদস্য নয় এমন একটি দেশ- ইউক্রেনকে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে চলেছেন। এমনকী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি নিয়ে হলেও।
কিন্তু, সবকিছু যদি তাদের পরিকল্পনামাফিক না এগোয়? যুদ্ধে শত্রুর সাথে প্রথম মোকাবিলাতেই পূর্বপরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
তারপরও ওয়াশিংটনের বর্তমান নীতির পেছনে যে ভাবনা কাজ করছে তা হলো- তারা ইউক্রেনীয়দের জীবন এবং মার্কিন করদাতাদের ডলারকে 'সস্তা মূল্য' মনে করছে। মার্কিন নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এই 'সস্তা মূল্যে' যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্রদের জন্য পুতিন যে কৌশলগত হুমকি সৃষ্টি করেছেন তার অবসান করা যাবে এবারে।
এর সাথে গণতন্ত্র রক্ষার কিছু ফাঁপাবুলি জুড়ে দিয়ে আমেরিকানরা নিজেদের বিজয়ীর আসনে দেখছে। তাছাড়া, ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো এই সংঘাতে তো কোনো আমেরিকানকে প্রাণ দিতে হচ্ছে না। তাদের দৃষ্টিতে এটা হলো উত্তর-আধুনিক যুগে বৃহৎ পরাশক্তিদের মধ্যে 'স্পষ্ট' লড়াই – যেখানে যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকানোর মতো কিছু করার নেই রাশিয়ার।
বন্ধুগণ জেনে রাখুন, ঠিক এই ধরনের চিন্তাই, ঠিক এমন দ্বিমাত্রিক বিশ্লেষণই– আমেরিকাকে মধ্যেপ্রাচ্যে দুই দশকব্যাপী ধ্বংসাত্মক রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়ায়। যে সংঘাতে আমাদের পরাজয় হয়েছে।
ইউক্রেনে এপর্যন্ত মার্কিন সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়নি। কিন্তু, ইরাকে যেমন অবাস্তব কল্পনার ফাঁদে পড়ে আমেরিকা পরাজিত হয়েছিল, একই রকম অবাস্তব ভাবনা ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে।
অথচ আমরা ইউক্রেনের নেতা ভলোদমির জেলেনস্কিকে বলছি উইনস্টন চার্চিল। একথা সত্য, নিজ জাতিকে বাঁচাতে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন জেলেনস্কি, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তারপরও তাকে চার্চিল বলা যায় না, বরং তিনি ইরাকের নেতা আহমেদ ছালাবির সাথেই তুলনীয়।
আমাদের ব্রান্ডই যখন ব্যর্থ
যাদের স্মরণে নেই, তাদের মনে করিয়ে দেই- ছালাবি ছিলেন একজন দুর্নীতিগ্রস্ত, ইরান সমর্থিত নির্বাসিত ইরাকি। ইরাকে পশ্চিমা আগ্রাসনের পর তিনি নিজেকে সাদ্দাম হোসেনের জায়গায় অধিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি ও তার সঙ্গী নির্বাসিত ইরাকি রাজনীতিবিদেরা যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন জর্জ ডব্লিউ বুশের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। অতপর তাদের দেওয়া অনির্ভরযোগ্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইরাকে আগ্রাসন চালায় আমেরিকা।
কিন্তু, সাদ্দামকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের পর পরই বালির প্রাসাদের মতো ধসে পড়ে সমস্ত পরিকল্পনা। ছালাবির রাজনৈতিক দল- ইরাকি ন্যাশনাল কংগ্রেস (আইএনসি) সাদ্দাম পরবর্তী ইরাকি জনতার সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়। তারা ইরাকে আমেরিকানদের নির্ভরযোগ্য অংশীদারও হতে পারেনি।
বাস্তবে যাই ঘটুক, কাগজেকলমে ওয়াশিংটনের কথিত জিনিয়াসদের সাদ্দামকে অপসারণ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কৌশল কিন্তু শুনতে ছিল দারুণ।
২০০৩ সালে ইরাকে আগ্রাসনের আগে আমরা ভেবেছিলাম, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার পথের কাঁটা সাদ্দামকে অপসারণ করা দরকার। কারণ ক্ষমতালিপ্সু নির্বাসিত ইরাকি নেতারা বুঝিয়েছিল যে, সাদ্দাম পারমাণবিক বোমা বানাচ্ছেন আর সেই প্রযুক্তি আল কায়েদাকেও দিচ্ছেন। তাই আমরা মধ্যপ্রাচ্যকে 'স্থিতিশীল' করতে তার কেন্দ্রস্থলে মার্কিন সেনাবাহিনী পাঠাই।
এরপরের পরিকল্পনা অনুসারে, সেখানে মার্কিনপন্থী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নেওয়া হয়। আর যুদ্ধের অর্থনৈতিক ব্যয়ভার ইরাকের অমিত তেলসম্পদ থেকে অর্জনের লক্ষ্য ছিল। তাছাড়া, ইরাকের অসামান্য তেল মজুদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আমেরিকা বৈশ্বিক তেল বাণিজ্যের কেন্দ্রে প্রবেশ করবে এমন ভাবনায় বিভোর হয় বুশ প্রশাসন।
কাগজেকলমে একে নিখুঁত পরিকল্পনাই বলতে হয়; কিন্তু নিখুঁত ফলাফল আসেনি। ইরাকে গণতন্ত্রের উত্থান ঘটেনি। তেলসম্পদ পূরণ করেনি আমেরিকার যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি। আজ আমেরিকানরা ইরাকে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং সেখান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত তেল বাণিজ্যের ওপরও তাদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়েছে।
তবু ২০০২ সালে এসব পরিকল্পনাই কিন্তু শুনে মনে হয়েছিল অসাধারণ। উপস্থাপনার ভঙ্গিমাও ছিল তেমনই।
এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়েই কিন্তু সম্পদপূর্ণ ইরাক হয়ে ওঠে উগ্রবাদ ও মার্কিন বিরোধীতার পীঠস্থান। আমেরিকার আগ্রাসন জিহাদি উগ্রবাদকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে।
আজ আফগানিস্তান থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি কোণায় ছড়িয়ে পড়েছে উগ্রবাদী জঙ্গীগোষ্ঠী। সাদ্দামের অনুপস্থিতে ক্ষমতার যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে আমেরিকা-বিরোধী ইরান।
ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের ২০ বছর পূর্তি আর কিছুদিন পরেই। আজো ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকরা একই রকম ভুলের পুনরাবৃত্তি করছেন ইউক্রেনে। এবং এই ভুল করা হচ্ছে একটি প্রধান পারমাণবিক শক্তিধর দেশ রাশিয়ার ক্ষেত্রে।
আমরা যে পরিকল্পনায় নিজেদের অঙ্গীকারবদ্ধ করেছি, তাতে বাস্তবতার লেশমাত্র নেই। তবুও নিজেদের বুঝিয়ে চলেছি, এই পরিকল্পনা সফল হবে। এমনকী সবকিছু ঠিকঠাক না এগোনোর পরও, আশু সাফল্যের প্রচার করা হচ্ছে।
আমরা ন্যাটোকে ভাঙছি, রাশিয়াকে নয়
বিতর্কিত অনুসন্ধানী সাংবাদিক সিমোর হার্শ- এর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। নর্ডস্ট্রিম পাইপলাইনে করে রাশিয়ার বিপুল গ্যাস রপ্তানি হতো জার্মানিতে। সিমোর দাবি করেছেন, এই পাইপলাইনে অন্তর্ঘাত হামলা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের বর্তমান দুর্দশার পেছনে এই নাশকতার ভূমিকা রয়েছে।
এদিকে ওয়াশিংটন বিশ্বকে বলছে, ন্যাটোকে 'রক্ষার' স্বার্থেই ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। অথচ ন্যাটো জোটের প্রধানতম সদস্য জার্মানির গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক স্থাপনাতেই নাকি আমেরিকা গোপন হামলা চালিয়েছে। এর প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জার্মান অর্থনীতিতে।
এই সংবাদ প্রকাশের পর জার্মান নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া কী হবে– সেকথা ওয়াশিংটন ভেবে রেখেছে?
জার্মানিতে ইতোমধ্যেই ন্যাটো-বিরোধী এবং রাশিয়াপন্থী অতি ডান ও বামদের ব্যাপক উত্থান ঘটেছে। এর সাথে সাথে যুদ্ধ যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে, তাতে জার্মানিতে ন্যাটোপন্থী সরকারের অবসান করতে পারে। এরপর এমন সরকার ক্ষমতায় আসতে পারে, যারা ন্যাটোকে আরো দুর্বল করে দেবে। আমেরিকানদের নির্বোধ কর্মকাণ্ডে এরমধ্যেই ন্যাটো দুর্বলও হয়েছে।
একদিকে এসব যখন ঘটছে, ঠিক তখনই ইউক্রেনে ভয়াবহ হামলা অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া। এতে দেশটিতে বিপুল প্রাণহানি যেমন ঘটছে, তেমনি উজাড় হচ্ছে মার্কিন করদাতাদের সম্পদ।
আমেরিকার হস্তক্ষেপ রাশিয়াকে ইউক্রেন ও পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে আরো আক্রমণাত্নক করে তুলেছে। অর্থাৎ, পুরোপুরি লড়াকু মনোভাবের রাশিয়ার হাত থেকে ইউক্রেনকে বাঁচাতে হলে পশ্চিমাদের সরাসরি সেখানে যুদ্ধে নামতে হবে।
রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ন্যাটোর পশ্চিম প্রান্তের দিকে আরো এগিয়ে আসবে। ন্যাটো জোটের রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে ভেঙে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টার প্রতিশোধ নিতে মস্কো সংঘাতকে আরো ছড়িয়ে দিতে পারে।
সর্বোপরি ওয়াশিংটন রাশিয়ার সামরিক শক্তিকে ভাঙতে পারেনি। বরং রাশিয়ার মতো পরাশক্তির সাথে কোনো সম্মুখসমরে না নেমেই নিজেদের ও ন্যাটোর শক্তি দুর্বল করেছে। ফলে রাশিয়ার সাথে ভবিষ্যতে তাদের আরো দুর্বল শক্তি নিয়ে লড়তে হবে। এর চেয়ে অনেক বেশি শক্তি তাদের ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে।
ফলে এটাকে আর কৌশল বলা যায় না। বলতে হয় মতাদর্শিক বালখিল্যতা, এবং তার পরিণতিতে আরেক বিশ্বযুদ্ধের হুমকি বাড়িয়ে তোলা। এই অবস্থায় করণীয় হতে পারে, ইউক্রেনকে দেওয়া অনড় সমর্থন প্রত্যাহার এবং ঝুঁকির মধ্যে থাকা ন্যাটোর পূর্ব সীমানায় শক্তিবৃদ্ধি। মনে রাখা দরকার, ন্যাটো একটি প্রতিরক্ষামূলক জোট, এটা আমেরিকার শক্তি প্রদর্শনের একক কোনো প্লাটফর্ম নয়। ওয়াশিংটন যদি এভাবে আবারো ন্যাটোকে বুঝতে শেখে, কেবল তাহলেই ভূরাজনৈতিক একটি বিপর্যয় এড়ানোর সুযোগ এখনও আছে । মস্কোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠাতেও জোর দিতে হবে ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসকে।
- লেখক: ব্রান্ডন জে উইকার্ট আমেরিকান ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক