রাশিয়া কীভাবে ইউক্রেনের ওপর তার সবচেয়ে বড় হামলা চালাল আকাশপথে?

যুদ্ধ শুরুর পর গত সপ্তাহের মঙ্গলবার ইউক্রেনে সবচেয়ে বড় পরিসরে আকাশপথের হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। এদিন দেশটিতে নিক্ষেপ করে ৯৬টি মিসাইল। যদিও কয়েক মাস ধরে- পশ্চিমা ও ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বলে আসছেন, মস্কোর হাতে থাকা ক্ষেপণাস্ত্র মজুত নিঃশেষিত প্রায়; অন্যান্য অস্ত্রের মজুত-ও পড়তির দিকে। তারপরও রাশিয়ার ব্যাপক হামলা ইঙ্গিত দেয়– হয় তারা বাড়িয়ে দাবি করেছেন– নয়তো বিকল্প নানান ব্যবস্থায় ঘাটতি মেটাতে পারছে ক্রেমলিন। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে
কিয়েভের কর্মকর্তারা মনে করছেন, ইউক্রেনের অত্যাবশ্যকীয় অবকাঠামোতে এই হামলার ছক দীর্ঘদিন আগেই করা হয়। আবার এমন সম্ভাবনাও রয়েছে, গত সপ্তাহে ইউক্রেনীয় বাহিনীর খেরসন পুনর্দখলের প্রতিশোধ নিতেই ভয়াবহ এ হামলা। উদ্দেশ্য যাই হোক; উদ্দেশ্য সাধনের উপায়-ই এখন আলোচনার পাদপ্রদীপে। নতুন করে প্রশ্ন উঠছে, রাশিয়ার প্রচলিত যুদ্ধে ব্যবহার উপযোগী ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডারে সত্যিকারের ঘাটতি কতখানি? নাকি বিকল্প উৎস থেকে সরবরাহ পাচ্ছে মস্কো, যার দৌলতে আগামীতেও চালিয়ে যেতে পারবে এমন আক্রমণ?
তার আগে জেনে নেওয়া যাক রাশিয়ার প্রতিপক্ষদের দাবিগুলি।
রাশিয়া মঙ্গলবার নিক্ষেপ করেছে ইস্কান্দার, কালিবার এবং বিমান থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্রুজ মিসাইল। গত মাসে ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ দাবি করেছিলেন, এগুলোর যুদ্ধপূর্ব মজুতের প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবহার করে ফেলেছে রাশিয়া। তাহলে একমাস পর কীভাবে এগুলো দিয়ে সবচেয়ে বড় হামলা চালাতে পারলো? এক মাস আগে রেজনিকভ আরও দাবি করেন, রাশিয়ার কাছে এসব মিসাইল অবশিষ্ট আছে মাত্র ৬০৯টি। তবে এসব সংখ্যার দাবি সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে নিশ্চিত হতে পারেনি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
বাড়িয়ে দাবি শুধু ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা করেনি, পশ্চিমা সরকারগুলিও এদিক থেকে পিছিয়ে নেই। তবে তারা সতর্কভাবে পূর্বাভাস দেয়। যেমন গত ১৬ অক্টোবর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, দিন ছয়েক আগে রাশিয়া যে বৃহৎ পরিসরের হামলা চালায়– তাতে করে, খুব সম্ভবত মস্কোর দূরপাল্লার মিসাইল ভাণ্ডারে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। 'এর ফলে আগামীতে অনেক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়বে তাদের'- বলা হয় প্রতিবেদনে।
এদিকে গত বসন্ত থেকে পেন্টাগনের কর্মকর্তারা দাবি করে আসছেন, নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম প্রিসিশান-গাইডেড মিসাইলের ভাণ্ডার পড়তির দিকে রাশিয়ার। মজুতের অতি-দ্রুত ব্যবহারের ফলেই এ শূন্যতা তৈরি হয়েছে বলে জানান মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা-বিষয়ক মুখমাত্র জন এফ. কিরবি।
রাশিয়া তাহলে কীভাবে এত ব্যাপক হামলা চালাতে পারলো– জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস গ্রিনফিল্ড যাকে বলেছেন, 'যুদ্ধ শুরুর পর সবচেয়ে ব্যাপকতম ক্ষেপণাস্ত্র হামলা'?
এর পেছনে সম্ভাব্য চারটি ব্যাখ্যা দিয়েছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।

১. মার্কিন কর্মকর্তাদের মতে, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মুখাপেক্ষী হচ্ছে রাশিয়া
গত বুধবার পেন্টাগনে এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড জে অস্টিন বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রের চাহিদা অনুযায়ী, ক্ষেপণাস্ত্র মজুত রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে রাশিয়া। তাই দেশটি ইরান ও উত্তর কোরিয়ার শরণাপন্ন হচ্ছে।
অস্টিন বলেন, 'আমি মনে করি, এই দেশগুলো তাদের কিছুটা বাড়তি সক্ষমতা দিতে পারবে'।
ইতোমধ্যেই ইউক্রেনে আক্রমণ চালাতে ইরানের তৈরি দূরপাল্লার শাহিদ সিরিজের আত্মঘাতী ড্রোন ব্যবহার করছে রাশিয়া। ঝাঁকে ঝাঁকে এই ড্রোন ছুঁড়ে ধ্বংস করা হচ্ছে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তু। যুদ্ধের ময়দানে এটাই রাশিয়ার ব্যবহৃত নতুনতম অস্ত্র।
ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনী জানায়, মঙ্গলবারের হামলার সময় তারা ১০টি শাহিদ ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
চলতি মাসে ইউক্রেনীয় এয়ার ফোর্স কম্যান্ডের একজন মুখপাত্র বলেন, খুব শিগগিরই রাশিয়ায় ব্যালেস্টিক মিসাইলের চালান পাঠাবে ইরান। ইউরি ইহনাত নামের ওই মুখমাত্র বলেন, ইরান ঠিক কতগুলি ক্ষেপণাস্ত্রের চালান পাঠাচ্ছে সেটি তারা জানতে পারেননি, তবে এগুলোর অধিকাংশই সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানির উদ্দেশ্যে প্রস্তুতকৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে। এগুলো ৩০০ থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম।
এদিকে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে গোপনে রাশিয়াকে রকেট ও কামানের গোলা সরবরাহের অভিযোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে জন কিরবি জানান, এই চালান এখনও রাশিয়া পেয়েছে কিনা- সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই রাশিয়াকে অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে ইরান ও উত্তর কোরিয়া।

২. রাশিয়া হয়তো আরও ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত করছে
গত মাসে যুদ্ধ সরঞ্জাম ও অস্ত্র উৎপাদন বৃদ্ধির নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
সামরিক তথ্য পরিবেশক জেনস ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স জানাচ্ছে, গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর আগে থেকেই মাইক্রোচিপসহ প্রিসিশান মিসাইল তৈরিতে দরকারি অন্যান্য প্রযুক্তিগত উপকরণের মজুত গড়ে তোলে রাশিয়া। খুব সম্ভবত এটি বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই শুরু করা হয়।
জেনসের ওই বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এসব মাইক্রো ইলেকট্রনিক উপকরণ বেসামরিক কাজেও ব্যবহৃত হয়। ফলে তৃতীয় পক্ষের সহায়তায় রাশিয়ার এসব কেনার বিষয়টি পশ্চিমা গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে সক্ষম হয়। এভাবে যুদ্ধ শুরুর আগেই ইসকান্দার, কালিবারসহ অন্যান্য ক্রুজ মিসাইল ব্যাপক সংখ্যায় উৎপাদন শুরু করে রাশিয়া।
প্রতিবেদনটি জানায়, 'মিসাইলগুলোর উৎপাদন এখনও সচল হয়েছে। রাশিয়ার অর্থনীতি রয়েছে যুদ্ধকালীন অবস্থায়, তাই দেশটির সমর সরঞ্জাম উৎপাদন শিল্প তিন শিফটে উৎপাদন কাজ করছে। এমনকী সাপ্তাহিক ছুটিতেও তা বন্ধ থাকছে না '।
৩. ইউক্রেনের দাবি, ভূমিতে আক্রমণ চালাতে বিমান-বিধ্বংসী মিসাইল ব্যবহার করছে রাশিয়া
গত বৃহস্পতিবারের হামলায় অন্তত ১০টি এস-৩০০ বিমান-বিধ্বংসী সিস্টেমের গাইডেড মিসাইল রণাঙ্গনের সম্মুখভাগে থাকা ইউক্রেনের শহরগুলিতে নিক্ষেপ করেছে রাশিয়া।
এই ক্ষেপণাস্ত্র এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে রপ্তানি করেছে রাশিয়া। ১৯৭৮ সালে প্রথম শত্রুর ধেয়ে আসা মিসাইল ধবংসে এস-৩০০ এর রকেট ডিজাইন করা হয়। এর আধুনিক সংস্করণগুলি বিমান, ড্রোন ও ব্যালেস্টিক মিসাইল ধ্বংস করতে পারে।
ইউক্রেনের ভুমি-ভিত্তিক লক্ষ্যবস্তু ধবংসে রাশিয়া এখন এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে। আর সেই সূত্রেই কিয়েভ মনে করছে, রাশিয়ার ক্রুজ মিসাইলের ভাণ্ডার পড়তির দিকে।
৪. ন্যাটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বিপুল মজুত রয়েছে রাশিয়ার
হোয়াইট হাউসের সাবেক অস্ত্র কৌশলবিদ মার্ক এফ ক্যানসিয়ান জানান, রাশিয়ার অস্ত্র ভাণ্ডারে ঠিক কী পরিমাণ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে তার সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখেন পশ্চিমা কর্মকর্তারা।
বর্তমানে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে যুক্ত এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ন্যাটোর সাথে যুদ্ধের সম্ভাবনা মাথায় রেখে দীর্ঘদিন ধরেই মিসাইলের ব্যাপক মজুত রক্ষা করে আসছে মস্কো। 'রাশিয়া-ন্যাটো সংঘাতকে অচিন্তনীয় মনে করা হলেও, তাদের কাছে এটি খুবই বাস্তব এক উদ্বেগ। এজন্য তারা নিজস্ব মজুতের একটি অংশকে আলাদা করে রাখে'।
সাম্প্রতিক হামলাকালে রাশিয়া এই মজুত থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে কিনা– সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।