ইউক্রেন যুদ্ধে ধেয়ে আসছে ‘জেনারেল উইন্টার’!

যুদ্ধের ময়দানে গত কয়েক সপ্তাহে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। তবে প্রথমদিককার হতচকিত ভাব কাটিয়ে উঠে রুশ বাহিনীও শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করেছে। এতে আগের গতি হারিয়ে মন্থর হয়ে পড়েছে ইউক্রেনীয়দের ভূমি উদ্ধারের চেষ্টা। এরমধ্যে শীতও নামছে ইউরোপের বুকে। যুদ্ধের ময়দানে উভয়পক্ষের আক্রমণ ধার হারাবে শীতের তীব্রতা বাড়লেই। এই প্রেক্ষাপটে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করেছেন যুক্তরাজ্যের পোর্টমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সমর কৌশল ও আইন বিষয়ক প্রভাষক ফ্রাঙ্ক লেডউইগ। এশিয়া টাইমসের সূত্রে বিশ্লেষণটির অনূদিত অংশ টিবিএসের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো–
মধ্য ইউরোপে বাস করেছেন, এমন কারো পক্ষেই সেখানকার তীব্র শীতের কথা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। নভেম্বর থেকে এপ্রিল– এই সময়টা ঘর উষ্ণ রাখার আয়োজনও তাই থাকে চূড়ান্ত। আর ঘর ছেড়ে বাইরে গেলেই যেন মনে হবে সোজা ফ্রিজারে ঢুকে গেছেন।
ঋতুচক্রের এই পালাবদল সম্পর্কে রাশিয়ার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। শীতকে মাথায় রেখেই সম্প্রতি ইউক্রেনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও জ্বালানি স্থাপনায় ব্যাপক বোমা হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। আশা করছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিহীন দুঃসহ এক শীতে নাকাল হোক ইউক্রেনবাসী। ভেঙে যাক তাদের প্রতিরোধের মনোবল।
কিন্তু, এই মুহূর্তে গুরুতর ঘাটতি দেখা দিয়েছে রাশিয়ার নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম এমন গাইডেড মিসাইলের ভাণ্ডারে। ইরানের সরবরাহ করা শাহিদ-১৩৬ ড্রোন ভূপাতিত করার দক্ষতাও বেড়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনীর। কিন্তু, তাতে কাজে হচ্ছে না খুব একটা। সংখ্যায় অনেক হওয়ায়– কোনো না কোনো ড্রোন– প্রতিরোধ পাশ কাটিয়ে লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করছে ঠিকই।
ইউক্রেনবাসী অনেক বন্ধু আমাকে বলছেন, কিয়েভে বিরাজ করছে স্নায়বিক উত্তেজনার পরিবেশ, তবে যুদ্ধ চালিয়ে যেতেও সবাই দৃঢ়সংকল্প। কিন্তু, বিদ্যুতের অভাব তো এড়ানোর উপায় নেই। তাই জমে উঠেছে ছোট আকারের জেনারেটরের বেচাকেনা। কারণ, সবাই জানে এবারের শীতে বিদ্যুৎ সংকটই হবে নিত্যসঙ্গী। আরও বুঝতে পারছে, হিমেল এই মওসুমটা কঠিন এক পরীক্ষা দিতে হবে তাদের।
কিন্তু, ইউক্রেনের শত্রু সেনা– রুশ বাহিনীর জন্যও কষ্টকর হবে শীতের প্রকোপ। সে তুলনায়, ভাগ্য ভালো ইউক্রেনীয় সেনাদের। হিমঠাণ্ডার মধ্যেও যেন তারা দরকারি উষ্ণ পোশাক ও সরঞ্জাম পায়– তা নিশ্চিত করতে গত কয়েক মাস ধরে পরিকল্পনা করে আসছে ন্যাটো। নিজ সেনাবাহিনীর শীতকালীন পোশাকের ভাণ্ডার থেকে প্রায় ১০ লাখ পিস দিচ্ছে কানাডা। এরমধ্যে প্রবল শীত মোকাবিলার পার্কা থেকে শুরু করে প্যান্ট, দস্তানা, গ্লোভস—আপাদমস্তক সুরক্ষার সব উপকরণই রয়েছে।
কানাডার দেখাদেখি এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও এস্তোনিয়া-ও।
রক্তজমাট করা হিম রাশিয়ানদের চিরচেনা হলেও– রুশ সেনাবাহিনী তাদের দরকারি রসদ ও সরঞ্জাম দক্ষভাবে রক্ষণাবেক্ষণ অথবা যেখানে প্রয়োজন সেখানে বিতরণের জন্য খ্যাত নয়। উল্টো তাদের আছে রসদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির বদনাম। তার ওপর আবার ইউক্রেন রণাঙ্গনে যোগ দিতে আসছে সদ্য ভর্তি হওয়া নতুন সেনারা– যাদের অনেকেই পেয়েছে মাত্র দুই থেকে তিন সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ। একে তীব্র শীত অন্যদিকে যুদ্ধের ময়দান– নাকাল তারাও কম হবে না।
তাদের জীবনকে আরও বিপন্ন করে তুলবে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী। কারণ সম্প্রতি ব্যাপক হতাহতের শিকার হলেও, এখনও অগ্রযাত্রা থামেনি তাদের। আগের চেয়ে মনোবলও তাদের চাঙ্গা বেশ। দেশরক্ষার লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার নৈতিক পাল্লাও ভারি তাদেরই দিকে।
পশ্চিমাদের সাহায্যে লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল গোলন্দাজ হামলা করার শক্তিতে এখন ইউক্রেনীয়রা এগিয়ে, খুব সম্ভবত ট্যাংক সংখ্যাতেও পিছিয়ে নেই তারা। সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে নেতৃত্ব শক্তি ও প্রশিক্ষণের মান।
ঢিমেতালে যুদ্ধের মওসুম
কৃষ্ণসাগর তীরে ধেয়ে আসতে শুরু করেছে শীত। ঠাণ্ডা যত বাড়বে, ততই ছন্দ হারাবে লড়াইয়ের গতি। শীতে তাপমাত্রা প্রায়ই নেমে যায় মাইনাস ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে। তখন প্রাণ বাঁচাতেই শরীর উষ্ণ রাখতে হয়। আর তার সুরক্ষিত উষ্ণ বাঙ্কারই সেরা– তুষারপাতের সময়ে শত্রুর দিকে ধেয়ে যাওয়া নয়। আর তাছাড়া এমন আবহাওয়ায় শরীর উষ্ণ করতেও সময় লাগে বেশ। এই বাস্তবতা উভয় পক্ষকেই মেনে চলতে হবে।
এমনকী শীত মোকাবিলার সেরা পোশাক, সরঞ্জাম থাকলেও মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের শীত সামলানো দুঃসহ এক অভিজ্ঞতা। বরফ জমা ঠাণ্ডার সময়ে যুদ্ধাস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতির কাজ হয়ে ওঠে আরও কঠিন।
ইউক্রেনে আবারও দেখা যাচ্ছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার মতো পরিখা বা ট্রেঞ্চের লড়াইয়ের ব্যাপকতা। শত্রুর গোলাবর্ষণ থেকে সেনাদের প্রাণরক্ষায় নতুন করে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে ট্রেঞ্চ। কিন্তু শীতে যখন মাটিও জমে যায় সেখানে, তখন পরিখা খনন করাও যথেষ্ট কষ্টকর।
উভয়পক্ষের লাখো সেনাকে এই একই পরিবেশে– পরিখায়, বাঙ্কারে থেকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। যেমনটা দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধের কালে করেছিল তাদের পূর্বপুরুষরা।

ন্যাটোর একজন কর্মকর্তা ব্রাসেলসে সাংবাদিকদের বলেন, 'এমন পরিবেশে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। ধরুন আপনি যুদ্ধে গেছেন, আর আপনার ট্যাংকটি মাঝেমধ্যেই তুষার ও কাদায় আটকে যাচ্ছে, অথবা বিকল হয়ে পড়ছে এর ট্র্যাক। এ ধরনের বাধাবিপত্তি টাকা মোকাবিলা করতে হলে, একটি সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে'।
বাস্তবতা হলো, ইউক্রেনে শীতকাল যতোটা রুঢ়– তেমন প্রচণ্ড শীতের মধ্যে লড়াই করতে, সামরিক মুভমেন্ট করতে ব্যাপক অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। রসদ সরবরাহের দিক থেকেও একথা সর্বাঙ্গে সত্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে জার্মান সেনারা দেখেছে, শীতকালে ইউক্রেন দিয়ে খাদ্য ও গোলাবারুদের চালান পাঠাতে দীর্ঘসময় লাগে। পথিমধ্যে নষ্ট হয় মালবাহী গাড়ি। বিগরে যায় ট্যাংকের ট্র্যাক। এমনকী আজকের দিনের পাকা সড়ক থেকেও তুষারপাতের কারণে পিছলে পড়ে মালবাহী ট্রাক। তাই সাবধানী গতিতে চালাতে হয়। রেলপথেও থাকে একই ঝুঁকি। এমন পরিবেশে দ্রুতলয়ের সাঁজোয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা বেশ চ্যালেঞ্জিং।
লন্ডনের কিংস কলেজের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মাইক মার্টিন ইউক্রেন যুদ্ধের একজন অন্যতম ধারাভাশ্যকার। ছিলেন পদাতিক বাহিনীর সাবেক অফিসার। তার মতে, 'ইউক্রেনীয়রা যে কৌশলে যুদ্ধ লড়ছে, তা তাদের সেনা ও সরঞ্জামের দ্রুত সুপরিকল্পিত পরিচালনার ওপর ভিত্তি করে চলছে। দরকার মতো শত্রুর সম্মুখসারিতে যেমন আঘাত করছে, তেমনি প্রয়োজনে পাশ কাটিয়ে গিয়ে আঘাত হানছে পেছন থেকে। এই কৌশলের জন্য গতি ও ক্ষিপ্রতা দরকার'।
তিনি বলেন, 'এই দুটি বিষয়ই হিমঠাণ্ডার মওসুমে ধরে রাখা কঠিন। তাই আমরা এ সময়ে সংঘাতের তীব্রতা কমে আসা লক্ষ করতে পারি– বিশেষত, তীব্র শীতের মাস ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
তাই শীত আসার আগেই খেরসন উদ্ধারে মরিয়া ইউক্রেনীয় বাহিনী। সমান ব্যাগ্রতায় শহরটি রক্ষা করতে চাইছে রুশ সেনারা।
পূর্বদিকে রাশিয়ান মার্সেনারি সেনাদের বিরুদ্ধে বাখমুত শহরের আশেপাশে নিজেদের অবস্থানও ধরে রাখতে পারে ইউক্রেনীয় বাহিনী। এতে স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতর্স্ক শহরে রাশিয়ার রসদ সরবরাহ ব্যাহত করা যাবে।
এদিকে রণাঙ্গনে আহত হয়ে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিচ্ছে রুশ ভালুক। প্রথম উস্কানি ইউক্রেনের পক্ষ থেকেই আসবে বলে দাবি করছে রাশিয়া। মস্কোর দাবি, ইউক্রেন 'ডার্টি বম্ব' বা তেজস্ক্রিয় বোমা হামলার পরিকল্পনা করছে।
স্নায়ুযুদ্ধের কালে অনেক চলচ্চিত্র হয়েছে ডার্টি বম্বের হুমকি নিয়ে। এটি পারমাণবিক বোমার মতো ব্যাপক ধবংসাত্মক নয়, কিন্তু ব্যাপক স্থিতিশীলতা বিনাশী।এর প্রভাব রয়ে যেতে পারে বহু বহু বছর। ন্যাটোর শঙ্কা, ইউক্রেনের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে রাশিয়া নিজেই করতে পারে একাজ। তাই হুমকিটি গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে ন্যাটো।
৮০ বছর পর প্রথমবারের মতো ইউরোপের মাটিতে রোমানিয়ায় ১০১তম ছত্রীসেনা ডিভিশনের সদর দপ্তর সরিয়ে এনেছে আমেরিকা। এখান থেকে বেশি দূরে নয় ইউক্রেন সীমান্ত।
ইউক্রেন যুদ্ধে হস্তক্ষেপের বাস্তব প্রশিক্ষণ শুরু করেছে ১০১তম ডিভিশন। তাদের সাথে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে রোমানিয় সেনারাও।
ডিভিশনের দ্বিতীয় ব্রিগেডের কম্ব্যাট টিমের অধিনায়ক কর্নেল এডউইন ম্যাথাইডেস বলেছেন, ' ইউক্রেনে এখন যেভাবে যুদ্ধ চলছে, আমাদের মহড়ায় সেই অনুসারে পরিস্থিতি ও লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে'।
সুতরাং, একটি দিক স্পষ্ট– শীত অশনি বার্তা নিয়েও আসতে পারে। 'জেনারেল শীত' ইউক্রেন যুদ্ধকে মন্থর যেমন করতে পারে– তেমনি যেকোনো একপক্ষের হঠকারিতায় তা ভয়ানক পরিণতির দিকে যেতেও সময় লাগবে না।