সৌন্দর্যই যে পাখিদের জীবনে বিপন্নতার ছায়া
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের পুকুরপাড়ে বসে পাখিদের সৌন্দর্য দেখছি, সাথে সাথে ক্যামেরাতেও ক্লিক করছি। আসছে নানা রঙের, বর্ণের, আকৃতির পাখিসহ বন্যপ্রাণীরা। শেষবিকেলে পুকুর থেকে মিষ্টি পানি পান করছে, কেউ করছে স্নান, কেউ বা ব্যস্ত জলকেলিতে। শেষ বিকেলের আলোছায়ায় হঠাৎ চোখ আটকাল মথুরা নামক পাখিটির উপর। ক্যামেরার ক্লিক রেখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি পাখিটির উপর। নীলভ কালো রঙের শরীরের সামনে সিঁদুরে লাল মুখ। কালোর মাঝেও যে এত সৌন্দর্য থাকে তা মথুরা না দেখলে বোঝার উপায় নেই। এরপর স্ত্রী পাখিটি এল, আর সৌন্দর্য আরও বেড়ে গেল। কিন্তু এই পাখিটি বাংলাদেশের বিপন্ন প্রজাতির পাখির অন্তর্ভুক্ত। পাখিটির সংখ্যা দিন দিন কমেছে। অবৈধ শিকার, আহরণ, পাচার, আবাসস্থল ধ্বংস পাখিটিকে বিপন্নতার মুখে ঠেলে দিয়েছে। এরকমই একটি পাখি ময়ূর, যা আজ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে বিলুপ্ত। আর বিলুপ্তির প্রহর গুনছে কাঠময়ূর, বনমুরগিসহ বাকি সদস্যরা। এই পাখিগুলো Galliformes-এর অন্তর্ভুক্ত।
Galliformes (গ্যালিফর্মিস) হলো একটি বৈচিত্র্যময় পাখি বর্গ যা পৃথিবীর বিভিন্ন তৃণভূমি, বন, পাহাড়ি বন, নলখাগড়ার বন ও সাভানা অঞ্চলে বিস্তৃত। এই অর্ডারে অন্তর্ভুক্ত প্রধান পরিবারগুলো হলো Phasianidae (Pheasants, Peafowl, Partridges, Quails), Numididae (Guineafowl), Odontophoridae (New World Quails), এবং Megapodiidae (Megapodes)। এরা সাধারণত স্থূল, মেদযুক্ত, মাঝারি থেকে বড় আকারের পাখি। এদের সংক্ষিপ্ত, গোলাকার ডানা, শক্ত পা এবং মাটিতে দৌড়ানোর জন্য অভিযোজিত শক্তিশালী পা থাকে। এই বর্গের প্রজাতির মধ্যে পুরুষদের বৈশিষ্ট্য খুবই উজ্জ্বল, যেমন ক্রিস্ট বা মাথার ঝুঁটি, ওয়াটল বা থুথনির ঝোলানো অংশ, দীর্ঘ বা ঝুলন্ত লেজ, এবং প্রজননকালীন বিশেষ অঙ্গভঙ্গি ও জোরালো ডাক। বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে মাটিতে বাসা বানানো, সর্বভুক খাদ্যাভ্যাস, মাটিতে দৌড়ানো, ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকানো গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়।
Galliformes-এর প্রাচীন পূর্বপুরুষের উৎস প্রায় মায়োসিন যুগে (প্রায় ২৫-৩০ মিলিয়ন বছর আগে) এশিয়ার শুষ্ক তৃণভূমি ও বনপ্রান্ত অঞ্চলে দেখা যায়। বিবর্তনের সময় এরা মাটিতে দৌড়ানো, ঝোপঝাড়ে লুকানো, শক্তিশালী পা ও ঠোঁট এবং সর্বভুক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে পরিবেশের বিভিন্ন নির্দিষ্ট অংশে অভিযোজিত হয়েছে।
অধিকাংশ Galliformes প্রজাতি মাটিতে চড়ে বেড়ায়। তারা ঝোপঝাড়, ঘাসভূমি, নলখাগড়ার বন, নদীতীরবর্তী প্রান্তরে বাস করে। কিছু প্রজাতি পাহাড়ি অঞ্চলেও বাস করে। সামাজিক আচরণ প্রজাতিভেদে ভিন্ন; Junglefowl ও Pheasant একক বা জোড়ায় থাকে, অন্যদিকে Quail বা Partridge ছোট দলে চলে। প্রজননকালীন সময়ে পুরুষরা সুদৃশ্য পালক এবং বিশেষ অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে, এলাকা সুরক্ষা করে এবং ডাকের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা দেখায়। ছানা জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দৌড়াতে ও বিচরণ করে খেতে সক্ষম।
Galliformes বর্গের পাখিরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থলজ পরিবেশে বাস করে। সাধারণত তৃণ ভূমি, ঘাসবন, বাদাবন, ঝোপঝাড়, পাহাড়ি বন, ঢাল ও গাছপালা মিশ্রিত বনপ্রান্ত, নদীতীরবর্তী চর ও ঘাসবন, কৃষিজমি, এবং প্লাবন ভূমিতে।
Galliformes প্রজাতি সাধারণত সর্বভুক। অর্থাৎ বীজ, শস্য, ঘাস, ফল, পাতা, পোকামাকড়, শামুক, ছোট স্তন্যপায়ী এবং প্রায়ই ছোট সরীসৃপ খায়। খাদ্য অনুসন্ধানে তারা মাটির উপর খোঁড়াখুঁড়ি করে, পাথর বা মাটির সাহায্যে দানা ভাঙে এবং ঝোপঝাড়ের আড়ালে খাবার খোঁজে।
Galliformes বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেশ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যেমন, বীজ ছড়ানো, পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ, শিকার ও শিকারি পাখি ও স্তন্যপায়ীদের খাদ্য উৎস।
বনমুরগি, ময়ূর, কাঠময়ূর, মথুরা Phasianidae পরিবারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এদের বিবর্তন, শারীরিক বৈশিষ্ট্য, আচরণ, আবাসস্থল ও বিস্তারে যেমন মিল রয়েছে, তেমনি রয়েছে চোখে পড়ার মতো পার্থক্য।
বনমুরগি মূলত এশিয়ার উষ্ণমণ্ডলীয় আর্দ্র বনভূমিতে বিবর্তিত একটি আদিম পাখিদের দল, যার স্বীকৃত প্রজাতি চারটি—লাল, ধূসর, সবুজ ও শ্রীলঙ্কান—যারা আজও বন, পাহাড় মানুষের বসতি ও কৃষিজমির প্রান্তবর্তী অঞ্চলে টিকে আছে। এরা দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পাখি। এদের স্বভাব সাধারণত লাজুক, দিনের বেশিরভাগ সময় মাটিতে খাবার, যেমন বীজ, পোকামাকড়, কচিপাতা খুঁজে কাটায়; আর রাতে উঁচু ডালে বসে থাকে। লাল বনমুরগি মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান ও কৃত্রিম নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রায় ৮ হাজার বছরের দীর্ঘ গৃহপালন যাত্রায় ধীরে ধীরে আধুনিক গৃহপালিত মুরগিতে রূপ নিয়েছে, যা তাদের বিবর্তন ইতিহাসের এক অনন্য উদাহরণ।
ফেজান্ট গোষ্ঠীটি তুলনামূলকভাবে আরও বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময়। এদের অন্তর্ভুক্ত প্রায় ৫০টির বেশি প্রজাতি পূর্ব এশিয়ার পাহাড়ি অরণ্য, মধ্য এশিয়ার তৃণভূমি, হিমালয়ের উপত্যকা, ইউরোপের নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চলসহ বহু ভিন্ন আবাসে টিকে রয়েছে। ফেজান্টদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো উজ্জ্বল পালক, দীর্ঘ লেজ ও পুরুষ পাখির আড়ম্বরপূর্ণ প্রজননকালীন আচরণ। অনেক প্রজাতির প্রজনন ব্যবস্থা বহুস্ত্রীক, অর্থাৎ একটি পুরুষ একাধিক স্ত্রী পাখির সঙ্গে মিলন করে; ফলে পুরুষদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা তাদের দেহরূপকে আরও অলংকারময় করেছে। ফেজান্টরা মূলত সর্বভুক, তবে অনেক প্রজাতি বনাঞ্চলের ফল, বীজ ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীর ওপর নির্ভরশীল। এদের বেশ কয়েকটি প্রজাতি বিপন্ন, কারণ আবাসস্থল ধ্বংস, শিকার ও কৃষিজমির প্রসার তাদের জীবনচক্রে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।
পিফাউল বা ময়ূর এই পরিবারে সবচেয়ে অলংকারময় ও দৃষ্টিনন্দন পাখি। দেশি ময়ূর (Pavo cristatus), সবুজ ময়ূর (Pavo muticus) ও কঙ্গোর ময়ূর (Afropavo congensis)—এই তিনটি প্রজাতির প্রত্যেকটিরই রঙিন পালক, পুরুষ পাখির লম্বা লেজের পাখা, এবং প্রজনন-প্রদর্শন আচরণ তাদেরকে অনন্য করে তুলেছে। দেশি ময়ূর দক্ষিণ এশিয়ার শুষ্ক বন, কৃষিজমি ও আধা-শহুরে পরিবেশে মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান করতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে সবুজ ময়ূর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঘন চিরসবুজ বনে দ্রুত বিলীন হচ্ছে এবং কঙ্গো পিফাউল আফ্রিকার কঙ্গো বেসিনের রহস্যময় বনে সীমিত বিস্তার নিয়ে টিকে আছে। প্রজননকালীন নির্বাচনের চাপের সময় বিশেষত স্ত্রী পাখির পছন্দের কারণে পুরুষ ময়ূরের দেহরূপ পৃথিবীর সবচেয়ে সুশোভিত পাখিগুলোর একটি হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে।
তিনটি গোষ্ঠীরই phylogeny বা বংশগত ইতিহাস নির্দেশ করে যে তারা প্রাচীন Galliformes-এর মধ্যে মায়োসিন যুগে (প্রায় ২০-২৫ মিলিয়ন বছর আগে) বৈচিত্র্যময় হতে শুরু করে। তাদের দেহগঠন, শক্ত পা, স্থলজ জীবনযাপন, সীমিত উড়ানক্ষমতা, গাছে রাত্রি যাপন, সর্বভুক খাদ্যাভ্যাস তাদের একটি যৌথ বিবর্তনমূলক উত্তরাধিকার বহন করে। তবে পরিবেশগত চাপ, ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা, জলবায়ুর পরিবর্তন, এবং মানুষের সঙ্গে দীর্ঘ সহাবস্থানের ফলে আজ তারা তিনটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীতে রূপ নিয়েছে, যাদের বিস্তার এশিয়ার ঘনবর্ষা-অরণ্য থেকে আরবের শুষ্ক ভূমি, ইউরোপের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল থেকে আফ্রিকার রেইনফরেস্ট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে জাঙ্গলফাউল বা বনমুরগি, ফেজান্ট ও পিফাউলের বর্তমান অবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ভিন্ন এবং তিনটি গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই মানবসৃষ্ট পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যায়। বনমুরগির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে শুধু লাল বনমুরগি (Gallus gallus) দেখা যায়, কিন্তু এর জনসংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীর অরণ্য, কক্সবাজারের পাহাড়ি বন, মধুপুর বন, সুন্দরবন ও সিলেটের কিছু অংশে ছোট বিচ্ছিন্ন দল টিকে আছে। বনভূমি ধ্বংস, গ্রামসংলগ্ন এলাকায় শিকার ও গৃহপালিত মুরগির সঙ্গে সংকরায়ন এর জন্য বড় হুমকি।
ফেজান্টের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বর্তমানে মথুরা ( Kalij Pheasant) ও কাঠ ময়ূরের (Grey Peacock Pheasant) দেখা মেলে। চট্টগ্রামের বনাঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেটের বনাঞ্চলে মথুরার ও কাঠ ময়ূরের দেখা পাওয়া যায়। ময়ূরের ক্ষেত্রে শালবন, উত্তরের সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলে একসময় দেশি ময়ূরের (Pavo cristatus) বিস্তার ছিল। কিন্তু অতিরিক্ত শিকার, কৃষিজমির বিস্তার ও বনভূমি ধ্বংসের কারণে বাংলাদেশে বুনো পরিবেশে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত এই দেশি ময়ূর বর্তমানে শুধু চিড়িয়াখানা বা ব্যক্তিগত খামারে বন্দি অবস্থায় দেখা যায়। সবুজ ময়ূরের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ১৯৩০-এর পর এর আর স্থায়ী জনসংখ্যা বাংলাদেশে দেখা পাওয়া যায়নি।
বাতাই (পার্ট্রিজ) ও তিতির (ফ্র্যাঙ্কোলিন) ফ্যাসিয়ানিডি পরিবারের দুটি পাখির গ্রুপ, যাদের যৌথ বিবর্তনীয় ইতিহাস প্রায় ২০-২৫ মিলিয়ন বছর আগের মায়োসিন যুগে এশিয়া ও আফ্রিকার খোলা বনভূমি ও শুষ্ক তৃণভূমির অঞ্চলে। তখন স্থায়ী ঘাসভূমি গঠনের সাথে সাথে মাটিতে দৌড়ানো, শক্ত পা, স্থূল দেহ, দানা-বীজভুক খাদ্যাভ্যাস এবং ঝোপের নিচে নিভৃতে বাসা বানানোর সক্ষমতা তাদের বিশেষ অভিযোজন হিসেবে বিকশিত হয়।
বাতাই সাধারণত প্রায় ২০টি প্রজাতি নিয়ে গঠিত, যাদের বৈশিষ্ট্য অপেক্ষাকৃত গোলাকার দেহ, রুক্ষ বাদামি-ধূসর পালক, নিম্নস্বরে যোগাযোগ এবং ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার শুষ্ক ঘাসভূমি, স্তেপ, পাহাড়ি ঢাল ও কৃষিভূমিভিত্তিক বাসস্থানে বিস্তৃতি।
অন্যদিকে তিতিরের ৩০টিরও বেশি বৈচিত্র্যময় প্রজাতি রয়েছে, যাদের বিস্তৃতি প্রধানত আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে; তারা অধিক বলিষ্ঠ, অধিক আক্রমণাত্মক স্বভাবের, উচ্চস্বরে ডাকের মাধ্যমে বিচরণ ভূমি তৈরি করে এবং লম্বাটে দেহ, শক্ত পা, ঝোপঝাড়-মিশ্র অরণ্য-কৃষিজ জমি-সাভানার মতো মানবসংলগ্ন অঞ্চলেও নিজেদের সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। দুই গোষ্ঠীই প্রধানত মাটিতে খাদ্য সংগ্রহ করে। তাদের খাদ্যতালিকায় থাকে ঘাসের বীজ, শস্য, পোকামাকড়, কন্দমূল, কচিপাতা, যা তাদের সর্বভুক হিসেবে চিহ্নিত করে। প্রজনন মৌসুমে এরা বেশ অন্যরকম আচরণ প্রদর্শন করে, মাটিতে খোলা বাসা বানিয়ে ৮ থেকে ১৫টি পর্যন্ত ডিম দেয়। বাচ্চারা জন্মের পরই দৌড়াতে সক্ষম। তাদের জাতিজনি বিশ্লেষণে দেখা যায়, তিতিররা আফ্রিকার সাভানা ও শুষ্ক ঝোপঝাড় থেকে বৈচিত্র্য লাভ করেছে, আর বাতাইরা ইউরেশিয়ার উন্মুক্ত তৃণভূমি অঞ্চলে অভিযোজিত হয়েছে। বর্তমানে কৃষিজমি সম্প্রসারণ, অতিরিক্ত শিকার, ঘাসভূমি ধ্বংস, বন অবক্ষয় ও আগ্রাসী প্রজাতির বিস্তারের কারণে এরা ঝুঁকির সম্মুখীন। বাংলাদেশে ধলাগলা বাতাইয়ের উপস্থিতি সিলেট ও চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে থাকলেও লাল গলা বাতাই আইইউসিএন ২০১৫-এর তথ্যমতে বিলুপ্ত হয়েছে।
বর্তমানে শেখ ফরিদ বা কালো তিতির, যা স্থানীয় ভাবে পান-বিড়ি-সিগরেট নামেও পরিচিত, একে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকায় দেখা যায়।
ধূসর তিতিরকে বাংলাদেশে বিলুপ্ত করা হলেও একে বাংলাদেশের রাজশাহীর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পাওয়া যায়। পাশাপাশি বাদা তিতির এদেশ থেকে একেবারে বিলুপ্ত।
Quail, বটেরা বা কোয়েল হলো ফ্যাসিয়ানিডি পরিবারের Coturnicini ট্রাইবের অন্তর্গত ছোট আকৃতির স্থলজ পাখি, যার বিশ্বে প্রায় ১৭-২০টি প্রজাতি রয়েছে। বিবর্তনগতভাবে এদের উৎস প্রায় ২৫-৩০ মিলিয়ন বছর আগের মায়োসিন যুগে, যখন এশিয়া-আফ্রিকার বিস্তৃত ঘাসভূমি ও ঝোপঝাড় অঞ্চলে শক্তিশালী পা, ছোট গোলাকার ডানা, দ্রুত দৌড়ানো ও লুকিয়ে থাকার আচরণ তাদের প্রধান অভিযোজন হিসেবে গড়ে ওঠে। Coturnix গণের Common Quail, Japanese Quail, Rain Quail , Harlequin Quail, Brown Quail ও Stubble Quail সবচেয়ে পরিচিত। এদের বিস্তৃতি ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ভারতীয় উপমহাদেশ, চীন-জাপান থেকে অস্ট্রেলিয়ার তৃণভূমি পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। Common Quail দীর্ঘ দূরত্বের পরিযায়ী হলেও অন্য প্রজাতিরা মূলত স্থানীয় বা স্বল্পদূরত্বের পরিযায়ী। কোয়েল সাধারণত ঘাসভূমি, খোলা ঝোপঝাড়, কৃষিজমি, নদীতীরবর্তী প্রান্তর ও সাভানার মতো খোলা বাসস্থানে থাকে, মাটিতে বাসা বানায় এবং দানা-বীজ, শস্য, কচি পাতা, পোকামাকড় ইত্যাদি খেয়ে সর্বভুক জীবনধারা অনুসরণ করে। দ্রুত প্রজনন, লুকানো স্বভাব, ছানা জন্মানোর সাথে সাথে দৌড়াতে পারে। তবে মানবসৃষ্ট ঝুঁকিতে এরা আজ বিপন্ন।
বাংলাদেশে তিন প্রজাতির প্রজাতির কোয়েল বা বটেরা জাতীয় পাখির দেখা মেলে। এর মধ্যে পাতি বটেরা, বৃষ্টি বটেরা ও রাজ বটেরা বা পডল অন্যতম। সারাদেশের ঘাসভূমি ও প্লাবনভূমিতে কালে ভদ্রে এদের দেখা মেলে।
যদি একটু খেয়াল করে দেখা হয়, বাংলাদেশে টিকে থাকা ও বিলুপ্ত হওয়া মিলে Galliformes বর্গে মোট ১৩ প্রজাতির পাখি আছে। এর মধ্যে পাঁচ প্রজাতি প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত। বাকিদের মধ্যে এক প্রজাতির বিপন্ন, দুই প্রজাতির সংকটাপন্ন, তিন প্রজাতির তথ্য স্বল্পতার অভাব, এক প্রজাতি প্রায় ঝুঁকি গ্রস্থ এবং এক প্রজাতি ঝুঁকিমুক্ত। তাহলে এটা পরিষ্কার, এই পাখিরা বাংলাদেশের অন্যতম বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা পাখিদের বর্গের অন্তর্ভুক্ত।
গ্যালিফর্মিস (Galliformes) গোষ্ঠীর পাখি, যেমন বনমোরগ, ফিজেন্ট, কোয়েল, পার্ট্রিজ ও ময়ূর প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করে। পরিবেশগতভাবে এরা বীজ বিস্তারের মাধ্যমে বন পুনর্জন্মে সহায়তা করে, বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ও ক্ষতিকর পোকামাকড় ভক্ষণ করে তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে, মাটিতে খাদ্য অনুসন্ধানের সময় মাটি ঝুরঝুরে করে উর্বরতা বৃদ্ধি করে এবং বহু মাংসাশী প্রাণীর খাদ্য হিসেবে খাদ্যজালের ভারসাম্য বজায় রাখে। একই সঙ্গে আবাসস্থল ধ্বংস ও অতিরিক্ত শিকারের প্রতি সংবেদনশীল হওয়ায় এরা একটি এলাকার পরিবেশগত স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হিসেবেও কাজ করে।
যথাযথ বন সংরক্ষণ ও বন ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ ব্যতীত এই পাখিদের সংরক্ষণ সম্ভবনয়। এখনই উদ্যোগ না নিলে আমরা হারিয়ে ফেলব আমাদের দেশের অমূল্য সম্পদ এই পাখিদের।
ছবি: লেখকের সৌজন্যে
- আশিকুর রহমান সমী: বন্যপ্রাণী বিষয়ক গবেষক, পরিবেশবিদ ও লেখক; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব