নারী উদ্যোক্তাদের কেকের উৎসব, আগারগাঁওয়ে ‘কেকপট্টি’ যেমন দেখা গেল

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের সামনের সড়ক এখন যেন উৎসবের নগরী। প্রতিদিন বিকেল হলেই সেখানে বসে 'কেকের হাট'। কেউ একে বলেন 'কেকের মেলা', কেউবা মজা করে নাম দিয়েছেন 'কেকপট্টি'। ফেসবুক ও ইউটিউবের ভিডিও দেখে এখন দলে দলে ছুটে আসছেন কেকপ্রেমীরা।
বিকেল গড়াতেই মেট্রোরেলের আগারগাঁও স্টেশন থেকে নির্বাচন ভবনের পথে শুরু হয় জমজমাট কেক বিক্রি। সন্ধ্যা নামলেই তা পরিণত হয় উৎসবে। পুরো সড়ক ভরে যায় ক্রেতা, বিক্রেতা ও কৌতূহলী মানুষের ভিড়ে।
নির্বাচন ভবনের সামনের মোড় থেকে সরকারি সংগীত কলেজ পর্যন্ত সারিবদ্ধভাবে বসে শতাধিক ভ্রাম্যমাণ দোকান। কেউ টেবিল পেতে, কেউ গাড়ির বনেটকে শোরুম বানিয়ে বিক্রি করছেন ঘরে বানানো নানা স্বাদের কেক—চকলেট, ভ্যানিলা, ব্লুবেরি, রসমালাই, বাটার স্কচসহ আরও অনেক কিছু।
যদিও গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে রাস্তার পাশে খাবার বিক্রি চলে আসছে, তবে কেক বিক্রির এমন জোয়ার দেখা গেছে সম্প্রতি—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে 'ভাইরাল কেক বিক্রি'র কারণে।
ভাইরাল বিক্রেতা 'জাকির' ও 'সিমি আপা'
এই হাটের জনপ্রিয়তার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ফেসবুক ও ইউটিউবের। এখন সেখানে 'ভাইরাল জাকির' ও 'সিমি আপা' নিয়ে ব্যাপক মাতামাতি। তারা দুজনই অনলাইন সেনসেশনে পরিণত হয়েছেন।
জাকিরকে দেখা যায় আইসিটি টাওয়ারের বিপরীতে কেক বিক্রি করতে, আর নির্বাচন ভবনের সামনে বসেন সিদরাতুল মুনতাহা সিমি। বিকেল ৫টার পর তারা দোকান সাজিয়ে বসেন, তবে অন্য বিক্রেতারা শুরু করেন বিকেল ৪টার পর থেকেই।
গত এক সপ্তাহে সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিন প্রায় ১৫০ জন বিক্রেতা কেক বিক্রি করতে আসেন। শুধু নির্বাচন ভবনের বিপরীত দিকেই প্রতিদিন ৩০–৩৫ জনকে দেখা যায়। প্রতি স্লাইস কেক বিক্রি হয় ১০০–১২০ টাকায়, আর পুরো কেক ৮০০–১,০০০ টাকায়।
সিমির গল্প
৫ অক্টোবর বিকেল ৫টার দিকে সিমি কেক নিয়ে বসেছিলেন। সন্ধ্যা নামার আগেই তার দোকানে ভিড় জমে যায় ইউটিউবার ও টিকটকারদের। তারা ভিডিও করছেন, প্রশ্ন করছেন—আর সিমি হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছেন। সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে তার সব কেক বিক্রি শেষ।
সিমি টিবিএসকে বলেন, 'গত মাসের মাঝামাঝি আমি আগারগাঁওয়ের জাকির ভাইয়ের দোকানের কেক খেয়েছিলাম। এর চার–পাঁচ দিন পর, ২১ সেপ্টেম্বর প্রথম ৫টা কেক নিয়ে আসি। সব বিক্রি হয়ে যাওয়ায় এরপর থেকে প্রতিদিনই আসছি। একদিন সর্বোচ্চ ২৪টা কেক বিক্রি করেছি।'

প্রায় পাঁচ বছর ধরে ঘরোয়া ভাবে কেক বানান সিমি। আগে পরিবার ও আত্মীয়দের জন্য বানালেও এখন উৎসাহ পেয়ে স্থায়ী দোকান খোলার চিন্তা করছেন। ফেসবুকে খুলেছেন নিজস্ব পেজও।
তার পাশে ছিল ছেলে তামিম—পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। স্বামী ও ছেলেকে নিয়ে মিরপুরে থাকেন সিমি। কেক বানানো থেকে বিক্রি পর্যন্ত পরিবারের সবাই তাকে সহযোগিতা করে।
সিমি বলেন, 'আমি যখন এখানে কেক বিক্রি শুরু করি, তখন মাত্র তিন–চারজন বিক্রেতা ছিল। আমার দেখে এখন অনেক নারী উদ্যোক্তা কেক বিক্রি শুরু করেছেন।'
নারীদের হয়রানি না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমি শখ থেকে এখানে এসেছি। সবাই যদি সহযোগিতা করে, অশালীন আচরণ না করে, তাহলে আরও এগিয়ে যেতে পারব। আমাদের যেন কেউ হয়রানি না করে—এটা সরকারেরও দেখার দায়িত্ব।'
জায়গা দখল ও প্রতিযোগিতা
সরকারি সড়ক হওয়ায় জায়গা দখল নিয়ে প্রতিযোগিতাও কম নয়। আগে আসলে যে যেখানে পারে, সেখানেই বসে পড়ে বিক্রেতারা। কোনো দোকানে বেশি ভিড় হলে পরদিন অন্যরা সেই জায়গা দখল করার চেষ্টা করেন। সিমিও একসময় আইসিটি টাওয়ারের সামনে বসতেন; জায়গা না পেয়ে এখন নির্বাচন ভবনের সামনে এসেছেন। তার চারপাশে আরও প্রায় দশজন নারী বিক্রেতা কেক বিক্রি করছেন।

বেশিরভাগ বিক্রেতা প্রতিদিন ৮–১০টি কেক নিয়ে আসেন। বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আগারগাঁওয়ের এই সড়কজুড়ে জমে ওঠে এক অনানুষ্ঠানিক উৎসব। পরিবার, তরুণ–তরুণী, এমনকি বিদেশি পর্যটকও এখন নিয়মিত আসছেন 'কেকপট্টি'তে।
মোহাম্মদ আহাদ মজা করে বলেন, 'নির্বাচন ভবনের সামনে এখন নির্বাচন নয়, কেক নিয়েই বেশি আলোচনা!'
স্ট্রিট ফুড থেকে কেক উন্মাদনা
আগারগাঁও এলাকায় গত কয়েক বছর ধরেই এলইডি আলোয় আলোকিত রাস্তার দু'পাশে নানা খাবারের দোকান বসে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) কার্যালয় পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এই ব্যস্ততা।
দোসা, শাহী লুচি, পিঠা, বার্গার, ফুচকা, তন্দুরি চা, চটপটি, বেলপুরি, শাওয়ারমা, ফলের জুস—সব ছিল আগে থেকেই। এখন সেই তালিকায় নতুন সংযোজন 'ভাইরাল কেক'।
তবে অনেকে মনে করেন, এই কেক উন্মাদনা সাময়িক। একজন বিক্রেতা বলেন, 'ভাইরাল হয়ে এসেছে, সময় গেলে মিলিয়েও যাবে। থেকে যাবেন যারা নিয়মিত খাবার বিক্রি করেন।'
নতুন উদ্যোক্তাদের উত্থান
কেক হ্যাভেনের ফাহাদ তানভির জানান, 'উত্তরায় আমরা অনলাইনে চার বছর ধরে কেক বিক্রি করছি। ফেসবুকে আগারগাঁওয়ের কেক বিক্রির খবর দেখে এখানে এসেছি। শুক্রবারে বেশি বিক্রি হয়—সেদিন ১২টা, অন্য দিন ৮টা কেক নিয়ে আসি।'
ইব্রাহিম হোসেন বলেন, 'দিনে চাকরি করি, অফিস শেষে স্ত্রীর বানানো কেক নিয়ে সন্ধ্যায় এখানে আসি। এটা আমাদের বাড়তি আয়ের পথ।'
ক্রেতাদের মধ্যেও আনন্দ স্পষ্ট। ঝুমুর বেগম বলেন, 'ঢাকায় ঘোরার জায়গা কম, এখানে ঘোরাও হয়, কেক খাওয়াও হয়।' তিনি প্রতি স্লাইস ১০০ টাকায় কেক কিনেছেন।
মোহাম্মদ নুমায়ের বলেন, 'দুই মাস আগেও এত ভিড় ছিল না। কেক ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই মানুষের আনাগোনা বেড়েছে।'

তার স্ত্রী যোগ করেন, 'দামের তুলনায় কেকের মান ভালো। গতকাল আমার জন্মদিনে ৩,০০০ টাকায় দোকান থেকে কেক কিনেছিলাম—এখানকার কেক তার চেয়ে ভালো।'
'ঘরে বানানো' ব্র্যান্ডে বিক্রি
কয়েকজনকে দেখা যায় নিজেদের গাড়িতেই কেক বিক্রি করতে। এক বিক্রেতা বলেন, 'স্বামী পরিবারের জন্য গাড়ি কিনেছিলেন, এখন সেই গাড়ি নিয়েই কেক বিক্রি করি।' তাদের অনলাইন পেজও রয়েছে।
চকলেট ক্রিম, রসমালাই, মালাই, ডাব, ব্লুবেরি, রেড ভেলভেট, ওরিও, চিজ—এমন সব কেকের সারি সাজিয়ে ক্রেতাদের আহ্বান, 'একটু ট্রাই করে যান কেক!'
বুধবার বিকেলে দেখা যায়, কেকের পাশাপাশি অনেকে নিয়ে আসছেন ঘরে বানানো বিরিয়ানি। রাতে হাঁসের মাংস ও রুটি বিক্রি করতেও দেখা যায় কয়েকজনকে।
একসময় 'হলিডে মার্কেট'
২০২৩ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঐক্য ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এখানে চালু হয়েছিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য 'হলিডে মার্কেট'।
শুক্র ও শনিবার নির্দিষ্ট উদ্যোক্তারা ৩–৬ হাজার টাকা ভাড়ায় সেখানে দোকান বসাতে পারতেন। পর্যটন ভবন থেকে নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত সড়কে তখন গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকত।
তখনকার বিক্রেতাদের একজন ফারিয়া আক্তার খান বলেন, 'হলিডে মার্কেট চালুর পর থেকেই আমি "Farhana's Cake Corner" নামে কেক বিক্রি করি। তখন শৃঙ্খলা ছিল, সবাই বসতে পারত না। এখন কেউ কেউ বেকারি থেকে কেক কিনে এনে ঘরে বানানো বলে বিক্রি করছে।'
তিনি আরও জানান, এখন তারা প্রতিদিন ১৩–১৪টি কেক বিক্রি করেন এবং ফেসবুক পেজেও অর্ডার নেন।
'এখন যারা ময়লা পরিষ্কার করেন, তাদের প্রতিদিন ৫০–১০০ টাকা দিতে হয়। তবে অন্য কাউকে কোনো টাকা দিতে হয় না,' বলেন ফারিয়া।
যেভাবে উঠে গেল এই কেকের বাজার
এদিকে, গত বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) রাত থেকে অস্থায়ী এই দোকানগুলো সরিয়ে দিতে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
পুলিশ জানায়, এই দোকানগুলো সড়কে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছিল। তাই নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে এসব দোকান সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ দিন পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল (শুক্রবার) থেকে আর দোকান বসতে দেয়া হবে না। তবে সংখ্যায় কম হলেও শুক্র ও শনিবারেও দোকান বসতে দেখা গেছে এ রাস্তায়।
শের-ই-বাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমামুল হক বলেন, 'যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ টহল অব্যাহত রয়েছে। আমাদের নির্দেশনা কেবল কেকের দোকানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা অন্যান্য অস্থায়ী দোকানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।'
একজন নারী কেক বিক্রেতা সাংবাদিকদের জানান, তারা বিক্রি করার জন্য কেক নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু পুলিশের টহলের কারণে তারা এখানে তাদের স্টল স্থাপন করতে পারেননি। তিনি বলেন, 'আমরা পুলিশের সাথে কথা বলেছি। তবে, তারা এখনও আমাদের কথায় সায় দেননি।'