ক্ষোভ থেকে ফের দস্যুতায়; সুযোগ পেলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায় সুন্দরবনের দস্যু দল জাহাঙ্গীর বাহিনী

প্রত্যেকের হাতে একটি করে গুলি লোড করা আগ্নেয়াস্ত্র, চারদিকে নজর রেখে সতর্ক অবস্থান, প্রত্যেকের পোশাকও একই। মজুত রয়েছে প্রচুর গোলাবারুদ, ধারালো অস্ত্রশস্ত্রও। সুন্দরবনের গহীনে কেউ কেউ অবস্থান করছে নিজস্ব নৌকায়, কেউ বনের ভূমিতে আস্তানায়, আবার অনেকেই আছেন বনের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করার জন্য বনজীবী সেজে বিভিন্ন জেলেদের নৌকায়। দলে আছে ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, রাঁধুনি, শিক্ষক, নাপিতের মতো পদগুলোও। তার মধ্যে দলের প্রধানের কাছে আসছে অহর্নিশ মোবাইল কল। বনজীবীরা সুন্দরবনে মাছ বা কাঁকড়া সংগ্রহ করার জন্য বাড়ি থেকে রওনা হওয়ার অনুমতি নিচ্ছে তাদের কাছে।
দল প্রধান নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার পরিমাণ জানিয়ে দিলে সেই টাকা আসছে বিকাশ নম্বরে। তারপর রেজিস্ট্রি খাতায় সেই জেলের তথ্য লিপিবদ্ধ করে তাকে বনে আসার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি সুন্দরবনের শীর্ষ ডাকাতদল জাহাঙ্গীর বাহিনীর আস্তানায় গিয়ে এই চিত্র দেখতে পেয়েছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এই প্রতিবেদক।
গণ-অভ্যুত্থানের পর সুন্দরবনে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে এমন ২০টি সংঘবদ্ধ ডাকাত দল। জেলে, বাওয়ালি, মাওয়ালিসহ বনজীবীদের জিম্মি করে তারা এভাবেই অর্থ আদায় করছেন।
জাহাঙ্গীর বাহিনীর সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল, তাদের দলে প্রায় ৫০ জন সদস্য রয়েছেন। প্রত্যেকের বিপরীতে একটি করে আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। গোলাবারুদেরও কোনো অভাব নেই।
এই বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছেন বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর শেখ। তার সঙ্গে দল পরিচালনা করছেন আরও দুই দস্যু নেতা পিরোজপুর জেলার মো. জয়নাল আবেদিন ওরফে রাজন ওরফে দাদা ভাই এবং বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার রনজাইপুর গ্রামের মাঞ্জুর সরদার। এই তিনজনই সুন্দরবনে বেশ আগে থেকেই পৃথক ডাকাতদল পরিচালনা করতেন। তবে ২০১৮ সালে সরকারি আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
আত্মসমর্পণের পরও ফের কেন তারা সুন্দরবনে গিয়ে দস্যুতা শুরু করলেন— সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন এই প্রতিবেদক। এই তিন দস্যু প্রধান তাদের ক্ষোভের কথা জানান।
দলনেতা জাহাঙ্গীর শেখ জানান, ২০১৮ সালে দলের ৯ জন সদস্য নিয়ে সরকারের কাছে র্যাবের সহযোগিতায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন তিনি। তবে সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি না রাখা ও প্রশাসনিক হয়রানির কারণে আবারও ডাকাতিতে নামতে বাধ্য হয়েছেন।
তিনি বলেন, 'আত্মসমর্পণের পর আমাদের প্রত্যেকে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করে দুই কিস্তিতে দেওয়া হয়েছে। আর কেউ একটি বাড়ি বা দোকান বা একটি গরু—যে কোনো একটি পেয়েছে। যা আমাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য অতি সীমিত ছিল। আত্মসমর্পণের পর আমাদের এলাকায় কোনো অঘটন ঘটলে বিনাদোষে পুলিশ আমাদের নামে মামলা টুকে দিত। আমি একদিন দাকোপের কালাবগী অবস্থান করছিলাম। পরে দেখি রামপাল পাওয়ার প্লান্টের চুরির মামলায় আমার নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে। পরে পুলিশের কাছে গিয়ে বিষয়টি জানতে চাইলে ধমক দিয়ে থানা থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর র্যাবের কাছে গিয়ে প্রতিকার চাইলেও তারা আমাকে সাহায্য করতে অনীহা জানায়।'
তিনি বলেন, 'মূলত পুলিশ যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আসামি না খুঁজে পেত তখন সন্দেহভাজনভাবে আমার নামে মামলা দিত, কারণ আমি একসময়ে বনদস্যু ছিলাম। আমাকে ফাঁসানো সহজ বিষয় ছিল। এই রকম অনগণিত প্রশাসনিক হয়রানির কারণে আবারও বনে আসতে বাধ্য হয়েছি।'
একই রকম ক্ষোভের কথা জানালেন মো. জয়নাল আবেদিন ওরফে রাজন ওরফে দাদা ভাই। তিনি বলেন, '২০১৮ সালে দলের ১১ জন সদস্য নিয়ে সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলাম। আত্মসমর্পণটা করেছিলাম সুন্দর একটি জীবন উপভোগ করার জন্য—সাধারণ মানুষ যেভাবে বেঁচে থাকে, পরিবারের সাথে সেইভাবে বাঁচার জন্য। তবে অল্প কয়েক দিন আমরা ভালো থাকতে পেরেছিলাম। আমি চট্টগ্রামে গিয়ে একটি চাকরি নিই। তখন র্যাব-৬ থেকে আমাকে ডেকে বলা হয় তোমাকে আমাদের আওতাধীন এলাকায় থাকতে হবে, কোথায় কি করো, তোমার সদস্যরা কি করে আমাদের নজর রাখতে হবে। তাই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হই; তখন র্যাব থেকে একটি মটরসাইকেল দেওয়া হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'র্যাব বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে আমাদের ত্রাণ নেওয়ার জন্য ডাকতো। বাড়ি থেকে ২ হাজার টাকা খরচ করে গিয়ে সেখান থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকার ত্রাণ পেতাম। আমাদের তখন ভালো জীবন কাটাচ্ছি বলে লিখিত বক্তব্য পাঠ করানো হতো। একদিন আমরা ভালো নেই বলে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছিলাম, তখন আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর থেকে আমার জীবনে আবারও অভিশাপ নেমে আসে। র্যাব থেকে আমার সেই মটরসাইকেলটাও নিয়ে নেয়া হয়।'
দাদা ভাই বলেন, 'হঠাৎ করে একদিন আমাকে র্যাব-৬ এর কার্যালয়ে ডেকে বেদম প্রহার করে তিন দিন গুম করে রাখা হয়, পরে ভুয়া মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়, বলা হয় তোমাকে কিছুদিন ভিতরে থাকতে হবে। তখন আমার স্ত্রী গর্ভবতী ছিল এবং সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা প্রসব করেন। স্ত্রীর সেই কষ্টের মুহূর্তে আমি পাশে থাকতে পারলাম না। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর বাচ্চাটা মায়ের বুকের দুধ পান করতে পারেনি। কারণ আমার স্ত্রী সেই সময়ে সিজারের ব্যথা নিয়ে আদালতের প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়িয়েছে। এই কষ্ট আমাকে এখনো কাঁদায়। পরে ঋণ করে টাকা নিয়ে আমার স্ত্রী জামিনের ব্যবস্থা করেন। সেখান থেকে বের হয়ে যেখানে গিয়ে চাকরি নিই, কয়েকদিন পরে তারা যখন জানতে পারে আমি একসময়ে বনদস্যু ছিলাম, তখন তারা আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে। তখন মনে হচ্ছিল আত্মসমর্পণ করেই ভুল করলাম—আমাকে মানুষ হিসেবে বসবাস করতে দেওয়া হয়নি। সবাই চোর ডাকাত বলে গালাগালি করতো। প্রশাসনের সাহায্য চাইলে তারাও হেয় করতো। যার ক্ষোভ থেকে আবারও এই পেশায় ফিরতে হয়েছে।'

ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন মাঞ্জুর সরদারও। তিনিও ২০১৮ সালে ১৩ জন সদস্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তিনি বলেন, 'র্যাব সদস্যরা আমাদের অনেক প্রলোভন দিয়ে আত্মসমর্পণ করিয়েছিলেন। তবে একপর্যায়ে গিয়ে তারা আমাদের সাথে কুকুরের মতো ব্যবহার করেছেন। যাদের আশ্রয়ে আলোর পথে ফিরেছিলাম, তারা যখন আমাদের চিনে না, তখন পুরনো পেশায় না ফিরে আর উপায় ছিল না।'
এই দলে থাকা প্রত্যেক দস্যুরই এমন এক হৃদয়বিদারক ঘটনা রয়েছে। অনেকেই রাজনৈতিক হয়রানি, এলাকার আধিপত্যের লড়াইয়ে গণমামলার আসামি, বা কেউ কেউ অভাবের তাড়নায় পড়ে এই দস্যু বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে যদি আবারও পর্যাপ্ত সুবিধা ও সহায়তা পায়, তখন আবারও আলোর পথে ফিরতে চায় এই দস্যু বাহিনীর সব সদস্যরা।
দলনেতা জাহাঙ্গীর বলেন, 'বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা যদি আমাদের সেই সুযোগ দেন, যদি আমাদের পর্যাপ্ত সুবিধা দিতে পারেন তবে আমরা আবারও আলোর পথে ফিরে যাব। আমাদেরও পরিবার আছে; স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে চাই।'
এছাড়া দাদা ভাই বলেন, 'আমরা যদি আত্মসমর্পণ না করি তাহলে সরকারের কোনো বাহিনীর এই সামর্থ্য নেই বনকে দস্যুমুক্ত করতে পারবে। কারণ এত বড় বনে যে কোনো সরকারের বাহিনী থেকে আমরা বেশি অভিজ্ঞতা নিয়ে চলি। তাই সরকারের কাছে আহ্বান—আমাদের পর্যাপ্ত সুবিধা দিয়ে আলোর পথে ফেরার সুযোগ প্রদান করা হোক।'
আরেক দস্যু নেতা মাঞ্জুর সরদার বলেন, 'আমার একটা নাতি আছে, যে আমাকে দেখতে না পেয়ে বলে হয়তো নানাভাই মারা গেছে। এসব যখন চোখে ভাসে তখন আর দস্যুতা করতে ইচ্ছা হয় না। সরকার চাইলে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাই। তবে আমাদের সাথে যেন আগের মতো বেইমানি না করা হয়।'
সুন্দরবনে বনদস্যুতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তবে ২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত র্যাবের অভিযানে সুন্দরবনের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য, ৪৬২টি অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে। ফলে সম্পূর্ণরূপে জলদস্যুমুক্ত হয় সুন্দরবন। এরপর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করেন।
র্যাব-৬ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ৩৭০টির বেশি সফল অভিযান পরিচালনা করে ৯১১ জন বনদস্যুকে তারা গ্রেপ্তারপূর্বক ২০২৮টি অস্ত্র ও ৪২,৬৯০ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছিল। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পরে এই বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার কারণে আবারও সুন্দরবনে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে বনদস্যু বাহিনীগুলো। তবে বর্তমানে র্যাবের সাথে যোগাযোগ করা হলে এই বিষয়ে কোনো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই বনের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষকের কার্যালয় থেকে। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, 'দস্যু দলগুলো এতটাই প্রভাবশালী যে বন বিভাগের একার পক্ষে তাদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সরকারের কাছে ব্যাপারটি জানালে, এই অঞ্চলের বিভিন্ন বাহিনীর সাথে উপদেষ্টারা একটি সমন্বয় সভা করেছেন। সেখানে কোস্টগার্ডকে সুন্দরবনের দস্যু নির্মূলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।'
কোস্টগার্ডের পশ্চিম জোনের স্টাফ অফিসার (অপারেশন) লে. কমান্ডার আবরার হাসান বলেন, '২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে সুন্দরবনে জলদস্যুদের উৎপাত শুরু হলে কোস্টগার্ড সুন্দরবনে মোট ২৬টি সফল অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে ৩৭টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৪৩টি বিভিন্ন প্রকার দেশীয় অস্ত্র, অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামাদি, ১৬৭ রাউন্ড তাজা কার্তুজ, ৩৬৯ রাউন্ড ফাঁকা কার্তুজ, ২টি ককটেল এবং ৪৭৯টি স্প্লিন্টার বল উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াও মোট ৪৪ জন জলদস্যু ও তাদের সহযোগীরা আটক করা হয়েছে এবং জলদস্যুদের নিকট জিম্মি থাকা ৪৪ জন জেলেকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'কোস্টগার্ডের এসব অভিযানের ফলে দস্যু বাহিনীর সদস্যরা বর্তমানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। দস্যু বাহিনী নির্মূলে কোস্টগার্ড নিয়মিত অপারেশন, হটস্পট এলাকায় বিশেষ টহল এবং গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।'
ডাকাতদলের আত্মসমর্পণের বিষয়ে তিনি বলেন, 'যদি কোনো দস্যু দল আত্মসমর্পণ করতে চায়, তাহলে আমরা সরকারের সাথে আলোচনা করে তাদের সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেব। বর্তমানে কোস্টগার্ড এ পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করার জন্য বিশেষ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।'