রিকশার হুড: দেশের রাস্তা থেকে পৌঁছে গেছে বিশ্বাঙ্গনে

আপনি কি আপনার আশেপাশের এমন কাউকে চেনেন, যে কখনো রিকশায় ওঠেনি? একটু ভেবে দেখুন! আমাদের দেশে এমন কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে কোনোদিন রিকশায় ওঠেনি। রিকশা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য এক বাহন।
রিকশা শুধু বাহন হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আমাদের পপ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে রিকশা এবং এর নানা শৈল্পিক অনুষঙ্গ। এর মধ্যে অন্যতম হলো রিকশা পেইন্টিং।
রিকশা পেইন্টিং নিয়ে মাতামাতি আমাদের দেশে একদম শুরু থেকেই ছিল। ১৯৪৭ সালের পরে কলকাতা থেকে আমাদের দেশে রিকশার আগমন ঘটে। কলকাতায় তখন হাতে টানা রিকশার প্রচলন ছিল। আমাদের দেশে রিকশা প্রথমে বাহারি ও শৌখিন বাহন হিসেবে জনপ্রিয় হয়। ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার একজন বাঙালি জমিদার এবং ওয়ারী অঞ্চলের একজন মারোয়ারি ছয়টি রিকশা কিনে ঢাকার রাস্তায় নামিয়েছিলেন।
সেই সময় থেকেই রিকশা পেইন্টিংয়ের শুরু। রিকশার পেছনের পাতলা টিনের শেডের ওপর যে নানা বাহারি ছবি আঁকা হয়, সেটাই রিকশা পেইন্টিং নামে পরিচিত।
১৯৮৮ সালে লন্ডনের মিউজিয়াম অফ ম্যানকাইন্ড-এ ঢাকার রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রদর্শনীর নাম ছিল 'ট্রাফিক আর্ট: রিকশা পেইন্টিং ফ্রম বাংলাদেশ'। এর কিউরেটর ছিলেন শিরিন আকবর। ব্রিটিশ জাদুঘরেও বাংলাদেশের রিকশা পেইন্টিং সংরক্ষিত আছে।
১৯৯৯ সালে ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে বাংলাদেশের রিকশা পেইন্টিংয়ের অন্যতম বড় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নিয়েছিলেন ৫০০ জন রিকশা পেইন্টার এবং ৮৩ জন বেবি ট্যাক্সি পেইন্টার।
রিকশা পেইন্টিং নিয়ে আমাদের মাতামাতি থাকলেও রিকশার হুড নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। হুডকে কেবল রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচার মাধ্যম হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু হুডের বিচিত্র সব নকশা ও শৈলী নান্দনিকতার ছাঁচে ফেললে তা নিয়েও করা যায় বিস্তর আলোচনা।

রিকশার হুড সাধারণত রেক্সিনের ওপর নানা ধরনের পলিথিনের ডিজাইন করা আকার-আকৃতি সেলাই করে বানানো হয়। ঝালর ও পুতিও দেওয়া হয় চাহিদা অনুযায়ী। অতীতে শুধু পলিথিন দিয়ে হুড বানানো হতো, তবে সেগুলো বেশিদিন টিকত না। তুলনায় রেক্সিনের হুড বেশি টেকসই।
হুড আলাদা জায়গায় তৈরি হয়। কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভারের বিভিন্ন এলাকায় শুধু রিকশার হুড বানানোর দোকান আছে। হুড বানানোর পুরো প্রক্রিয়া দেখতে আমরা গিয়েছিলাম কেরানীগঞ্জে। সেখানকার হুডের ডিজাইন কীভাবে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছাল এবং কীভাবে তৈরি হয় রিকশার এই নান্দনিক হুড—সে নিয়েই আজকের গল্প।
এক হুডের অনেক কারিগর
কেরানীগঞ্জে ঢোকার মুখে পোস্তগোলা ব্রিজের নিচে রয়েছে রেক্সিনের কয়েকটি দোকান। এ দোকানগুলোর সামনে নতুন বানানো হুড ঝুলিয়ে রাখা হয় রিকশাচালকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য।
এমনই একটি দোকান 'ভাই ভাই রেক্সিন'। দোকানের সামনে ঝুলছে দুইটি নতুন হুড। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল, দুইজন কর্মী ব্যস্ত রেক্সিন কাটা আর পলিথিনের নকশা জোড়া লাগাতে।

কিছুক্ষণ পর দোকানের মালিক উজ্জ্বল ভাই এসে যোগ দিলেন। প্রায় পনেরো বছর ধরে তিনি এই এলাকায় হুডের ব্যবসা করছেন। তার দাবি, ভাই ভাই রেক্সিন থেকেই সবচেয়ে বেশি হুড কেনাবেচা হয়। আমি সেখানে থাকা অবস্থাতেই পাঁচজন রিকশাচালক এসেছিলেন হুড কিনতে বা পরিবর্তন করতে।
উজ্জ্বল ভাই বলেন, "হুডের ব্যবসা বারো মাস চলে। বৃষ্টির দিনে তো আরও বেশি চলে। আগে টানা রিকশা (প্যাডেল রিকশা) বেশি ছিল, তখন রিকশাওয়ালারা নিজেরা হুড কিনতে আসতেন না। গ্যারেজ মালিকরাই কিনতেন। এখন মেশিন রিকশা অনেক বেড়ে গেছে। অনেকে নিজেরাই সিএনজি বেচে দুই-তিনটা মেশিন রিকশা কিনে রাস্তায় নামান। তারা নিজেরাই এসে হুড কিনে নিয়ে যান। ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে।"

হুড তৈরির প্রক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি জানান, এটি একজনের কাজ নয়—অনেক কারিগর মিলে একটি হুড তৈরি করেন। যেমন–তার এই দোকানে করা হয় হুডের যে মূলভিত্তি কাপড় বা রেক্সিন, তার কাজ। রিকশাওয়ালারা এসে নিজের পছন্দ অনুযায়ী রঙের কাপড় দেখিয়ে দেন। সেই কাপড় মাপ মতো কেটে পাঠানো হয় কারখানায়।
হুডে ছোট ছোট পলির নকশা থাকে—ফুল, পাতা, তারা—এগুলোও এখানে তৈরি হয়। এছাড়া, কিনতে পাওয়া যায় বিভিন্ন রঙের ঝালর।
এরপর উজ্জ্বল ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন হুডের যে বাঁশের কাঠামো, তা বানানোর কারখানায়। সেখানে সারি সারি সাজানো ছিল গোল আর বর্গাকৃতির হুড। প্যাডেল রিকশার জন্য গোল হুড আর মেশিন রিকশার জন্য বর্গাকৃতির হুড ব্যবহার হয়।

হুডের মূল কাঠামো তৈরি হয় বাঁশ দিয়ে। এই বাঁশ প্রতি জোড়া কেনা হয় ২৪০ থেকে ২৬০ টাকায়। এক জোড়া বাঁশ দিয়েই একটি রিকশার হুড তৈরি করা যায়। প্রয়োজন অনুযায়ী বাঁশগুলোকে গোল করে বাঁকিয়ে বা বর্গাকৃতির করে জোড়া লাগিয়ে হুড বানানো হয়।
হুডের আলাদা আলাদা বাঁশ জোড়া দিতে ব্যবহার করা হয় লোহার তৈরি পাঁচ হাতযুক্ত একটি যন্ত্র, যাকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় 'পাঞ্জা'। এই পাঞ্জায় বাঁশ জোড়া লাগানোর কাজ করেন আরেকজন মিস্ত্রি। আবার কিছু মেশিন রিকশার জন্য বাঁশের বদলে লোহার পাইপ ব্যবহার করা হয়। মজবুত হওয়ার কারণে বর্তমানে অনেকেই লোহার পাইপের হুড নিচ্ছেন বলে জানালেন উজ্জ্বল ভাই।
কারখানা থেকে বের হয়ে উজ্জ্বল ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন সেলাই কারখানায়। হুডে যেসব নকশা দেখা যায়—রেক্সিনের শরীরে লাগানো সব নকশাই এখানে সেলাই করা হয়। পলির তৈরি নকশাগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি জুড়ে দেওয়া হয় সেলাই করে। তারপর সেগুলো আবার সেলাই করে লাগানো হয় রেক্সিনে। সঙ্গে যুক্ত হয় নানারঙের বাহারি ঝালর।
সেলাই মেশিনের সামনে বসে এক নাগাড়ে কাজ করছিলেন একজন কারিগর। লাল রেক্সিনের জমিনে সবুজ বেস সেলাই করার পর তার ওপর বসানো হচ্ছিল সোনালি, গোলাপিসহ নানা রঙের ও আকৃতির নকশা।

উজ্জ্বল ভাইয়ের বানানো হুডগুলোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো—প্রতিটি হুডের পেছনে লেখা থাকে 'আয়শা'। জানতে চাইলে হাসতে হাসতে তিনি বলেন, "আমার মেয়ের নাম আয়শা।"
একটি হুড সম্পূর্ণ করতে সময় লাগে এক থেকে দুই দিন। সেলাইয়ের কাজেই লেগে যায় একদিন। আরেকদিন লাগে ফিটিং করতে।
উজ্জ্বল ভাই জানান, "হুডের দাম নির্ভর করে আকৃতির ওপর। গোল হুডের দাম ২,২০০ থেকে ২,৭০০ টাকা পর্যন্ত। স্কয়ার হুডের দাম ২,৮০০ থেকে ৩,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়। আর এখন লোহার হুডের চাহিদা বেশি, দামও বেশি। এগুলোর দাম ৩,২০০ থেকে ৩৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়। এতজন কারিগরের হাত ঘুরে একটি হুড তৈরি হয়, এজন্য দামও বাড়তির দিকে।"

রিকশা থেকে র্যাম্পে
রাইসা আমিন শৈলী একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। তিনি টেকসই ও বহুমুখী ফ্যাশন ব্র্যান্ড 'খুশ'-এর উদ্যোক্তা। ছোটবেলা থেকেই পোশাক ডিজাইনের প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল। এ আগ্রহের অনুপ্রেরণা তিনি পান মায়ের কাছ থেকে।
গত বছরের আগস্টে ধানমন্ডিতে জ্যামে বসে থাকার সময় সামনে দাঁড়ানো একটি রিকশার কারুকার্য চোখে পড়ে তার। রঙিন নকশা দেখে ঠিক করেন—রিকশার হুডের ডিজাইন দিয়েই তিনি জামা বানাবেন। সেই থেকে শৈলী তার পরবর্তী ফ্যাশন প্রজেক্ট হিসেবে বেছে নেন রিকশার হুডের নকশা।
পুরো ঢাকা ঘুরে ঘুরে তিনি দেখেছেন নানা এলাকার রিকশার হুডের ডিজাইন। শৈলী বলেন, "আমি খেয়াল করে দেখলাম, সব এলাকার রিকশার হুডের ডিজাইন ভিন্ন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সব ধরনের ডিজাইনের রিকশা চলে। বিষয়টা এত কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছিলো!"
তিনি সিদ্ধান্ত নেন, রিকশার হুডের নকশা দিয়ে একটি গাউন বানাবেন। গাউনের ওপরে থাকবে হুডের মতো আকৃতি। তবে কাজটি একেবারেই সহজ ছিল না।

শৈলী বলেন, "রিকশা গাউনের জন্য ওয়্যারেবল ফেব্রিক সংগ্রহ হয়ে গেলেও আমার প্রয়োজন মতো রিকশার পলিথিন কেটে দেবে এমন কাউকে পাচ্ছিলাম না। যেহেতু আমি এই বিষয়ে নতুন, তাই পলিথিনগুলো কীভাবে কাটতে হবে সেটিও বুঝতে পারছিলাম না। অনেক ঝামেলার পর লিটন ভাই আর উজ্জ্বল ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। উজ্জ্বল ভাইকে নকশা দেখালে তিনি সাহায্য করতে রাজি হন।"
তিনি আরও বলেন, "উজ্জ্বল ভাইয়ের কারিগরদের সঙ্গে সারাদিন কাজ করেছি। হুডের নকশার পলিথিনগুলো এত পাতলা—প্রথমে ভয় ছিল কীভাবে সেলাই করব! ড্র্যাপিং প্যাটার্নের সাহায্যে ফেব্রিক কেটে সেটায় লেয়ার করলাম। তারপর মায়ের সাহায্য নিয়ে সেলাই করেছি। শেষে হুডের আকার বানিয়ে ফেব্রিক দিয়ে ড্রেপ করে সাজিয়েছি।"

শৈলী কৃতজ্ঞতা জানান উজ্জ্বল ভাই ও তার কারিগরদের প্রতি। তাদের সাহায্য ছাড়া এই কাজ সম্ভব হতো না বলে মনে করেন তিনি। রিকশা হুড থিমের গাউনটি সেলাই করতেই সময় লেগেছে এক মাস, আর পুরো কাজ শেষ করতে লেগেছে ছয় মাস।
ডিটিজি ফ্যাশন উইকে শান্ত মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টলে প্রদর্শনীর জন্য রিকশা গাউনটি বাছাই করা হয়। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফ্যাশন মডেল ও কিউরেটর আজরা মাহমুদের নজরে আসে এই অনন্য গাউনটি। তারপর আজরা মাহমুদ জানান, তিনি এটিকে ন্যাশনাল কস্টিউম হিসেবে ব্যবহার করতে চান।
রিকশার হুডের নকশা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া নিয়ে উজ্জ্বল ভাই বলেন, "ভালোই তো লাগে। শৈলী আপা অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছেন এটার জন্য। আমরা যতটুকু পারি সাহায্য করেছি। আমার আর কিছু চাওয়ার নাই। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন। আর ঢাকার রাস্তায় কোনো রিকশার হুডের পেছনে যদি দেখেন 'আয়শা' লেখা, মনে করবেন ওইটা আমার বানানো।"
ছবি: ফাইয়াজ আহনাফ সামিন