মেহেদি রাঙানো ঈদ: যেমন কাটে মেহেদি শিল্পীদের

শেষ বিকেলের ম্লান আলো জানান দিচ্ছে সন্ধ্যার আগমনী বার্তা। পবিত্র রমজানের শেষ দিন। চাঁদ দেখা গেছে। কাল ঈদ।
চাঁদরাতে সন্ধ্যা নামতেই চারদিকে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। বাড়িভর্তি কচিকাচার দল—কেউ খেলছে, কেউ হাসছে, কেউ আড্ডায় মশগুল। ঈদের আগের রাতটা যেন সাজগোজের প্রস্তুতিতে অনেকটা খুশি আর ভালোবাসার রঙে হয়ে ওঠে জীবন্ত।
বাড়ির মেয়েরা তখন দল বেঁধে হাতে মেহেদির নকশা তুলতে বসে। গল্পগাছার ফাঁকে একেক হাত ভরে ওঠে একেক নকশায়।
চাঁদরাতে মেয়েদের এই মিলনমেলা চিরায়ত। পাড়াপড়শি, মামাতো, চাচাতো বোনের দল কিংবা বহুদিনের বান্ধবী—সবাই একসাথে বসে যায় মেহেদি পরার উছিলায়। পরদিন যেহেতু ঈদ, তাই মেহেদি পরার মতো বিষয়ে একেবারেই ঝুঁকি নেওয়া চলে না।
মেহেদির এই আসর বসে এমন কারও বাড়িতে, যিনি নকশা তুলতে দক্ষ।
কারো পছন্দ কলকা, কেউ চান লতাপাতার সঙ্গে সূক্ষ্ম নকশা, আবার কেউ চান ঈদের চাঁদের নকশা। ইন্টারনেটের যুগে এখন নকশার অভাব নেই, কিন্তু চাই একজন দক্ষ নকশাদার। সেই নকশাদারের ভূমিকায় থাকেন আমাদের বড় বোন, পড়শি কিংবা বান্ধবীরা। সবার হাত রাঙিয়ে দিতে দিতেই তারা চাঁদরাতের আনন্দে মিশে যান।
ছেলেবেলায় এই নকশাদারদের অনেকটা জাদুকরের মতো মনে হতো। জাদুকর না হলে মিনিট দশেকেই এত সুন্দর নকশা আঁকা যায় কীভাবে? তখন তারা কেউই অর্থের বিনিময়ে মেহেদি পরানোর কথা ভাবতেন না।

যুগ বদলেছে। সেই গুণী মেয়েরা আজ অনেকেই মেহেদির প্রতি ভালোবাসাকে পেশায় রূপ দিয়েছেন। পাড়ায় পাড়ায় দেখা মেলে এমন শিল্পীর, যাঁরা এখন পরিচিত 'মেহেদি আর্টিস্ট' নামে।
ঈদের আগে দর্জি আর মেহেদি শিল্পীদের ব্যস্ততা নিয়ে লিখতে গেলে যেন শেষ হয় না। ঈদ মানেই আনন্দ, সাজসজ্জা আর উৎসব। আর সেই সাজসজ্জায় মেহেদি থাকবে না—তা কি হয়?
রমজানজুড়ে মেহেদি শিল্পীরা অগ্রিম বুকিং নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তবুও শেষ কয়েক দিনেই সবচেয়ে বেশি ভিড় জমে। কেউ ভাবেন আগেভাগে মেহেদি পরলে ঈদের রং পুরোনো হয়ে যাবে। আবার অনেকেরই কাজের ব্যস্ততা কিংবা ছুটিছাটার ঝক্কি থাকে। এজন্য প্রায় সবাই চান ঈদের এক-দুদিন আগেই মেহেদি পরতে।
নাজমুস সাদাত ছামি এমনই একজন মেহেদি শিল্পী, যার চাঁদরাত কেটে যায় মেহেদির নকশায়। ছোটবেলায় ঈদের আগে বড় বোনের হাতে মেহেদি পরতেন। বোনের আঁকা নকশাগুলো মুগ্ধ করত, মনে হতো—'যত গাঢ় রং, তত বেশি ঈদের আনন্দ'। তখনই মনে হতো, এমন নকশা যদি নিজেই আঁকতে পারতাম!
সেই ভালো লাগা থেকেই ছামির মেহেদির সঙ্গে বন্ধুত্ব। নিজে নিজে আঁকতে শিখেছেন। বোনের বিয়ের পর পাড়াপড়শির অনেকে চাঁদরাতে ছামির কাছে ভিড় করতেন। ছামি কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না।

এভাবেই একদিন মাথায় আসে পারিশ্রমিকের কথা। মেহেদির প্রতি ভালোবাসা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে পেশা।
ঈদের সময় ছোটদের সালামি দিতে হয়—সেই টাকাটা যদি মেহেদি পরিয়ে আয় করা যায়, খারাপ কী! এভাবেই ছামির শুরুটা।
ছেলেবেলায় তিনি টিউব মেহেদিই পরতেন। তখন ক্লাস ওয়ান বা টু-তে পড়েন। সে সময় পাতাবাটা মেহেদির বদলে টিউব মেহেদি জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। 'এলিট মেহেদি' ছিল প্রায় সব ঘরে।
টিউব মেহেদিতে যেমন ডিজাইন করায় সুবিধা, তেমনি পাঁচ মিনিটেই রঙ ধরে। যারা মেহেদি পরতে ভালোবাসতেন কিন্তু বেশি সময় ধৈর্য ধরে রাখতে পারতেন না, তাদের কাছে টিউব মেহেদি ছিল যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ।
তবুও মা-চাচিদের হাতে তখনো পাতাবাটা মেহেদির চল ছিল। নখের ডগায় আর হাতের তালুতে খুব সাধারণ নকশা।

তবে মেহেদি শুধু ঈদেই থেমে থাকেনি। বাঙালি মুসলমান পরিবারে ঈদের সময় বিয়ের আয়োজন অনেকটাই প্রচলিত। ফলে চাঁদরাতেই মেহেদি তোলা শেষ হয় না, ঈদের পরের কয়েক সপ্তাহ চলতে থাকে বিয়েবাড়িতে যাওয়া।
কনের হাতে মেহেদি পরাতে গেলেও বিয়েবাড়িতে ছোট–বড় অনেকেই ছামির কাছে ভিড় করেন। তিনি তখন দিন-রাত ব্যস্ত থাকেন নতুন নতুন নকশায় মানুষকে হাসিমুখে ফেরাতে।
আগে বিয়েতে মেহেদি পরার চল থাকলেও এখনকার মতো ব্যাপক 'ট্রেন্ড' ছিল না। অবাঙালি বিয়েতে হাতভর্তি নকশার যে রীতি, তা বাঙালিরা নিজেদের মতো করে আয়ত্ত করেছে গত এক দশকে। এখন কনের হাতে মেহেদির কারুকাজ যেন হয়ে উঠেছে একখানা অলংকারের মতো।

কনের দু হাতে ভারী নকশা তুলতে ছামির লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। পারিশ্রমিক নির্ভর করে ডিজাইনের ওপর। ব্রাইডাল মেহেদির জন্য তিনি নেন দুই হাজার থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত। ঈদের মেহেদির শুরু ১০০ টাকা থেকে।
মেহেদি তুলে ফেলার পর হাতে খাঁটি সরষের তেল মাখলে রঙ দীর্ঘস্থায়ী হয়—এটা আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু ছামির কাছেই জানা গেল, মেহেদি শুকিয়ে আসার পর হাতে চিনি জল দিলে রঙ আরও গাঢ় হয়। চাইলে এতে লেবুর রসও মেশানো যেতে পারে।
মেহেদি শিল্পী সেমন্তী খানের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল, শুধু ঈদ নয়, বিয়ের অনুষ্ঠানেও মেহেদির ব্যবহার বদলে গেছে। একসময় শুধু কনেরাই মেহেদিতে বরের নাম লিখতেন, কিন্তু এখন বরও কনের নাম লিখছেন মেহেদি দিয়ে। এভাবেই পুরোনো ঐতিহ্য নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করছে।
ঈদের আগের রাতে সেমন্তীকে সন্ধ্যা থেকে শুরু করে মাঝরাত পর্যন্ত মেহেদি পরাতে হয়। শুরুর দিকে যখন তিনি মেহেদি শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন, তখন এতটা ব্যস্ততা সামলানো সহজ ছিল না। কিন্তু এখন এই ভিড়ভাট্টা একধরনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

সেমন্তী বলেন, "চাঁদরাতে জোড়া জোড়া হাতের ভিড় না থাকলে ঈদের আমেজটা ঠিক জমে না। শত ব্যস্ততার মাঝেও যখন মানুষের মুখে হাসি দেখি, তখন সব ক্লান্তি কোথায় যেন মিলিয়ে যায়।"
বাজারে বর্তমানে প্রচলিত টিউব মেহেদির বেশিরভাগই কেমিক্যাল রিঅ্যাকশনের সমস্যায় আক্রান্ত করে বলে অনেকেই এখন বিকল্প হিসেবে অর্গানিক মেহেদির দিকে ঝুঁকছেন। তবে অর্গানিক মেহেদির দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। এই অবস্থায় 'কাভেরী' ও 'প্রেম দুলহান' ব্র্যান্ডের মেহেদি যেন অনেকের জন্য পরিত্রাতা। দাম সাধ্যের মধ্যে এবং গুণগত মানও ভালো।
সেমন্তীর সঙ্গে গল্পে গল্পে উঠে এল মেহেদির খুঁটিনাটি। ডিজাইনের ক্ষেত্রে এখন ইন্সটাগ্রাম, পিন্টারেস্ট বড় সহায়। যেখানে আগে টিউব মেহেদির প্যাকেটে থাকা ফ্রি নকশার কাগজ, ম্যাগাজিন কিংবা পত্রিকার লাইফস্টাইল পাতার কাটিং-ই ছিল ভরসা, সেখানে এখন অনলাইন রেফারেন্সই প্রধান উৎস।

তবু মৌলিক নকশার একটা আলাদা আবেদন থাকে। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া রেফারেন্সের সঙ্গে নিজের কল্পনার মিশেলে তৈরি নকশাগুলো পেয়ে যাচ্ছে হাতের তালুতে সুন্দর ঠাঁই।
চাঁদ, কলকা, ফাঁকা নকশার দিনগুলো এখন অনেকটাই অতীত। এখন জনপ্রিয় আরবি হরফ, পাকিস্তানি ও রাজস্থানি নকশা। পাশাপাশি অর্নামেন্টাল, জ্যামিতিক, পদ্ম, ম্যান্ডেলা, বিন্দু কিংবা লেইস ধরনের জটিল ও আধুনিক নকশার দিকে ঝোঁক বাড়ছে।
এছাড়া মেহেদি নকশার মধ্যে এখন নাম, তারিখ বা বিশেষ বার্তা জুড়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে।
মেহেদির রঙ আর নকশার নতুনত্ব থাকলেই কিন্তু চলে না, নকশা করতে হয় হাত বুঝে। যাদের হাতের তালু বড়, তাদের হাতে ভরাট নকশা মানানসই। আবার ছোট তালুতে তুলনামূলক হালকা নকশাই ভালো ফোটে।

আবার আঙুলের গঠন বুঝে নকশা করলে পুরো ডিজাইনের চেহারাই বদলে যায়। কারও সব আঙুলে নকশা আঁকলে ভালো লাগে, আবার কারও ক্ষেত্রে এক বা দুই আঙুলে সীমিত রাখাই বেশি মানিয়ে যায়।
তাই মেহেদি শিল্পীদের জন্য শুধু নকশার দক্ষতা থাকতেই চলে না, সৌন্দর্যবোধ আর ফ্যাশন সেন্সটাও থাকতে হয়।
এমন সব কথা জানাচ্ছিলেন খুলনার প্রতিভাবান মেহেদি শিল্পী সাদিয়া শরিফা।
ছোটবেলায় যে নকশা আমাদের চোখে ছিল একটুকরো জাদুর মতো, আজ তা অনেকের জীবিকা, কারও স্বপ্নপূরণের পথ।
ছামি, সেমন্তী, সাদিয়াদের মতো মেহেদি শিল্পীরা শুধু হাতে রঙ ছড়ান না, তাঁরা প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে দেন উৎসবের আমেজ।
বাজারে নানা ধরনের মেহেদি এলেও গাছ থেকে তুলে পাতাবাটা মেহেদির সেই ঘ্রাণ এখনো অনেকের মনে জাগায় তীব্র নস্টালজিয়া। আগের প্রজন্মের কাছে এই ঘ্রাণই ছিল ঈদের আগমনী বার্তা।
ঈদ আসে, দিন কাটে, সপ্তাহ পেরোয়। আস্তে আস্তে মেহেদির রং ফিকে হয়ে যায়। তবু তার ভেতরে জমে থাকে কত শত স্মৃতি, হাজারো উৎসবের গল্প।ফিকে হয়ে আসা সেই মেহেদির রং যেন নীরবে মনে করিয়ে দেয়—জীবনে কিছুই চিরস্থায়ী নয়। তবু অপেক্ষা ফুরোয় না আসছে বছরের ঈদের।
- ছবি: সৌজন্যে প্রাপ্ত