এনভেলোপ: হাতের নাগালে হাতে বানানো ঈদ কার্ড, সালামি কার্ড, চিঠির খাম

তখনও বাংলা একাডেমির বানানের আঁচড়ে 'ঈদ' 'ইদ' হয়ে যায়নি। আসেনি ভার্চুয়ালি শুভেচ্ছা বিনিময়ের ট্রেন্ড। ছেলেবেলায় ঈদ মানেই স্কুলের টিফিনে বন্ধুদের থেকে পাওয়া ঈদ কার্ড। ছোট্ট শুভেচ্ছা কার্ডে কাঁচা হাতে গোটা গোটা করে লেখা, 'ঈদ মোবারক'। কার্ডের ওপরে একফালি চাঁদ থাকবেই। কিছু কার্ড ছিল সাদামাটা, আর কিছু ছিল চকমকে ডিজাইনের।
সেসময় ভালো বন্ধু মনে হতো তাকেই, যে দিত সবথেকে সুন্দর ঈদ কার্ড। রমজান মাস পড়লেই স্কুলের কচিকাঁচাদের মধ্যে শুরু হতো হাতে বানানো কার্ড তৈরির তাড়াহুড়ো! আঠা, খাতার বাদ পড়া কভার, টুকিটাকি এটা-সেটা নিয়ে সবাই ঈদ কার্ড বানাচ্ছে। বন্ধুর থেকে পাওয়া সেসব ঈদ কার্ড জমত পেন্সিলবক্সের কোনায়।
অ্যাদ্দিন বাদে রিলস আর শর্টসের ভিড়ে কখনো কি সেই ঈদ কার্ডের দিনগুলো মনে পড়ে না? মনে তো পড়েই! ঈদ এলে মনটা সেই ছেলেবেলার ঈদ কার্ডের জন্যে আঁকুপাঁকু করে। কিন্তু কোথায় সেই হাতে বানানো কাগজ, খাম আর মহল্লার অস্থায়ী কার্ডের দোকানগুলো? কোথায় বা হাতে কার্ড বানানোর সময়?
দিনকয়েক আগে ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে সাজেশনে এল একটা পেইজ। ঈদ কার্ড, সালামি কার্ড আর হাতে বানানো খামের ছড়াছড়ি! সুন্দর সুন্দর নকশার এই খাম আর কার্ড দেখে যেন ফিরে গেলাম একেবারে ছেলেবেলায়। এ যেন টাইম ট্রাভেল!

ফুলকাটা নকশায় জায়নামাজের আদল কিংবা হিজাব পরা মেয়ের পাশে টুপি-পাঞ্জাবিতে একখানা বাচ্চা ছেলে—মিনি সাইজের সালামি কার্ডের ডিজাইনটা এমনই। কার্ডের সামনের জায়গাটাতে সালামির টাকা রাখার জন্যে একটুখানি স্থান রাখা হয়েছে। বিকাশের অনলাইন কার্ডের বিকল্প হিসেবে এই বন্দোবস্তটা মন্দ লাগল না।
সালামি কার্ডগুলো নিয়েই মশগুল হয়ে গেলাম খানিকক্ষণের জন্যে। এরপর চমকালাম বহুকাল আগের মিনি সাইজের ঈদ কার্ড দেখে। যেন হারিয়ে ফেলা শৈশব হাতে পেলাম! ক্যাপশনে লেখা, 'ঈদ অফারে প্রতিটি কার্ড ১০ টাকা'। মিনি সাইজের কার্ডের পাশাপাশি মাঝারি ও বড় সাইজের কার্ডও দেখা গেল। কোনো কোনো কার্ড আরবি হরফে সুশোভিত, আবার কোনোটা জানান দিচ্ছে ঈদের চাঁদের উপস্থিতি।
ঈদ ও সালামি কার্ডের বাইরে দেখলাম হরেক রকম খাম। চিঠির যুগ পেরিয়েছে অনেকদিন। চিঠি এখন নিছকই নস্টালজিয়া। বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখা এক টুকরো স্মৃতিমাত্র।
তবু কি চিঠিরা হারিয়েছে? পোস্ট অফিস আর পোস্ট বক্সের হলদে খামের ডানপাশে সবুজ ছোট্ট চিহ্ন, ১ কিংবা ২ টাকার ডাকটিকিটের গল্পগুলো আজ পুরোনো, বিবর্ণ। নিত্য যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে চিঠি যে আজ অকেজো, তা স্বীকার করতেই হয়।

তবু, বাঙালির একটুআধটু প্রেম কি প্রেমপত্র ছাড়া চলে? হাতে লেখা একটা চিঠি, সুন্দর খামে মুহূর্তকে বন্দি করার লোভ বোধ হয় আজও চিঠিকে ঢিমেতালে টিকিয়ে রেখেছে। কেউ কেউ হয়তো আজও আবদার করে বলে, 'করুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালোবাসি!'
চিঠিপ্রেমী না হয়েও 'এনভেলোপ' নামক এ পেইজটির খামের রাজ্যে হারালে মনে হবে, নাহয় লিখলাম একটা চিঠি! এই খামের দৌলতে তা লেখা যায় বইকি!
চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের সেই বিখ্যাত স্টারি নাইট, সানফ্লাওয়ার থিমের খাম যেমন আছে, তেমনি দেখলাম কাস্টমাইজড খাম। অর্থাৎ, কাস্টমার যেমন চাইবেন, তেমন বানিয়ে দেন এই খামের কারিগর। খামের নকশা, রঙের কম্বিনেশন, সাইজ—সবকিছুতেই একধরনের সৃজনশীলতা আর পরিশীলিত রুচির ছাপ। তাই, ইচ্ছে হল পেইজটির সত্ত্বাধিকারীর সাথে কথা বলার।

যোগাযোগের সুযোগ মিলল এই চিঠিপ্রেমীর সঙ্গে। মমতা জাহান নামের এই নারী ছোটোবেলা থেকেই অপার মমতায় খাম বানাতেন। সেই হাতে বানানো খামে পুরতেন নিজের লেখা চিঠি। চিঠির প্রতি একধরনের দুর্বলতা কাজ করত তখন থেকেই। সময়ের সাথে সাথে সে দুর্বলতা কেবল বেড়েছে।
শুরুটা যেভাবে
'চিঠি-খাম নিয়ে আমার জীবনে অজস্র গল্প আছে। ছোটোবেলা থেকে বাবা চাকরিসূত্রে দূরে থাকতেন। বাবাকে মনে পড়লেই আমার কাঁচা হাতে চিঠি লিখতাম। পোস্ট অফিস থেকে খাম কিনে পোস্ট করতাম। বাবার ঠিকানা থেকে ফিরতি চিঠি এলে কী যে এক অদ্ভুত আনন্দ ঘিরে ধরত! মাঝেমধ্যে মাকেও চিঠি লিখেছি। লুকিয়ে সেই চিঠি আবার রেখে দিতাম মায়ের বালিশের নিচে।
'একবার আমার এক প্রিয় মানুষের জন্মদিনে বিশেষ কিছু উপহার দিতে চাইছিলাম। সাথে একটা চিঠি। চিঠিটার সূত্রে নান্দনিক খাম, কার্ডের দরকার পড়ল। কিন্তু অনলাইনে অনেক খুঁজেও সেরকম কোনো খাম পাইনি। অফলাইনে স্টেশনারি দোকান ঘুরেও বাঁশপাতার পোশাকি খামের বাইরে অন্যরকম কিছু চোখে পড়েনি।

'অগত্যা ছুরি, কাঁচি, আঠা হাতে খাম বানাতে বসতে হলো। এভাবেই নিজ হাতে যত্ন করে বানিয়ে ফেললাম ডায়েরি, কার্ড, খাম। যাকে দেওয়া হলো, তিনি তো বেজায় খুশি। আস্তে আস্তে হাতে বানানো কার্ড, ডাইরি, খাম প্রিয় বন্ধু-বান্ধবী, ভাইবোন আর কাছের মানুষদের গিফট করা আমার নেশা হয়ে দাঁড়ায়।
করোনার সময় ঘরে বসে খাম বানাবার অভ্যেসটা বাড়ে। এসময়ই পেজ খোলবার কথা মাথায় আসে। ২০২১ সালে নেশাটাকে পেশা করবার তাগিদে ফেসবুকে "এনভেলোপ" নামে একটা পেইজ খুলি। তখনও ভাবিনি বাংলাদেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে আছে এত চিঠিপ্রেমী।
'তখন আমি কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃত বিভাগে ভর্তি হয়েছি। হাতে অফুরন্ত সময়। সেই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে খাম বানাচ্ছিলাম। প্রথমদিকের খামগুলো খুব সুন্দর যে হতো, তা নয়। তবু নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলত কাঁচি-কাগজ নিয়ে। খাম নিয়ে এসব এক্সপেরিমেন্ট জন্ম দিয়েছে অনন্য নকশার।
'প্রথমদিকে বিক্রি খুব বেশি ছিল না। ক্যাম্পাস আর আমার জেলাভিত্তিক কাস্টমারদের কাছে বেশি বেচাকেনা হতো। বছরখানেক পর থেকে পেইজের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে।' — এভাবে মমতা জাহানের ভাষ্যে শুনছিলাম তার খাম তৈরির জার্নিটা।

দাম যেমন পড়বে
'এনভেলোপ' পেইজের সবচেয়ে কম দামি খাম ৫ টাকা। ছোট্ট এই খামগুলো মূলত স্মৃতি হিসেবে রেখে দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়। এদিকে সবচেয়ে বেশি দামি খামের মূল্য ২০০ টাকা। এই দামি খামগুলোর মধ্যে রয়েছে কাস্টমাইজড ভিন্টেজ কিংবা যেকোনো থিমের খাম।
তবে এই পেইজের সেমি-ট্রান্সপারেন্ট এনভেলোপের চাহিদা সবথেকে বেশি। এটির বিশেষত্ব হলো নান্দনিক ডিজাইন। পাশাপাশি স্বচ্ছ কাগজের এই খামের ভেতর চিঠি দিলে বাইরে থেকে চিঠিখানা দেখা যায়। সেমি-ট্রান্সপারেন্ট এই খামগুলো ৪ থেকে ৫টি ধাপে বানাতে হয়। আবার খামের এই বিশেষ ধরনের কাগজ বেশ অপ্রতুল। এরপর প্রিন্ট এবং শুকানোর ঝক্কি তো আছেই। সময় এবং শ্রম বিবেচনায় তাই দামটাও একটু বেশি পড়ে যায়।
খাম বানানোর কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই খামের কারিগর অনলাইনে ক্রাফট আইটেম সেল করা বিভিন্ন পেইজকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। এছাড়াও মাঝেমাঝে নিজ জেলা পঞ্চগড়ের চেনা স্টেশনারি দোকান, কখনোবা নীলক্ষেত ঘুরেও সংগ্রহ করেন খামের আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র।
খাম নিয়ে যখন কাজ শুরু করেন মমতা, তখনও কাস্টমারদের চাহিদা সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল না। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণে কাস্টমারদের পছন্দ নিয়ে একটা মোটা দাগের ধারণা আসে। এ সময় থেকে ছোটো বাচ্চাদের পছন্দের কার্টুন নিয়ে খাম বানানো শুরু করেন।

'এভাবেই কেমন করে জানি ঈদ কার্ড, সালামি কার্ডের বুদ্ধিটা আসে,' বলেন তিনি। হলের থাকার সুবাদে ঈদ কার্ডের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। প্রতিবার ঈদে অনেক অনেক ঈদ কার্ড মমতা নামমাত্র মূল্যে দিয়ে দেন সহপাঠী, অনুজ কিংবা অগ্রজদেরকে। এভাবেই উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে, বাড়ি থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও।
মমতা গল্পচ্ছলে জানাচ্ছিলেন নিজের ব্যস্ততামাখা দিনের গল্প। পড়াশোনার পাশাপাশি খামের এই ব্যবসা চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় এ উদ্যোক্তাকে। খামের কাঁচামালের সংগ্রহ, যাতায়াত, প্রিন্ট থেকে শুরু করে হাতে কাগজ কাটা — প্রতিটা কাজ সূক্ষ্মভাবে করবার যে ধৈর্য, সেটিই সবচেয়ে বেশি শক্ত।
এর বাইরে বিভিন্ন খরিদ্দার হ্যান্ডেল করা, সময়মতো রেসপন্স করে প্রতিটা কাজ শুরু থেকে পার্সেল পাঠানো তো রয়েছেই। তবু এক ধরনের ভালো লাগা, অন্যরকম শান্তি আর শৈল্পিক সত্তা মমতাকে থামতে দেয় না।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
অনলাইনভিত্তিক পেইজ তো আছেই। মমতা স্বপ্ন দেখেন, তার প্রিয় 'এনভেলোপ'-এর একখানা ছোটোখাটো আউটলেটের। স্বপ্নের সেই আউটলেটে থাকবে বই, কফি আর যত্ন করে বানানো চিঠির খাম। চিঠিপ্রেমীরা নিজের মনের কথাগুলো লিখতে পারবেন এই আউটলেটে বসে। সেখান থেকে পেইজের বিভিন্ন প্রোডাক্ট নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী কিনবেন।

শুধু এইটুকুই নয়, বিকিকিনির বাইরে আলাপ চলবে। কথা হবে চিঠি নিয়ে। থাকবে একখানা পোস্টবক্সও।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'শেষ চিঠি' কবিতায় লিখেছেন, 'চিঠিখানি হাতে নিয়ে তেমনি পড়ল মনে অনেক কথা এক নিমেষে।' চিঠির আদলে আস্ত উপন্যাস লিখেছেন নিমাই ভট্টাচার্য, বুদ্ধদেব গুহ'র মতন লেখকেরা। হেলাল হাফিজ, মহাদেব সাহাদের কবিতায় চিঠির আকুতি ফুটে উঠেছে নানা রঙে।
তবু চিঠির সেই সময়কাল আর ফিরবে না। ইলেকট্রনিক মেইল, ম্যাসেঞ্জার, মোবাইল, ইন্টারনেট কেড়ে নিয়েছে চিঠির যৌবনকাল। চিঠি এখন বেঁচে আছে বার্ধক্যে, কিছুটা অবহেলায়।
তবু চিঠি কি একেবারে হারিয়ে যাবে? হয়তো যাবে, হয়তোবা যাবে না। কাস্টমাইজড খামের মোড়কে চিঠির এক পুনরুজ্জীবন শুরু হয়েছে। সেটাকে কতখানি বাঁচিয়ে রাখতে পারে নতুন প্রজন্ম, সেখানেই এ প্রশ্নের জবাব দেবে ভবিষ্যতে।
ছবি: সৌজন্যে