প্রথম বাংলা ক্যালকুলেটর ‘ধারাপাত’!

সবুজ জমিনের ওপর লাল বোতাম। লাল বোতামে বাংলায় লেখা ১, ২, ৩, ৪, জমা, সাফ আর থোক। প্রথম বাংলা ক্যালকুলেটর ধারাপাতের নকশা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রঙ লাল-সবুজ দিয়েই করা হয়েছে।
ক্যালকুলেটর চাপলে স্ক্রিনে দেখা যায় বাংলা সংখ্যা। বাংলার সংখ্যা দিয়ে ক্যালকুলেটর 'ধারাপাত' আর ডিজিটাল ঘড়ি 'ধারাক্রম' আবিষ্কার করেছেন ড. মাহমুদ হাসান।
এ বছরের বই মেলায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি স্টল নিয়ে বসেছিলেন তিনি। স্টলের ওপরেই লেখা 'ধারাপাত, প্রথম বাংলা ক্যালকুলেটর।' বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বইমেলায় ভিড় সাধারণত কম হয়। কিন্তু একদম শেষের দিকের এক কোণায় ড. মাহমুদের স্টলে সবসময় ভিড় লেগেই থাকতো। বিশেষ করে, শিশু-কিশোররা বাংলা ক্যালকুলেটরের প্রতি বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানান ড. মাহমুদ।
ড. মাহমুদ হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। ১৯৯৫ সালে রোবোটিক্সের ওপর পিএইচডি করতে মালয়েশিয়া যান ড. মাহমুদ। তারপর আর দেশে ফিরে আসেননি।
৩০ বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। মালয়েশিয়া, ব্রুনেই, কাজাখাস্তান, আমেরিকার অনেকগুলো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন রোবোটিক্স।

আজ থেকে প্রায় ৩৬ বছর আগে বাংলা সংখ্যাকে ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটে আনার স্বপ্ন দেখেছিলেন ড. মাহমুদ হাসান। ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ এই দুই বছর বাংলা একাডেমিতে গবেষণা করেছেন তিনি। 'বাংলা মুদ্রাক্ষরযন্ত্রের উন্নতিসাধন ও বৈদ্যুতিকরণ প্রকল্প' নামক একটি গবেষণা করেন ড. মাহমুদ হাসান। এ গবেষণায় বাংলা ফন্ট তৈরি করা, মুনীর চৌধুরীর তৈরি কি-বোর্ড লেআউটের উন্নতি সাধন, বাংলা কিবোর্ডের যুক্তাক্ষর নতুন করে সাজানোসহ আরো নানান বিষয়ে কাজ করা হয়েছিল। এছাড়া, তখন কম্পিউটারে বাংলা টাইপ করার জন্য 'BASCII' (Bangla Academy Standard Code for Information Interchange) প্রকল্প নিয়েও কাজ করেন তিনি।
এই গবেষণার অংশ হিসেবেই বাংলা সংখ্যা দিয়ে ক্যালকুলেটর তৈরি করার পরিকল্পনা করেন ড. মাহমুদ হাসান। ডিজিটাল স্ক্রিনে ইংরেজি সংখ্যা ফুটিয়ে তোলার জন্য ৭টি সেগমেন্ট বা অংশ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাংলা সংখ্যা একটু জটিল বিধায় ৭ সেগমেন্ট দিয়ে তা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হচ্ছিলনা। ফলে মাহমুদ হাসান আবিষ্কার করেন ১২ সেগমেন্টের ডিসপ্লে।
১২টি সেগমেন্ট দিয়ে বাংলা সংখ্যা ০ থেকে ৯ পর্যন্ত ফুটিয়ে তোলা যাচ্ছিল। এ ক্যালকুলেটরে আবার ইংরেজি সংখ্যাও আনা যায়। তবে এটি গোপন একটি ফিচার। যদিও ড. মাহমুদ হাসান চাচ্ছেন না এ ফিচার বেশি ব্যবহৃত হোক।
১৯৮৮ সালে এই আবিষ্কারকে বাস্তবে রূপদানের জন্য সরকারের কাছে ৫০ হাজার টাকা অনুদান চেয়েছিলেন ড. মাহমুদ। কিন্তু তৎকালীন সরকার তাকে ফিরিয়ে দেয়। ৩৬ বছর পর, ২০২৫ সালে নিজ উদ্যোগে বাংলা ক্যালকুলেটর 'ধারাপাত' তৈরি করেন তিনি। এত বছর ধরে তিনি এটি নিয়ে কাজ করে গিয়েছেন নিজের মতো। কোথায় এটি সহজে তৈরি করা যাবে, কত কম দামে তিনি এটি বাজারে আনতে পারবেন—এমন বিভিন্ন বিষয় ঠিক করতে লেগে গেছে এতটা বছর।

এছাড়াও, কারো থেকে কোনো ধরণের সহায়তা তিনি পাননি। সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে ও নিজ খরচে এটি বাজারজাত করার চেষ্টা করেছেন।
২০২৫ সালের বইমেলায় ধারাপাত ক্যালকুলেটর নিয়ে স্টল দিলেও এটি বিক্রি করছেন না ড. মাহমুদ। বিক্রি করার মতো বড় পরিসরে উৎপাদন করা হচ্ছে না এই ক্যালকুলেটর এবং ডিজিটাল ঘড়ি। মূলত সাধারণ মানুষ এ আবিষ্কারকে কীভাবে গ্রহণ করেন, সেই প্রতিক্রিয়া জানতেই স্টল নিয়ে বসেছিলেন তিনি।
ড. মাহমুদ হাসান বলেন, "আমি অনেক ভাল প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি সবার থেকে। বিশেষ করে শিশু-কিশোররা খুবই আগ্রহী বাংলা ক্যালকুলেটর নিয়ে। যে কয়জন আমার স্টলে এসেছেন, প্রায় ৯৫ ভাগই এটি কিনতে আগ্রহী হয়েছেন। বিক্রি করছি না দেখে সবাই-ই আক্ষেপ করেছেন। আমি তো বিজ্ঞানী। আমি ব্যবসার এই জিনিসগুলো ভালো বুঝি না। কারো থেকে কোনো ধরণের সহায়তাও পাইনি। যদি কেউ এগিয়ে আসেন আমার এই আবিষ্কারকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে—তাহলে মোস্ট ওয়েলকাম!"
বাংলা ভাষার সম্পূর্ণতা নিয়ে আসার জন্য এ ক্যালকুলেটর তৈরি করেছেন ড. মাহমুদ। গণনা পদ্ধতিতে বাংলা ভাষায় কোনো সীমাবদ্ধতা যেন না থাকে, এমনটাই তার চাওয়া। গণিত করার সময় বাচ্চারা ক্যালকুলেটরে ইংরেজি সংখ্যা চাপে, কিন্তু খাতায় লেখা লাগে বাংলায়। যার ফলে অনেকেই ভুল করে। ইংরেজিতে ৮ আর বাংলায় ৪ এর গোলমাল সবাই জীবনে একবার হলেও করেছে! বাংলা ক্যালকুলেটর ব্যবহার করলে এ ভুলগুলো হবে না বলে বিশ্বাস করেন ড. মাহমুদ।

বাংলা ভাষার সাথে বাংলা সংখ্যার কিছু মিল আছে। যেমন—৩ দেখতে ত এর মতো, ৬ দেখতে ড এর মতো আবার ৮ দেখতে কিছুটা ট এর মতো। বর্ণমালার সাথে সংখ্যার এ সামঞ্জস্য শিশুরা গণিত করতে এসে যখন পায় না, আবার ইংরেজিতে ক্যালকুলেটর চেপে বাংলায় লেখা লাগে আবার—তখনই গণিত ভীতি শুরু হয়। বাচ্চাদের গণিত ভীতি দূর করতেও সাহায্য করবে এ ক্যালকুলেটর।
ড. মাহমুদের মতে, আগে মাতৃভাষার ভীত শক্ত হলে পরবর্তীতে যেকোনো ভাষায় কাজ করতে আর কোনো ভীতি কাজ করবে না। হোক সে ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষা।
ড. মাহমুদ বলেন, "আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রথম ক্লাস থেকেই শিশুদের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ভাষা হিসেবে ইংরেজি দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এমন কোনো স্ট্যান্ডার্ড নেই। বাচ্চারা শুরু করে বাংলা দিয়ে, বিজ্ঞান পড়তে এসে দেখে সব ইংরেজি; যার কারণে দেশে বিজ্ঞান আর গণিতের প্রতি ভীতি বাড়ছে। আমি চাই একটা বিজ্ঞানমনস্ক বাঙালি জাতি গড়ে উঠুক।"
বাংলা ক্যালকুলেটর মূলত কাদের জন্য বানানো হয়েছে? এ প্রশ্ন করলে ড. মাহমুদ বলেন, "আমি চাই এটা সকল বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ব্যবহার করুক। তবে সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এটি বেশি কাজে আসবে। এছাড়া, আমি চাই গ্রামে-গঞ্জে, হাট-বাজারে এটি ছড়িয়ে দিতে।"
তিনি বলেন, "গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত কৃষক ও ফার্ম মালিকরা চাষাবাসের নানান হিসাব-নিকাশ করতে এ ক্যালকুলেটর সহজে ব্যবহার করতে পারবেন। ইংরেজি সংখ্যা ভালোমতো না জানলেও, বাংলা সংখ্যায় তারা সহজেই হিসাব করতে পারবেন। আমার পরিকল্পনা আছে, ধারাপাতের একটি ফার্মার ফ্রেন্ডলি মডেল তৈরি করার, যেখানে ফার্ম-ফিড ইত্যাদির হিসাব করার জন্য উপরের দিকে আলাদা প্যানেল থাকবে।"
ধারাপাত বাজারজাত করা হলে এর দাম মাত্র ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কম দামে যেন বেশি মানুষের কাছে এ বাংলা ক্যালকুলেটর পৌঁছে দেওয়া যায়, এরজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন ড. মাহমুদ।
বাংলা ক্যালকুলেটর তৈরি করতে ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা খরচ হয় বলে জানান তিনি। এবং এটি নিয়ে কোনো লাভজনক ব্যবসার পরিকল্পনা নেই বলে উল্লেখ করেন ড. মাহমুদ।

এ ক্যালকুলেটরের বাইরের অংশ শুধু দেশে তৈরি করতে চান তিনি। ভেতরের এমপিইউ (ম্যাথমেটিক্যাল প্রসেসিং ইউনিট), ডিসপ্লেসহ বাকি সবকিছুই চায়না থেকে আমদানি করতে হয়। অন্যান্য ব্র্যান্ডের ক্যালকুলেটর, যেমন—ক্যাসিও ক্যালকুলেটরের এমপিইউ আর ধারাপাতের এমপিইউ একই। যার ফলে কোনো ধরনের গাণিতিক ত্রুটি হয় না ধারাপাতে।
ডিসপ্লেতে ৭ সেগমেন্টের বদলে ১২ সেগমেন্ট ব্যবহার করে বাংলা সংখ্যা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই ক্যালকুলেটর চালাতে ২টি ট্রিপল এ ব্যাটারি লাগে। এ দিয়েই ৪ বছর চলবে ধারাপাত।
অন্য সব ক্যালকুলেটরে সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হয় চার্জ করার জন্য। কিন্তু ধারাপাতে সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হয়নি। সোলার প্যানেল ব্যবহার করলে এর দাম প্রায় ৬০ টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে। দাম যেন বাড়ানো না লাগে, তাই সোলার প্যানেল লাগানো হয়নি।
ড. মাহমুদ হাসান তার এ আবিষ্কার ওপেন সোর্স হিসেবে রাখতে চান। কোনো ধরনের পেটেন্ট করে ১২ সেগমেন্টে বাংলা সংখ্যা লেখার আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিতে চান না তিনি। এ আবিষ্কার ব্যবহার করে যেকেউ বাংলা সংখ্যা ডিজিটালাইজ করে যেকোনো যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারবেন। মানুষের যেন উপকার হয়, এমনটাই ড. মাহমুদ হাসানের চাওয়া।
ছবি: ফাইয়াজ আহনাফ সামিন/টিবিএস