ধানখেত থেকে বহুতল ভবন: উত্তরখান যেভাবে শহরের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিপরীত দিকে অবস্থিত একটি এলাকা হলো উত্তরখান। বিমানবন্দর ও এর আশেপাশের এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম চললেও উত্তরখান, দক্ষিণখান, আশকোনা ও কাওলা নামে এলাকাগুলো ছিল এসব উন্নয়নের নীরব দর্শক।
তবে বর্তমানে উত্তরখানে অবশেষে উন্নয়নের হাওয়া লেগেছে। ২০১৭ সালের ২৬ জুলাই প্রকাশিত একটি গ্যাজেটের মাধ্যমে এলাকাটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর থেকে এলাকাটির চেহারা বদলাতে শুরু করেছে। কোথাও কোথাও বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। তবে এখনো সেখানকার অনেক অংশের গ্রামীণ চিত্র এখনও দৃশ্যমান রয়েছে।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি আমরা উত্তরখানের সামাজিক, অবকাঠামোগত ও মানব উন্নয়নের চিত্র স্বচক্ষে দেখার জন্য সেই এলাকা পরিদর্শনের যাই।
আমরা আবদুল্লাহপুর ঢাল থেকে একটি অটোরিকশায় উঠি। উত্তরখানের মাস্টারপাড়া অতিক্রম করে পৌঁছাই চাঁনপাড়া বাজারে। সেখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন আমাদের বন্ধু ও সেদিনের স্থানীয় গাইড নূর ইজাজ। তিনি চাঁনপাড়ায় একটি বেকারি কারখানার উপ-মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
দক্ষিণখানের সড়কের বেহাল দশার কথা আমরা ভালোভাবেই জানতাম। তাই এর পাশের এলাকা উত্তরখানের রাস্তার অবস্থাও বেশ খারাপ হবে বলে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। তবে এখানে এসে দেখি, রাস্তার অবস্থা তুলনামূলকভাবে অনেকটাই ভালো।
আমরা চাঁনপাড়ার দীর্ঘদিনের বাসিন্দা মাসুমা রহমানের সঙ্গে কথা বলি। তিনি এখানে কয়েক দশক ধরে বসবাস করছেন এবং চোখের সামনে প্রতিটি ভবনের নির্মাণ দেখেছেন।
মাসুমা রহমান বলেন, "এটা ছিল এই শতকের শুরুর দিকের কথা। আমি যে চারতলা ভবনে থাকি, সেটা উত্তরখানের প্রথম দিকের উঁচু ভবনগুলোর একটি ছিল। তখন এটি আশেপাশের পরিবেশের তুলনায় একেবারেই আলাদা লাগতো।"
তিনি আরও বলেন, "এ এলাকায় চোর-ডাকাতের উপদ্রব ছিল। তবে এখন পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে।"

আরেক প্রবীণ বাসিন্দা আবদুর রব প্রায় ৫০ বছর ধরে এখানে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, "তখন চারপাশে শুধু ধানখেত ছিল। পুরো এলাকা একেবারে গ্রামের মতো দেখাতো। আর এটা খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ২০০৮ সাল পর্যন্তও এখানে ধানখেত ছিল!"
তিনি আরও বলেন, "আমি চাঁদপুর থেকে এখানে এসে বসত গড়েছি। তখন জমির দাম ছিল মাত্র ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা প্রতি কাঠা। আশপাশে কিছুই ছিল না। বাজার-সদাইয়ের জন্য আমাদের টঙ্গী পর্যন্ত যেতে হতো। কিন্তু এখন সবকিছু হাতের নাগালে পাওয়া যায়।"
স্থানীয় বাসিন্দা ফারুক আহমেদ সোরভ পেশায় একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তিনি জানান, "বর্তমানে এখানে জমির দাম প্রতি কাঠা ২৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকার মধ্যে, আর প্রধান সড়কের পাশের জমির দাম ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে।"
উত্তরখানের সর্বত্রই আমরা নির্মাণাধীন বহুতল ভবন দেখতে পেলাম। দেখলেই বুঝা যায়, এ নির্মাণ কার্যক্রম সম্প্রতিই শুরু হয়েছে। বিমানবন্দরের নিকটবর্তী হওয়ায় এ এলাকার জমির চাহিদা বেড়েছে। তাছাড়া ফারুক আহমেদের মতে, পার্শ্ববর্তী পূর্বাচলের ৩০০ ফিট এলাকার উন্নয়নও এর ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।
বিভিন্ন ইউনিয়নকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে উত্তরখানকে ৪৪, ৪৫ ও ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে নগরীর প্রশাসনিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হলেও দুর্নীতির অভিযোগ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের কারণে এখানকার পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি।
ফারুকও এই পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তিনি উত্তরখানের সিটি ওয়ার্ডে রূপান্তরের শুরুর দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করেন, যখন পুরো এলাকা অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও অনুন্নত সড়কে ভরা ছিল। তিনি সোজাসাপ্টা বললেন, "স্থানীয় রাজনীতিবিদরা তেমন কিছুই করেননি, তারা প্রকৃত উন্নয়নের জন্য বাজেট ব্যয়ের চেয়ে নিজেদের পকেট ভরতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন।"
তার এই দাবি ভিত্তিহীন নয়। অন্যান্য বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেও একই উত্তরই পাওয়া গেছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অবহেলা উত্তরখানের উন্নয়নের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই এলাকার (চানপাড়া-ওয়ার্ড ৪৬) সর্বশেষ কাউন্সিলর মো. জায়েদুল ইসলাম মোল্লার সময়কালে অবকাঠামোর অবস্থা বেশ করুণ ছিল। সড়কগুলো ছিল অবহেলিত ও জরাজীর্ণ, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব ছিল প্রকট, আর নগর পরিকল্পনার কোনো ছাপই দেখা যেত না।
কাউন্সিলর ও রাজনীতিবিদরা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাসিন্দাদের মতে, বাস্তবে অগ্রগতি ছিল প্রায় শূন্যের কোটায়। তবে এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে।
ফারুক বলেন, "যখন সেনাবাহিনী এল, তখন সবকিছু বদলে গেল। এখন যে রাস্তাগুলো দেখছেন, সেগুলো সেনাবাহিনী করেছে, রাজনীতিবিদরা নয়।"
এই পরিবর্তনের পেছনে মূল কারণ ছিল সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা। পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়ক প্রকল্পে সরঞ্জাম পরিবহনের সুবিধার্থে তাদের সুপরিকল্পিত অবকাঠামো দরকার ছিল। ঢাকা ও তার পূর্বাঞ্চলীয় সম্প্রসারণকে সংযুক্ত করতেই এই গুরুত্বপূর্ণ সড়কের উন্নয়নের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনী সঠিকভাবে রাস্তা নির্মাণের দায়িত্ব নেয়। যার ফলে এলাকাটির যোগাযোগ ব্যবস্থা নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।
সেনাবাহিনীর এই উদ্যোগ না নিলে হয়ত পাঁচ-ছয় বছর বা তারও বেশি সময় এই ভাঙাচোরা রাস্তা নিয়ে থাকতে বাধ্য হতেন বলে জানান ফারুক।

তবে শুধু সড়ক উন্নয়নই প্রকৃত অগ্রগতির প্রতীক নয়। ফারুক আমাদের জানান, যদি অবকাঠামোর পরিবর্তে মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে যে এখানকার মানুষ এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এলাকার স্কুলের সংখ্যাও হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র।
যদিও ডেভেলপাররা সম্প্রতি এখানে জড়ো হয়ে আকাশছোঁয়া ভবন ও আবাসন প্রকল্পের পরিকল্পনা করছে, তবু মৌলিক সেবাগুলো এখনো এখানে অপ্রতুল। পানি নিষ্কাশনের সমস্যা রয়ে গেছে, গণপরিবহন যথেষ্ট নয় এবং স্থানীয় প্রশাসনের অদক্ষতার অভিযোগও রয়েছে।
ইজাজ বলেন, "এলাকাটি সিটি করপোরেশনের আওতায় আসার পর গত সাত বছরে সড়কগুলো তৈরি করা হয়েছে। এর আগে অবস্থা ছিল বেশ ভয়াবহ। এখন তেমন সমস্যা নেই, তবে বর্ষার সময় নিম্নমানের ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে কয়েকটি জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।"
তিনি আরও জানান যে, ঢাকা শহরের মধ্যে এটি সবচেয়ে সাশ্রয়ী জায়গা হওয়ায় তিনি এখানে তার কারখানা স্থাপন করেছেন। এছাড়া, সড়কগুলোর উন্নতি হয়েছে এবং গ্যাস সরবরাহও রয়েছে।
আমরা চাঁনপাড়া থেকে তেরমুখ ব্রিজ পর্যন্ত সিএনজি নিয়েছিলাম, যা আব্দুল্লাহপুর থেকে প্রায় ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে। যতই ভেতরের দিকে যাচ্ছিলাম, ততই জায়গাটি শহরের চেয়ে একটি উপজেলার মতো মনে হচ্ছিল। ব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ আরও গ্রাম্য হয়ে ওঠে।
নতুন নির্মিত তেরমুখ ব্রিজটি তুরাগ নদীর উপর তৈরি হয়েছে। এখানে আগে ফেরি পারাপারের জায়গা ছিল। ব্রিজের এক পাশে গাজীপুর, আর অন্য পাশে ৩০০ ফিট সড়ক। ঢাকার সীমান্তবর্তী এই শান্ত এলাকায় এখনও গ্রাম্য আবহ টিকে আছে।
আমরা সেখানে টিনের ঘর, এমনকি কাঁচা মাটির বাড়িও দেখেছি। পাশাপাশি লাউয়ের মাচা ও ফসলের খেত, সব মিলিয়ে একদম গ্রামীণ পরিবেশও রয়েছে এখানে।
ব্রিজে ঘুরতে আসা অনেকেই কাছের গ্রামগুলো থেকে তাজা শাকসবজি ও গরুর দুধ কিনে নিয়ে যান। ব্রিজের প্রবেশমুখে বেশ কয়েকজন বিক্রেতা সবজি, মাছ ও দুধ বিক্রি করতে জড়ো হন।