পাল্মে দ'র জয়ের পর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন ইরানি নির্মাতা জাফর পানাহি

কান চলচ্চিত্র উৎসবের পাল্মে দ'র পুরস্কার পেলেন ইরানি পরিচালক জাফর পানাহি। পানাহি 'ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট' চলচ্চিত্রের জন্য মর্যাদাপূর্ণ এ পুরস্কার জিতেছেন। বিবিসি কালচারে চলচ্চিত্রটিকে 'একটি ক্ষুব্ধ অথচ মজার প্রতিশোধমূলক থ্রিলার, যা দমনমূলক শাসনের প্রতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে' বলে বর্ণনা করা হয়েছে। খবর বিবিসির।
ইরানি পরিচালক জাফর পানাহি বহুবার নিজ দেশেই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন কারণে তিনি নিজ দেশে কারাবরণও করেছেন। কান চলচ্চিত্র উৎসবে শীর্ষ পুরস্কার জয়ের পর দেশের শাসনব্যবস্থার ওপর কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি।
পুরস্কার গ্রহণের সময় পানাহিকে স্বাগত জানানো হয়। তখন তিনি তার ইরানি সহকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, নিজেদের মধ্যে মতভেদ ও সমস্যাগুলো পাশ কাটিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখন আমাদের দেশ এবং আমাদের দেশের স্বাধীনতা। আসুন আমরা এক হই। কেউ আমাদেরকে বলার সাহস না দেখাক যে, আমাদের কী ধরনের পোশাক পরা উচিত, কী করা উচিত কিংবা কী করা উচিত নয়।'
পানাহি সর্বশেষ কারাবাস থেকে মুক্তি পান ২০২৩ সালে। দুই সহকর্মী চলচ্চিত্র নির্মাতার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করায় তাকে কারাবরণ করতে হয়। নিজ দেশের প্রশাসনের সমালোচনা করায় ওই দুই নির্মাতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
১৫ বছর পর কানে যোগ দিয়ে কোনো আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশ নিলেন পানাহি। এর আগে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি কোনো আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশ নিতে পারেননি।
'ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট' চলচ্চিত্রটির দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে অত্যন্ত গোপনে এবং এটি কিছুটা পানাহির কারাগারের নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকেই নির্মিত হয়েছে।
হলিউড রিপোর্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাফর পানাহি বলেন, 'জেলে যাওয়ার আগে এবং সেখানে যেসব মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, তাদের গল্প ও পটভূমি জানার আগে— আমার ছবিতে যেসব বিষয় উঠে আসত, সেগুলো ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।'
তিনি আরও বলেন, 'আসলে এই প্রেক্ষাপটেই (...) আমি এক নতুন দায়বদ্ধতা অনুভব করেছিলাম। সেটিই আমাকে এই গল্পের ধারণা ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে।'
চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়েছে পাঁচজন সাধারণ ইরানির গল্প, যারা এমন একজন ব্যক্তির মুখোমুখি হয়, যাকে তারা মনে করে কারাগারে তাদের নির্যাতন করেছে।
পরিচালক জাফর পানাহি জানান, এই চরিত্রগুলো তিনি গড়ে তুলেছেন কারাগারে অন্য বন্দিদের সঙ্গে তার কথোপকথনের ভিত্তিতে। তিনি বলেন, 'তারা আমাকে যে গল্পগুলো বলেছিল— ইরানি সরকারের সহিংসতা ও নির্মমতা নিয়ে— সেগুলো থেকেই এই চরিত্রগুলোর অনুপ্রেরণা পেয়েছি।'
জাফর পানাহি ছয় বছরের সাজা থেকে সাত মাস কারাভোগ করার পর ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পান।
এর আগে ২০১০ সালে তাকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল সরকারবিরোধী বিক্ষোভে সমর্থন এবং 'ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রচার' চালানোর অভিযোগে। সে সময় তিনি দুই মাস কারাগারে থাকার পর শর্তসাপেক্ষ জামিনে মুক্তি পান, কিন্তু তার ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ ও বিদেশ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
সাজা হওয়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও কান চলচ্চিত্র উৎসবের পর তেহরানে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জাফর পানাহি।
কানে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, 'এখানে আমার কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ইরানে ফিরে যাব। আর আমি নিজেকে প্রশ্ন করব, আমার পরবর্তী চলচ্চিত্রটি কী হতে পারে?'
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা 'ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট' ছবিটিকে জাফর পানাহির "সবচেয়ে আবেগঘন চলচ্চিত্র" বলে আখ্যা দিয়েছে। এটি এমন এক সিনেমা যা রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও প্রতিশোধ, এবং নিত্যদিনের স্বাভাবিক জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্বৈরতন্ত্রের যন্ত্রণা তুলে ধরেছে।
সমালোচক পিটার ব্র্যাডশ` বলেন, 'এটি বিশ্ব সিনেমার অন্যতম অনন্য ও সাহসী ব্যক্তিত্বের আরেকটি দারুণভাবে নির্মিত গম্ভীর কিন্তু হাস্যরসে ভরপুর ছবি।'
ভ্যারাইটি লিখেছে, পানাহি এখন আর শুধু নীচু স্বরের মানবতাবাদী নন, বরং খোলামেলাভাবে ইরানি সরকারের সমালোচক, আর সেটি তার নতুন রাজনৈতিক থ্রিলারে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে।
পানাহির হাতে পাল্মে দ'র পুরস্কার তুলে দেন ফরাসি অভিনেত্রী ও এ বছরের কানের জুরি প্রেসিডেন্ট জুলিয়েট বিনোশ এবং অস্ট্রেলিয়ান অভিনেত্রী কেট ব্ল্যানচেট।
অস্কারেও কি একই পথ অনুসরণ করবে?
কান উৎসবে 'ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট' ছবির পাল্মে দ'র জয়ের পর এমন প্রশ্ন উঠছে।
পুরস্কার ঘোষণার সময় জুলিয়েট বিনোশ বলেন, চলচ্চিত্র ও শিল্প হলো উসকানিদাতা, যা অন্ধকারকে রূপান্তরিত করতে পারে ক্ষমা, আশা ও নতুন জীবনে। তিনি বলেন, 'এই কারণেই আমরা পাল্মে দ'র বিজয়ী হিসেবে জাফর পানাহির 'ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট' ছবিকে বেছে নিয়েছি।'
কেট ব্ল্যানচেট তার বক্তব্যে বলেন, 'আমি কান কর্তৃপক্ষের এই উপলব্ধিকে সাধুবাদ জানাই যে, চলচ্চিত্র বৃহত্তর সামাজিক সংলাপের সুযোগ তৈরি করতে পারে।'
উৎসবের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়েই অনুষ্ঠিত হয়, যদিও আগে পাঁচ ঘণ্টার বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে। স্থানীয় কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, এটি বিদ্যুৎ সাবস্টেশন ও টাওয়ারে সম্ভাব্য হামলার কারণে হয়েছে।
৬৪ বছর বয়সী জাফর পানাহি এখন কান, বার্লিন ও ভেনিস— বিশ্বের তিনটি শীর্ষ চলচ্চিত্র উৎসবেই শীর্ষ পুরস্কার জেতার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। ফলে এখন তার হলিউডে স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনাও জোরালো হয়েছে।
গত পাঁচ বছরে চারটি পাল্মে দ'র বিজয়ী চলচ্চিত্রই অস্কারের সেরা চলচ্চিত্র বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছে।
তবে ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট ছবিটির অস্কারে সেরা আন্তর্জাতিক ফিচার বিভাগে মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, এই বিভাগে যোগ্য হতে হলে চলচ্চিত্রটি নিজ দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে হবে — অথচ পানাহির চলচ্চিত্র ইরানে নিষিদ্ধ।