মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিধন্য কাপ্তাইয়ের ‘সবুজ সংঘ’: গৌরবের ইতিহাস আজ ধ্বংসস্তূপে
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনার 'সবুজ সংঘ ক্লাব'। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রায় দেড় মাস আগে থেকেই এই ক্লাবটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক তৎপরতা; অঙ্কুরিত হয়েছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের বীজ। অথচ অযত্ন আর অবহেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সেই আঁতুড়ঘরটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কালজয়ী ইতিহাসের সাক্ষী এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে জরাজীর্ণ, ধুঁকছে সংস্কারের আশায়।
গৌরবোজ্জ্বল অতীত ও প্রতিরোধের দুর্গ
সবুজ সংঘ ক্লাবের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধে এর ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ক্লাবটির এডহক কমিটির আহ্বায়ক মো. শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী। তিনি জানান, ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবটি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ছিল না, বরং এটি ছিল সার্বজনীন। পাকিস্তান আমলেও ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে পোস্টার-ব্যানার তৈরি ও 'চিকা মারা'র মতো কাজগুলো পরিচালিত হতো এই ক্লাবের চার দেয়ালের ভেতর থেকেই।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে শাহাদাৎ হোসেন জানান, তাদের বড় ভাই, প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মো. শাহ আলম চৌধুরী (বীর উত্তম)-এর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই এখানে যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়। তৎকালীন চন্দ্রঘোনার বাসিন্দা বীর প্রতীক একেএম ইসহাক ও মো. আজিমসহ বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সদস্য এখান থেকেই যুদ্ধের প্রাথমিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।
বর্তমান জরাজীর্ণ দশা
৫৮ বছরের পুরনো এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটির বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত করুণ। দীর্ঘকাল সংস্কারের অভাবে বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে ক্লাবঘরটি। দরজা-জানালা ভেঙে গেছে, ওপরের টিনের চাল খসে পড়ছে। এক সময়ের কোলাহলমুখর প্রাঙ্গণটি এখন অনেকটা পরিত্যক্ত ও ব্যবহারের অনুপযোগী।
ক্লাবের সদস্য সচিব ইব্রাহিম হাবিব মিলু টিবিএসকে বলেন, '২০০০ সালের পর থেকেই ক্লাবের ভৌত অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ২০০৩ সালে জেলা প্রশাসন একবার সংস্কার কাজ করেছিল। বছরখানেক আগে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ক্লাবটি পরিদর্শন করে সংস্কারের আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি বদলি হয়ে যাওয়ায় সেই উদ্যোগ আর আলোর মুখ দেখেনি। অথচ এক সময় এলাকার সব সামাজিক কার্যক্রম এখান থেকেই পরিচালিত হতো। আমরা প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাই, দ্রুত যেন এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংস্কার করা হয়।'
সাহসী অভিযানের স্মৃতিচারণ
মুক্তিযুদ্ধে সবুজ সংঘ ক্লাবের সদস্যদের বীরত্বগাথা তুলে ধরেন শাহাদাৎ হোসেন। তিনি জানান, তিনি নিজে এবং সহযোদ্ধা রমজান আলী, মো. বাদশা, সিরাজ ইসলাম বাঙালিসহ আরও কয়েকজন সংগঠিত হয়ে অপারেশন পরিচালনা করতেন।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি একটি দুঃসাহসিক অভিযানের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, 'স্বাধীনতা সংগ্রাম পুরোদমে শুরু হওয়ার আগেই আমরা চন্দ্রঘোনার কেপিএম এলাকার ১৪ নম্বর বাংলোয় অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড; একটি বিশাল ওয়্যারলেস টাওয়ারে অভিযান চালাই। সেখানে দায়িত্বরত দুই প্রহরীকে কৌশলে অজ্ঞান করে টাওয়ারের মেশিনটি জব্দ করে নিয়ে আসি। এতে ওই অঞ্চলে পাকিস্তানিদের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে।' ক্লাবের অন্তত আট-দশ জন সদস্য সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বলেও তিনি গর্বভরে উল্লেখ করেন।
স্বাধীনতার পর মিলনমেলা ও রাষ্ট্রপতির আগমন
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও সবুজ সংঘ ক্লাব ছিল অত্র এলাকার মানুষের প্রাণের মিলনকেন্দ্র। শাহাদাৎ হোসেন স্মৃতি হাতড়ে বলেন, 'স্বাধীনতার পর সরকার থেকে এখানে একটি সাদাকালো টেলিভিশন দেওয়া হয়েছিল। ফুটবল বিশ্বকাপ দেখার জন্য তখন শত শত মানুষ এখানে ভিড় জমাতো।'
এই ক্লাবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এতটাই ছিল যে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কর্ণফুলী পেপার মিল পরিদর্শনে এসে এই ক্লাবেও পা রাখেন এবং পরিদর্শন খাতায় স্বাক্ষর করেন। পরবর্তীতে বহু মন্ত্রী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই ক্লাব পরিদর্শন করেছেন।
প্রশাসনের বক্তব্য
ক্লাবটির হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে ২০২৪ সালের আগস্ট-পরবর্তী সময়ে উপজেলা ও জেলা প্রশাসন বরাবর সংস্কারের আবেদন জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে কাপ্তাই উপজেলার বর্তমান নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. রুহুল আমিন টিবিএসকে বলেন, 'আমি চলতি বছরেই এখানে যোগদান করেছি। এই ক্লাবের জরাজীর্ণ অবস্থার বিষয়ে আমাকে আগে জানানো হয়নি। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কারণেই আজ আমরা স্বাধীন দেশে বসবাস করছি, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছি। তাদের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই ক্লাবটি সংরক্ষণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যা যা করণীয়, আমরা তা করব।'
স্থানীয়রা এবং নতুন প্রজন্মের দাবি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে অবিলম্বে সবুজ সংঘ ক্লাবের সংস্কার করা হোক, যাতে আগামী প্রজন্ম জানতে পারে এই অঞ্চলের বীরত্বগাথা।
