প্রিয় হাদি, তুমি হারিয়ে যাবে না, তুমি থাকবে বাংলাদেশের হৃদয়ে: প্রধান উপদেষ্টা
যতদিন বাংলাদেশ আছে, ততদিন শরিফ ওসমান হাদি সকল বাংলাদেশির 'বুকের মধ্যে থাকবেন' বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
শনিবার (২০ ডিসেম্বর) ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির জানাজায় অংশ নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন।
শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় হাদির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। লাখো মানুষের উপস্থিতিতে বড়ভাই আবু বকর সিদ্দিক হাদির জানাজা পড়ান।
জানাজার বক্তব্য দিতে গিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, 'লাখ লাখ লোক আজকে এখানে হাজির হয়েছে। পথে ঢেউয়ের মতো লোক আসছে। সারা বাংলাদেশজুড়ে কোটি কোটি মানুষ আজকে এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছে। তারা তাকিয়ে আছে হাদির কথা শোনার জন্য আজকে। বিদেশে যারা আছে, বাংলাদেশি এই মুহূর্তে তারাও হাদির কথা জানতে চায়। প্রিয় ওসমান হাদি, তোমাকে আমরা বিদায় দিতে আসি নাই এখানে। তুমি আমাদের বুকের ভেতরে আছো এবং চিরদিন, বাংলাদেশ যতদিন আছে, তুমি সকল বাংলাদেশির বুকের মধ্যে থাকবে। এটা কেউ সরাতে পারবে না।'
তিনি বলেন, 'আমরা আজকে তোমাকে বিদায় দিতে আসিনি। আমরা তোমার কাছে ওয়াদা করতে এসেছি। তুমি যা বলে গেছ, সেটা যেন আমরা পূরণ করতে পারি। সেই ওয়াদা করার জন্য আমরা একত্র হয়েছি। সেই ওয়াদা শুধু আমরা নয়, পুরুষানুক্রমে বাংলাদেশের সব মানুষ পূরণ করবে। সেই ওয়াদা করার জন্যই আমরা তোমার কাছে আজকে এসেছি। সবাই মিলে, যে যেখানেই আছি, আমরা তোমার যে মানব প্রেম, তোমার যে ভঙ্গি মানুষের সঙ্গে ওঠাবসার, তোমার যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সবাই প্রশংসা করছে, সেটা আমরা মনে প্রাণে গ্রহণ করছি। সেটা যেন আমাদের মনে সবসময় জাগ্রত থাকে, আমরা সেটা অনুসরণ করতে পারি।'
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'তুমি আমাদের এমন এক মন্ত্র কানে দিয়ে গেছো, সেই মন্ত্র বাংলাদেশের কেউ কোনোদিন ভুলতে পারবে না। এই মন্ত্র চিরদিন আমাদের কানের পাশে থাকবে। সে মন্ত্র বাংলাদেশের বড় মন্ত্র হয়ে আমাদের জাতির সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। তোমার মন্ত্র ছিল—বীর উন্নত মমশির। এই উন্নত মমশিরের যে মন্ত্র তুমি দিয়ে গেছ, সেটা বাংলাদেশি সন্তানের জন্মলগ্ন থেকে যতদিন সে বেঁচে থাকবে, নিজের কাছে বলবে। আমাদের শির কখনো নত হবে না। সেই মন্ত্র তুমি আমাদেরকে দিয়ে গেছ। আমাদের সব কাজে সেটা আমরা প্রমাণ করব। আমরা দুনিয়ার সামনে মাথা উঁচু করে চলব। কারো কাছে মাথা নত করব না।'
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান বলেন, 'প্রিয় হাদি, তুমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলে। সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে নির্বাচন কীভাবে করতে হয়, তারও একটা প্রক্রিয়া জানিয়ে গেছো আমাদের। সেই প্রক্রিয়া যেন আমরা সবাই মিলে গ্রহণ করি, যে কিভাবে প্রচার-প্রচারণা কার্য চালাতে হয়, কীভাবে মানুষের কাছে যেতে হয়, কীভাবে মানুষকে কষ্ট না দিয়ে তার বক্তব্য প্রকাশ করতে হয়, কীভাবে বিনীতভাবে মানুষের কাছে আসতে হয়, সবকিছু তুমি শিক্ষা দিয়ে গেছ। আমরা এই শিক্ষা গ্রহণ করলাম। আমরা এই শিক্ষা চালু করতে চাই। আমরা সবাই আমাদের জীবনে, আমাদের রাজনীতিকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসতে চাই, যাতে হাদি আমাদের জীবনে স্পষ্টভাবে জাগ্রত থাকে।
তিনি আরও বলেন, 'হাদি, তুমি হারিয়ে যাবে না। কোনোদিন কেউ তোমাকে ভুলতে পারবে না। তুমি যুগ যুগ ধরে আমাদের সঙ্গে থাকবে। আমাদের তোমার মন্ত্র পুনঃ পুনঃ মনে করিয়ে দেবে। আমরা সেই মন্ত্র নিয়ে আজকে সামনের পথে এগিয়ে যাব। আমাদের সবার পক্ষ থেকে তোমার সঙ্গে ওয়াদা করলাম। আজকে তোমাকে আল্লাহর হাতে আমানত রেখে গেলাম। আমরা সবসময় তোমার কথা স্মরণ রেখে জাতির অগ্রগতির পথে চলতে থাকব।'
এর আগে, হাদির জানাজায় অংশ নিতে সকাল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে লোকজন জড়ো হতে শুরু করে। ছোটবড় মিছিল নিয়ে শত শত মানুষ সংসদ ভবন এলাকায় ছুটে আসেন।
এ সময় তারা 'হাদি মরল কেন', 'ইউনূস সরকার বিচার চাই', 'আমার ভাই, আমার ভাই-হাদি ভাই, হাদি ভাই', 'নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর', 'হাদি ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই', 'বিচার চাই' ইত্যাদি স্লোগান দেন।
গত ১২ ডিসেম্বর দুপুর সোয়া ২টার দিকে রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংকির সামনে রিকশায় করে যাওয়ার সময় ওসমান হাদির ওপর আক্রমণ হয়। ওই সময় মোটরসাইকেলে করে এসে দুজন তাকে কাছ থেকে গুলি করে পালিয়ে যায়।
পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে পরিবারের ইচ্ছায় তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এরপর সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) তার চিকিৎসা চলে।
পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে হাদিকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) তার মৃত্যু হয়।
