জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশের সামনে এখন তিনটি মৌলিক প্রশ্ন দাঁড়িয়ে আছে: ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের সামনে এখন তিনটি মৌলিক প্রশ্ন দাঁড়িয়ে আছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এছাড়া স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশকে এখনো কার্যকর গণতান্ত্রিক কাঠামোর ন্যূনতম ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে, যা দুঃখজনক বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
রোববার (৭ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অভ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-এর (বিআইডিএস) বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্যেও এ আয়োজনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখাকে সময়োপযোগী বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সামনে তিনটি মৌলিক প্রশ্ন দাঁড়িয়ে আছে—কার্যকর ও প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ; সেই ব্যবস্থার ভেতর টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং উন্নয়নের গুণগত মান—অর্থাৎ ন্যায়সংগত, সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণে এর ভূমিকা কার্যকর করা।'
তিনি বলেন, 'বিস্তৃত জাতীয় আলোচনাগুলো এখনো মূলত প্রথম প্রশ্ন—গণতান্ত্রিক কাঠামোর ন্যূনতম কার্যকারিতা—নিয়েই সীমাবদ্ধ। স্বাধীনতার অর্ধশতক পরও এটাই অগ্রাধিকার হওয়া দুঃখজনক।' তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, 'নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন' দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে সামনে নিয়ে আসবে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, কেবল কাগজে-কলমে সঠিক প্রতিষ্ঠান—যেমন নির্বাচিত সংসদ, জবাবদিহিমূলক সরকার, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা বা দুর্নীতি দমন কমিশন থাকলেই গণতন্ত্র সফল হয় না। এর জন্য রাজনৈতিক আচরণ ও সংস্কৃতির দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন জরুরি। এ প্রসঙ্গে তিনি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কার প্রক্রিয়ার উদাহরণ টেনে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টার মাধ্যমেই একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাকে পরিণত গণতান্ত্রিক কাঠামোয় রূপ দেওয়া সম্ভব।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও যুব সমাজ নিয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'দুর্বল শিক্ষা ব্যবস্থা, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার উচ্চ হার, যুব বেকারত্ব ও তরুণদের ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া—সবই পরস্পর-সম্পর্কিত সংকট। তাই শুধু রাজনৈতিক সংস্কার নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতেও সমান্তরাল পরিবর্তন জরুরিন।'
উন্নয়ন ও দুর্নীতির সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, 'গণতন্ত্র থাকলেই উন্নয়ন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আসে না। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন, তবে এর ফল নির্ভর করে বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিক ও ব্যবসায়ী সংস্কৃতির ওপর। আচরণগত পরিবর্তন ছাড়া নতুন নীতিমালা অনেক সময় উল্টো রেন্ট-সিকিংয়ের সুযোগ তৈরি করে।'
তিনি ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকের বিশ্বব্যাংকের কাঠামোগত সংস্কারের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বলেন, একই ধরনের সংস্কার ভিন্ন দেশে ভিন্ন ফল দিয়েছে, মূল পার্থক্য ছিল প্রশাসনিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতায়।
অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর ঘুষদাতাকে অপরাধমুক্ত রাখার প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে ঘুষদাতা অপরাধী না হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছে না—কারণ বহু ক্ষেত্রে ঘুষ দেওয়া-নেওয়ায় দুই পক্ষেরই স্বার্থ জড়িত থাকে। ফলে অভিযোগ আসে না, ব্যবস্থাও কার্যকর হয় না।
