দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি ও খাদ্য বৈচিত্র্যের ঘাটতিতে শিশুপুষ্টির সংকট বাড়ছে: জরিপ
পাঁচ বছর বয়সী সুমাইয়ার এখন তার সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ এর বদলে সে ঢাকার হাতিরঝিলের বেগুনবাড়ি বস্তির একটি ছোট ঘরে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকে এবং সাধারণ শিশুদের তুলনায় অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে।
তার বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা আর জরাজীর্ণ শরীর সেই গল্পই বলে, যা তার পরিবার আড়াল করতে চায়: বছরের পর বছর ধরে চলা অপুষ্টি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে প্রতিদিনের সংগ্রাম। তার পরিবার এখনো তাকে স্কুলে পাঠানোর কথা ভাবার সাহসটুকুও করে উঠতে পারেনি।
সুমাইয়ার মা, গৃহকর্মী রোকেয়া বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পুষ্টি এমন এক বিলাসিতা যা তাদের পরিবার কল্পনাও করতে পারে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের দাম এতটাই বেড়েছে যে 'চাল-ডাল জোগাড় করাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।'
ঘরভাড়া আর তিন সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়া—এমন পরিস্থিতিতে তিনি বলেন, 'আমাদের প্রতিদিন সংগ্রাম করতে হয়।' অধিকাংশ দিনই তাদের ভাত আর সবজি খেয়ে কাটাতে হয়। মাছ বা মাংস জোটে কদাচিৎ; আর দুধ বা ফল তাদের পাতে প্রায় কখনোই দেখা যায় না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি 'বাংলাদেশ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (মিআইসিএস) ২০২৫' প্রকাশ করেছে; সেখানে দেখা গেছে, সুমাইয়ার মতো সারা দেশের অনেক শিশুই ক্রমেই পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছে।
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে উচ্চতার তুলনায় কম ওজনের হার ৯.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২.৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা তীব্র অপুষ্টির আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি নির্দেশ করে। এছাড়া বয়স অনুযায়ী কম ওজনের হারও ২৩ শতাংশ।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের মাত্র ৩৫ শতাংশ ন্যূনতম বৈচিত্র্যময় খাবার পাচ্ছে—যা তাদের শারীরিক বৃদ্ধি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
বিবিএস স্বাস্থ্য অবনতিকে শিশু অপুষ্টির অন্যতম বিপজ্জনক রূপ হিসেবে বর্ণনা করেছে, যা সাধারণত দ্রুত ওজন হ্রাস বা ওজন না বাড়ার কারণে ঘটে। মাঝারি বা তীব্র স্বাস্থ্য অবনতিতে ভোগা শিশুদের সময়মতো চিকিৎসা না দেওয়া হলে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
খর্বতা হলো শিশুদের বৃদ্ধি ও বিকাশের ব্যাঘাত—যা মূলত অপুষ্টি, বারবার সংক্রমণ এবং পর্যাপ্ত মানসিক ও সামাজিক উদ্দীপনার অভাবে ঘটে থাকে।
তবে একটি ইতিবাচক দিক হলো, খর্বতার হার কিছুটা কমেছে—যা জাতীয় পর্যায়ে এখন ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
কিন্তু বিবিএস জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি চারজন বাংলাদেশি শিশুর মধ্যে প্রায় একজন এখনো কম ওজনের; যা স্বাস্থ্য অবনতি, খর্বতা এবং দীর্ঘস্থায়ী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ফল।
শক্তিশালী খাদ্যব্যবস্থা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং উন্নত পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন (ওয়াশ) কার্যক্রমের মাধ্যমে খর্বতা কমানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি স্বাস্থ্য অবনতি প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ওপর জোর দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিবিএস।
দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা
ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্সের অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম টিবিএসকে বলেন, এমআইসিএস জরিপের ফলাফলে একটি মিশ্র চিত্র উঠে এসেছে—কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে অবনতি।
তিনি বলেন, 'খাবারের বৈচিত্র্য বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি নিশ্চিত করে। অনেক শিশু দিনে পাঁচ ধরনের খাবারও পাচ্ছে না। খাবারের বৈচিত্র্য ছাড়া আমরা পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারব না।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, স্বাস্থ্য অবনতি বেড়ে যাওয়ার ফলে শিশুরা বয়স অনুযায়ী শারীরিক ও মানসিক বিকাশ লাভ করতে পারবে না। তিনি উল্লেখ করেন, 'যে শিশু স্বাস্থ্য অবনতিতে ভোগে, সে আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে না। এর ফলে তাদের মানসিক বিকাশ ও বুদ্ধিমত্তা (আইকিউ) ক্ষতিগ্রস্ত হবে।'
প্রথমবারের মতো এবারের এমআইসিএস জরিপে রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশু এবং গর্ভবতী নারীদের মধ্যে রক্তস্বল্পতার উচ্চ হার দেখা গেছে, যা ব্যাপকভাবে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।
খালেদা ইসলাম বলেন, 'আমাদের দেশে দীর্ঘকাল ধরেই আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা রয়েছে। ভিটামিনের অভাবসহ মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সম্পর্কিত রক্তস্বল্পতার হার অনেক বেশি। মায়ের রক্তস্বল্পতা কম ওজনের শিশু জন্মের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়; এসব শিশু নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া এবং অপর্যাপ্ত শারীরিক বৃদ্ধির ঝুঁকিতে থাকে।'
ড. খালেদা আরও বলেন, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চাপের কারণে অনেক পুষ্টিকর খাবার নিম্ন আয়ের পরিবারের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। 'মানুষ হয়তো পেট ভরার মতো যথেষ্ট খাবার খাচ্ছে, কিন্তু তারা পুষ্টিকর বা বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার খাচ্ছে না।'
তিনি খাদ্য বৈচিত্র্য বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পুষ্টি কর্মসূচিতে বিবিএস-এর এই ফলাফলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
মূল কেন্দ্রবিন্দুতে মাতৃস্বাস্থ্য
অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. ফেরদৌসী বেগম গর্ভাবস্থার আগে এবং গর্ভাবস্থা চলাকালীন রক্তস্বল্পতা দূর করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
তিনি বলেন, 'মায়ের রক্তস্বল্পতা প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ এবং কম ওজনের শিশু জন্মের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। আর কম ওজনের নবজাতকদের অকালে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।'
তিনি আরও বলেন, গর্ভাবস্থায় অন্তত চারবার চেক-আপ নিশ্চিত করা গেলে এসব সমস্যা আগে থেকেই শনাক্ত ও চিকিৎসা করা সম্ভব। 'যদি নিয়মিত চেক-আপ নিশ্চিত করা যায়, তবে অনেক সমস্যা জটিল হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।'
শিশু পুষ্টিতে সবচেয়ে পিছিয়ে সিলেট
এমআইসিএস ২০২৫-এর তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের পুষ্টি সূচকের অবস্থা সবচেয়ে দুর্বল।
সেখানে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে খর্বতার হার ৩২ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য অবনতির হার ১৪ শতাংশ—উভয়ই জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি।
তবে খুলনায় খর্বতার হার সবচেয়ে কম (২১ শতাংশ) এবং ঢাকায় স্বাস্থ্য অবনতির হার সবচেয়ে কম (১১ শতাংশ) রেকর্ড করা হয়েছে।
সারা দেশে ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের মাত্র ৭৪ শতাংশ প্রতিদিন ন্যূনতম সুপারিশকৃত সংখ্যকবার খাবার পায়। খাদ্য বৈচিত্র্যের মানদণ্ড পূরণ করে আরও কম সংখ্যক শিশু (৩৫ শতাংশ), আর ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য মাত্রার খাবার পায় মাত্র ৩০ শতাংশ শিশু।
গ্রামীণ, নিম্ন আয়ের এবং স্বল্প শিক্ষিত পরিবারের শিশুদের ক্ষেত্রে পুষ্টির মানদণ্ড পূরণের সম্ভাবনা অনেক কম।
তবে শহর, ধনী এবং উচ্চ শিক্ষিত পরিবারগুলোতেও অর্ধেকের কম শিশু পর্যাপ্ত বৈচিত্র্যময় খাবার পায়—যা সারা দেশেই পুষ্টি সচেতনতার বড় ঘাটতি নির্দেশ করে।
